মুশফিকুর রহিম যখন নাজমুল ইসলামের বলে এলবিডব্লু হয়ে ফিরলেন, ঠিক তখনই চট্টগ্রামে জহুর আহমেদ চৌধুরী স্টেডিয়ামের গ্যালারি খালি করে দর্শকেরা সব বেরিয়ে যেতে শুরু করলেন। ব্যাপারটা এমন, যে বিনোদন যা পাওয়ার পাওয়া হয়ে গেছে। এখন রাত বাড়ার আগেই বাড়ি ফেরা যাক। আসলে অ্যালেক্স হেলস আর রাইলি রুশো আজ যা করেছেন, তারপর দর্শকদের পয়সা উসুল হতে খুব বেশি কিছু লাগে না।
বিপিএলের শুরু থেকে একটা অভিযোগ ছিল্—রান আসছে না। উইকেট টি-টোয়েন্টি ব্যাটিংয়ের উপযোগী নয়, টি-টোয়েন্টির মজাটা ঠিক পাওয়া যাচ্ছে না, এমন নানা কথা। কিন্তু চট্টগ্রামের উইকেট যেন আজ রানের ঝুড়ি নিয়েই বসে ছিল। রংপুর রাইডার্সের ইংলিশ তারকা হেলস আর প্রোটিয়া তারকা রুশো নিজেদের ব্যাটিং দিয়ে সেটিই আদায় করে নিয়েছেন। ২০ ওভারের ম্যাচে এক দল প্রথমে নেমে ২৩৯ রান তুলে ফেললে প্রতিদ্বন্দ্বিতার আসলে আর কিছুই বাকি থাকে না।
তারপরেও মুশফিকের ব্যাটের দিকে একটা ক্ষীণ আশা নিয়ে দর্শকেরা চেয়ে ছিল। ৩ ছক্কায় দর্শকদের আগ্রহের মাত্রা বাড়িয়েছিলেন মাত্র। কিন্তু বাংলাদেশি ক্রিকেটারদের যা হয় আরকি, একজন হেলস কিংবা রুশো হয়ে উঠতে পারেন না তাঁরা। মুশফিকের বেলায় ঠিক সেটিই হলো। দর্শকেরা আর কীসের আসায় বসে থাকবে! তারপরেও চিটাগং ভাইকিংস লড়েছে। রংপুরের বোলিংয়ের সামনে বুক চিতিয়ে একাই লড়েছেন ইয়াসির আলী। তাঁর ৭৮ রানের ইনিংসটা হারের ব্যবধানটা কেবল কমিয়েছেই। তারপরেও নিজেদের দর্শকদের সামনে প্রথম ম্যাচে চিটাগংয়ের হার ৭২ রানে। সাকল্যে ১৬৭ রান তুলেই গুটিয়ে গেছে তারা।
ম্যাচটা টি-টোয়েন্টির ইতিহাসেই স্থান পেয়ে গেছে—দর্শকদের সান্ত্বনা হতে পারে এটিই। হেলস আর রুশো টি-টোয়েন্টি ক্রিকেটের ইতিহাসে কেবল তৃতীয় জুটি হিসেবে পেয়েছেন দুজনই পেয়েছেন সেঞ্চুরির দেখা। ২০১১ সালে কেভিন ও'ব্রেইন, হামিশ মার্শাল আর ২০১৬ সালে বিরাট কোহলি আর এবি ডি ভিলিয়ার্সের সঙ্গে উচ্চারিত হবে অ্যালেক্স হেলস আর রাইলি রুশোর নাম। ইংলিশ কাউন্টির টি-টোয়েন্টি লিগ কিংবা আইপিএলের সঙ্গে থাকছে বিপিএল—এটা আজকের ম্যাচটি থেকে দর্শকদের প্রাপ্তি।
একটু ভুল বলা হলো। এই ম্যাচ থেকে প্রাপ্তিটা আসলে হেলস আর রুশোর ব্যাটিং। টি-টোয়েন্টি ক্রিকেটে বোলারদের কীভাবে নাজেহাল করতে হয়। কীভাবে মাঠের চারদিকে শট খেলে নিজের দলের রান তরতরিয়ে বাড়িয়ে নেওয়া যায় কিংবা দর্শকদের আনন্দ দেওয়া যায়, হেলস আর রুশো সেটিই যেন দেখালেন। ক্রিকেট আসলে জীবনের মতোই অদ্ভুত। হেলস আর রুশো যা করেছেন, এমন কিছুই প্রত্যাশা ছিল রংপুর দলে তাদেরই সতীর্থ ক্রিস গেইল আর এবি ডি ভিলিয়ার্সের কাছে। গেইল তো এবারের বিপিএলে আছেন তাঁর ছায়া হয়ে। আর ডি ভিলিয়ার্সের নিশ্চয়ই রয়্যাল চ্যালেঞ্জার্স বেঙ্গালুরুর হয়ে আইপিএলের সেই সন্ধ্যাটার কথা খুব মনে পড়ছে। কোহলিকে হেলস আর রুশোর জোড়া সেঞ্চুরির গল্পটা কী করবেন প্রোটিয়া তারকা? মাত্র ৭৮ বলে হেলস আর রুশোর ১৭৪ রানের জুটিটি বিপিএলের জন্যও গল্প করে যাওয়ার মতো একটা ঘটনা। বিপিএলের ইতিহাসে অবশ্য এটি সর্বোচ্চ রানের জুটি নয়। তৃতীয় সর্বোচ্চ। সর্বোচ্চ ২০১ রানের জুটি রংপুরের হয়েই গত বিপিএলের ফাইনালে গড়েছিলেন গেইল ও কিউই তারকা ব্রেন্ডন ম্যাককালাম।
