>ব্যাট হাতে দুই সেঞ্চুরিসহ ৬০৬ রান, বল হাতে ১১ উইকেট। সাকিব আল হাসানই ছিলেন এবারের বিশ্বকাপের সবচেয়ে বড় চমক। কাল বনানীতে নিজের বাসায় বসে প্রথম আলোকে দেওয়া একান্ত সাক্ষাৎকারে সাকিব খুলে দিয়েছেন মনের আগল। জানিয়েছেন বিশ্বকাপের দুর্দান্ত পারফরম্যান্সের রহস্য কোথায় লুকিয়ে।
প্রশ্ন: বিশ্বকাপে আপনার দুর্দান্ত পারফরম্যান্সের পেছনে ফিটনেসের ভূমিকার কথা বলেছেন। কিন্তু শুধুই কি ফিটনেস? এ রকম ধারাবাহিক পারফরম্যান্সের পেছনে আর কী কাজ করেছে?
সাকিব আল হাসান: ফিটনেস ও পরিকল্পনা—দুটো বিষয়ই কাজ করেছে। বিশ্বকাপ নিয়ে পরিকল্পনা করি চার মাস আগে থেকে। ওই সময় থেকেই প্রস্তুতি নেওয়া শুরু করি। সেরা সময়টা ছিল আইপিএলে। তখন যেহেতু খেলছিলাম না, আমার কাজ করায় খুব সুবিধা হয়েছে। এখান থেকে সালাহউদ্দিন স্যার (সাকিবের বিকেএসপির কোচ ও জাতীয় দলের সাবেক সহকারী কোচ) গিয়েছিলেন দুই সপ্তাহের জন্য। আমি যে এক-দেড় মাস অনুশীলন করেছি, ওটাও খুব কাজে লেগেছে। আমার আইপিএল কোচ টম মুডিকে ধন্যবাদ জানাতে হবে। হায়দরাবাদ দলের অন্যরাও খুব সাহায্য করেছে। কেউ কোনো কিছুতে বাধা দেয়নি। বিশ্বকাপের সময় সঙ্গে পরিবার ছিল, মাঝামাঝি দিকে আব্বা-আম্মা গেছেন, এসব মানসিকভাবে সাহায্য করেছে। সবকিছুই আমার পরিকল্পনার মধ্যে ছিল।
প্রশ্ন: এটা তো গেল মানসিক পরিকল্পনার কথা। খেলা নিয়েও নিশ্চয়ই পরিকল্পনা ছিল...
সাকিব: হ্যাঁ, বাইরের অনেক কম্পিউটার বিশ্লেষকের সঙ্গে কথা বলে আমি আমার দুর্বলতা, শক্তির জায়গাগুলো জেনেছি। ওঁরা যদি আমার বিপক্ষে ওঁদের বোলার-ব্যাটসম্যানদের পরিকল্পনা দেন, সেটা কী রকম হতে পারে, এসব জেনে সেভাবে কাজ করেছি। ওঁদের বোলারদের আমাকে কোথায় বল করতে বলতে পারেন, সেগুলো দেখিয়েছেন। বিশ্বকাপে বোলাররা আমাকে ও রকম জায়গায়ই বল করেছে। কিন্তু এসব নিয়ে কাজ করে গেছি বলে আমি জানতাম কী হচ্ছে। কুমার সাঙ্গাকারার সঙ্গে কথা বলেছি। বোলিং নিয়েও এভাবে কাজ করার চেষ্টা করেছি। গত বছর ও কাউন্টিতে প্রচুর রান করেছে। কীভাবে করল, সেসব জেনেছি। এমসিসির মিটিংয়ে সাঙ্গাকারা আমাকে বলেছিল, ‘যত তুমি সতেজ থাকবে, নির্ভার থাকবে, তত ভালো হবে। পাগলের মতো অনুশীলন করার দরকার নেই। যদি ভালো খেল, সময়টা উপভোগ করো। ঘুরো, ফিরো। শুধু খেলার সময়টায় পূর্ণ মনোযোগ দেবে।’ এ ছাড়া মুশফিক ভাই আমাকে অনেক উৎসাহ দিয়েছেন। বিশ্বকাপে ওনার সঙ্গে আমার ব্যাটিংয়ের বোঝাপড়াটাও বেশ ভালো ছিল।
প্রশ্ন: বিশ্বকাপে ভালো খেলার লক্ষ্য সবারই থাকে। কিন্তু ভালো খেলতেই হবে, এই লক্ষ্যটা আপনার মধ্যে কীভাবে এল? কেনই–বা এত পরিকল্পনা?