চিটাগং ভাইকিংসের বোলারদের জন্য দয়া হতে পারে ক্রিকেটপ্রেমীদের। বিশেষ করে খালেদ আহমেদ আর রবিউল হক। খালেদ আসছে নিউজিল্যান্ড সফরে বাংলাদেশের টেস্ট দলে সুযোগ করে নিয়েছেন। জীবনে প্রথমবারের মতো জাতীয় দলের হয়ে বিদেশ সফরে যাবেন, এমন আনন্দময় সময়ে তিনি আজকের ম্যাচটি যত দ্রুত সম্ভব ভুলে যান। ৩ ওভারে ৫০ রান দিয়েছেন তিনি। এর মধ্যে বোলিংয়ে এসেই হেলসের সামনে পড়ে ২২। ভুলতে না পারলেও দিনটাকে যদি তিনি 'শিক্ষা' হিসেবে নেন, সেটি আখেরে তাঁরই লাভ।
রবিউল ৪ ওভারে দিয়েছেন ৫৪। যদিও একটি উইকেট নিয়েছেন তিনি। তবে নিউজিল্যান্ড সফরে সুযোগ পাওয়া আরেক তরুণ মিডিয়াম ফাস্ট বোলার আবু জায়েদ চট্টগ্রামের 'হেলস-রুশো ঝড়ে'র মধ্যেও বেশ ভালো বোলিং করেছেন। ৪ ওভারে ৩৫ রান দিয়ে ২ উইকেট তাঁর। গেইলের উইকেট তুলে নিয়ে চিটাগং ভাইকিংসের জন্য একটা দারুণ শুরুও তিনি এনে দিয়েছিলেন।
চিটাগংয়ের জন্য বড় ধাক্কা হয়ে আসে তাদের আশা-ভরসার প্রতীক রবি ফ্রাইলিংকের আহত হওয়া। ২ ওভারের বেশি করতে পারেননি তিনি। ১৪ রান দিয়েছিলেন কোনো উইকেট পাননি। বাঁ হাতি স্পিনার সানজামুল ইসলামও খরচে ছিলেন। ৪ ওভারে দিয়েছেন ৩৭। সিকান্দার রাজার অফ স্পিনও ব্যবহার করেছিলেন মুশফিক। কিন্তু জিম্বাবুইয়ান তারকাও ৪ ওভারে দিয়েছেন ৪৮। আসলে আজ দিনটাই যে ছিল রংপুরের দুই ব্যাটসম্যান হেলস আর রুশোর।
ইয়াসিরকে কেন সম্ভাবনাময় ক্রিকেটার বলা হয়, সিলেটের পর চট্টগ্রামে এসেও সে প্রমাণটা দিলেন তিনি। সেঞ্চুরির সম্ভাবনা তিনি জাগিয়েছিলেন। কিন্তু ৪৮ বলে ৭৮ রানের ইনিংসটি খেলে তিনি মাশরাফির বলে ডি ভিলিয়ার্সের হাতে ক্যাচ দেন।
আগেই বলা হয়েছে চিটাগংয়ের হয়ে একাই লড়েছেন ইয়াসির। পাশাপাশি মুশফিকের ১১ বলে ২২ রান ছাড়া বাকি সবাই ব্যর্থ। সিকান্দার রাজা, মোহাম্মদ শাহজাদ, নজিবউল্লাহ জাদরান কিংবা মোসাদ্দেক হোসেন। হেলস কিংবা রুশো না হোক নিজেদের দলের ইয়াসিরের ধারেকাছেও থাকতে পারেননি তারা। ২৩৯ রানের জবাবে এমন ব্যাটিং পারফরম্যান্স হলে দর্শকদের জন্য আর কিছুই থাকে না। দলের কথা বলাই বাহুল্য।
রংপুরের বোলাররা আয়েশ করেই চিটাগংয়ের উইকেটগুলি তুলে নিয়েছেন। মাশরাফি ৩৪ রান দিয়ে নিয়েছেন ৩ উইকেট। ফরহাদ রেজা ২ টি। নাজমুল ইসলাম ও শহীদুল ইসলামরা নিজেদের মধ্যে ভাগ করে নিয়েছেন একটি করে উইকেট।
ম্যাচে রীতিমতো বিধ্বস্ত চিটাগং। হেলস-রুশো এমন ঝড় তুলেছিলেন, তাতে বিধ্বস্ত হওয়াটাই তো স্বাভাবিক।