সাকিব: বড় কারণ মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। উনি আমাকে একবার বলেছিলেন, ‘দেখো, আগে আমরা শচীনের নাম শুনতাম। ইমরান খানের কথা বলত মানুষ। কিন্তু আমাদের বলার মতো ও রকম কেউ ছিল না। এখন আমরা তোমার কথা বলতে পারি।’ প্রধানমন্ত্রীর কথাটা আমার মনে গেঁথে যায়। ভাবলাম, আমার কথা সবাই বলতে পারছে ঠিক আছে। এক নম্বর অলরাউন্ডার আছি অনেক দিন, তা–ও বুঝলাম। তারপরও ও রকম বড় কিছু তো আমি কখনো করিনি! বিশ্ব ক্রিকেটে তো ও রকম স্বীকৃতি কখনো আসেনি আমার। উনি এটা বলার পর মনে হলো, সত্যি সত্যি এ রকম কিছু একটা করা যায় কি না। যেহেতু মানুষ বলে, যেহেতু মানুষ বিশ্বাস করে, স্বয়ং প্রধানমন্ত্রী যেখানে বলছেন, তার মানে তো সম্ভব! চেষ্টা তো করতে দোষ নেই। এর পরপরই ছিল বিশ্বকাপ। আগের বিশ্বকাপগুলোয়ও বড় কিছু করা হয়নি, ভাবলাম এবার কিছু করা যায় কি না।
প্রশ্ন: নিজের ভালো খেলার পরিকল্পনার সঙ্গে বিশ্বকাপে বাংলাদেশ ভালো কিছু করবে, এমন আশাও কি ছিল মনে?
সাকিব: আমি সব সময়ই বিশ্বাস করেছি যে এবার অনেক দূরে যাওয়া সম্ভব। হয়তো সবার সাহায্য পেলে আমরা সেমিফাইনালেও চলে যেতাম। অনেক কারণে অনেক সময় সবকিছু ঠিকঠাক হয় না। কোনো খেলোয়াড়ের পারফরম্যান্স ভালো না হলে সে দলের চেয়ে নিজেকে নিয়ে বেশি ভাবতে শুরু করে। তখন সমস্যা হয়ে যায়। আমার মনে হয়, মাশরাফি ভাইয়ের ক্ষেত্রেও এটাই ঘটেছে। যেহেতু অধিনায়ক পারফর্ম করছিল না, এটা বড় সমস্যা। তার জন্যও, দলের জন্যও। অধিনায়ককে পারফর্ম করতে হবে। এর কোনো বিকল্প নেই। ওই জায়গাটাতে আমরা অনেক বেশি পিছিয়ে গেছি। তারপরও অসম্ভব ছিল না। বিশ্বকাপে আমরা শুরুটা করি খুবই ভালো। কিন্তু পরের দিকে তা ধরে রাখতে পারিনি।
প্রশ্ন: বিশ্বকাপের ম্যান অব দ্য টুর্নামেন্ট হওয়ার ভালো সুযোগ তৈরি হয়েছিল আপনার। পরিকল্পনায় কি এটাও ছিল?
সাকিব: না। লক্ষ্য যদি কিছু ঠিক করে থাকি, সেটা হলো, কমপক্ষে ৯-১০টা ম্যাচ খেলার সুযোগ থাকবে। ৫০ করেও যদি করি, ৫০০ রান করব। সঙ্গে ১০-১৫ উইকেট নিব। কিন্তু এতটা ভালো আশা করিনি। হ্যাঁ, যদি নিজের জন্য খেলতাম হয়তো আরও বেশি রান করতে পারতাম। আমার সব সময় দলের জন্য কিছু করার চিন্তাটাই আগে ছিল। বিশ্বকাপের আগে আইপিএলের সময় কার মুখে যেন একটা কথা শুনেছি। ওই কথাটা আমাকে দলের জন্য খেলতে আরও বেশি সাহায্য করেছে। আমাদের জার্সিতে পেছনে নিজেদের নাম থাকে, সামনে থাকে দেশের নাম। কথাটা ছিল, কখনো পেছনের নামের জন্য খেলো না। সামনের নামের জন্য খেলো। প্রতিটি ম্যাচে যখন ব্যাটিং বা বোলিংয়ে গেছি, চিন্তা করেছি, আমি সামনের নামের জন্য খেলব। কঠিন পরিস্থিতিতেও এটা মাথা থেকে সরাইনি। জফরা আর্চারকে খেলেছি। তখনো চিন্তা করেছি, দেশের জন্য কিছু করতে হলে তো ওর মুখোমুখি হতেই হবে। এই চিন্তাটা আমার কাজগুলো অনেক সহজ করে দেয়। আর আমি আমার জীবনে এত জোরে, এত মন থেকে কখনো জাতীয় সংগীত গাইনি। এগুলো আগে থেকেই আমার পরিকল্পায় ছিল। ঠিক করাই ছিল, এবার আমি এভাবে করব।
প্রশ্ন: বাংলাদেশের একজন খেলোয়াড় একের পর এক ম্যাচ ভালো খেলছে। অন্য দলগুলোর কোচ, খেলোয়াড়দের কাছ থেকে কেমন প্রতিক্রিয়া পেয়েছেন?
সাকিব: অনেক প্রশংসা করেছে সবাই। সবার কাছ থেকেই যথেষ্ট সম্মান পেয়েছি। এতটা সম্মান এর আগে কোনো দল বা খেলোয়াড়ের কাছ থেকে পাইনি আমি।
প্রশ্ন: এত ভালোর মধ্যে কিছু বিতর্কও আছে। ইংল্যান্ডের সঙ্গে মন্থর ব্যাটিং করায় আপনি নাকি অধিনায়ক মাশরাফিকে বলেছিলেন পরের ম্যাচে মাহমুদউল্লাহকে দলে না রাখতে। এ নিয়ে কিছু বলবেন?
সাকিব: এখানে লুকোচুরির কিছু নেই। যে এই বিষয়টা বলেছে বা এই সংবাদ করেছে, তিনি কাজটা ঠিক করেননি। বিশ্বকাপের সময় সাইফউদ্দিনকে নিয়ে একটা সংবাদ ছাপা হলো। ও নাকি বড় দলের বিপক্ষে ভয়ে খেলে না। এসব খবর কি দলের জন্য ভালো? দলে যারা ছিল তারা জানে এই নিউজ কে করিয়েছে। সাইফউদ্দিন কি খেলেনি? একটা দলকে মানসিকভাবে ভেঙে দেওয়ার জন্য এসবই যথেষ্ট।
প্রশ্ন: কিন্তু কোনো সাংবাদিক যখন এ রকম তথ্য পাবেন, তিনি তো লিখবেনই...
সাকিব: আমি সাংবাদিকের দোষ দিচ্ছি না। ভেতর থেকে তথ্যটা যে গেছে, সেটা খারাপ। আপনি জানবেন কখন? যখন আমি বলব, যখন আমাদের কেউ বলবে, তখনই জানবেন। ভেতর থেকে যখন এসব খবর বাইরে যাবে, দলের ভালো করার সম্ভাবনা থাকলেও সেটা ওই সময় কমে যাবে। যেটা আমাদের ফলাফলেও প্রভাব ফেলেছে। প্রথমত, আমি ও রকম কিছু বলিনি। আর যদি বলেও থাকি, সেটা যে বাইরে এল, এর দায় কে নেবে? আমাদের ভেতরে আলাপ-আলোচনা হতেই পারে। সেখানে বিদেশি কোচদের বাইরে এক-দুজনই থাকে যারা দলের নীতিনির্ধারণী বিষয়ে সম্পৃক্ত। নিশ্চয়ই তাদের থেকেই এটা বের হয়েছে। সেটা কে? বিষয়টা খুবই খারাপ। তারা হয় দলের ভালো চায় না, অথবা ওই খেলোয়াড়ের ভালো চায় না। একজন চোটে পড়ায় আরেকজন খেলছে, তার সামনে যদি আপনি বলেন, ইশ্, আজ অমুক থাকলে ভালো হতো, ওই খেলোয়াড় কি জীবনে ভালো খেলবে! এগুলো যখন হয়, তখন দলের পক্ষে ভালো কিছু করা সম্ভব হয় না। এই দল যে বিশ্বকাপে ভালো কিছু করবে না, আমি সেই দিনই বুঝে গেছি।
প্রশ্ন: আপনি কি নির্দিষ্ট কারও কথা বলতে চাচ্ছেন, যে দলের ভেতরের খবর বাইরে বলে দিচ্ছে? নাকি এটা আপনার ধারণা?
সাকিব: দেখুন এটুকু তো বুঝি যে দলে আমাদের দেশের যাঁরা ছিলেন, তাঁদের কাছ থেকেই বের হয়েছে বিষয়টা। বিদেশি কোনো কোচিং স্টাফ সাংবাদিকদের এটা বলেছেন বলে বিশ্বাস হয় না। কারণ আমি যদি অধিনায়ককে এ রকম কথা বলেও থাকি, সেটা তো নিশ্চয়ই বাংলায় বলব।
প্রশ্ন: আপনি এখন টেস্ট ও টি-টোয়েন্টির নেতৃত্বে। সামনে ওয়ানডের অধিনায়কত্বও নিতে হতে পারে। মানসিকভাবে কতটা প্রস্তুত?
সাকিব: মানসিকভাবে আমি টেস্ট ও টি-টোয়েন্টির নেতৃত্বের জন্যও প্রস্তুত নই। তবে দলটা এখন ভালো অবস্থায় নেই। নিজেও বুঝতে পারছি, দলটাকে মোটামুটি একটা অবস্থায় আনতে হলে আমি অধিনায়ক হলে ভালো। নয়তো কোনো সংস্করণেই অধিনায়কত্ব করার ব্যাপারে আমি নিজে তেমন আগ্রহ পাচ্ছি না। অধিনায়কত্ব না করলে বরং নিজের খেলায় মনোযোগ দিতে পারব। সেটাও দলের কাজে লাগবে। আমি চাই নতুনদের ওপর দায়িত্ব আসুক। আমরা তো ২০-২২ বছর বয়সে অধিনায়কত্ব নিয়েছি। এখন ওদের বয়স ২৬-২৭ হয়ে গেছে। যতক্ষণ না দায়িত্ব দেবেন, আপনি তো জানবেন না ওদের মধ্যে কিছু আছে কি না। ২২ বছর বয়সে যখন আমাকে অধিনায়ক করা হয়েছিল, কেউ কি জানত আমার মধ্যে কিছু আছে না নেই? সামনে টেস্ট চ্যাম্পিয়নশিপ, টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপ আছে। আগামী চার বছর নিয়ে এখন থেকেই পরিকল্পনা করা উচিত।