২৩ বছর আগে এই দিনে মহাপ্রয়াণ ঘটেছিল সর্বকালের সেরা ব্যাটসম্যান স্যার ডন ব্র্যাডম্যানের। ব্র্যাডম্যান-স্মরণে এ লেখা প্রথম প্রকাশিত হয়েছিল ২০২২ সালের ২৫ ফেব্রুয়ারি, তাঁর ২১তম মৃত্যুবার্ষিকীতে।
প্রাপ্তবয়স্ক আমেরিকান মাত্রই নাকি মনে করতে পারেন, জন এফ কেনেডি গুলিবিদ্ধ হওয়ার খবরটা তিনি কীভাবে পেয়েছিলেন। ক্রিকেটে সেই ‘জেএফকে মোমেন্ট’ স্যার ডন ব্র্যাডম্যানের মৃত্যু।
স্টিভ ওয়াহর যেমন পরিষ্কার মনে আছে, খবরটা পেয়েছিলেন রাত ২টা ১৫ মিনিটে। সিডনি থেকে স্ত্রী লিনেটের ফোনে।
অ্যাডাম গিলক্রিস্টকে দুঃসংবাদটা জানিয়েছিল পার্থের এক রেডিও স্টেশন। যে রেডিওর সঙ্গে চুক্তিবদ্ধ ছিলেন গিলক্রিস্ট। ধাক্কাটা সামলে ওঠার আগেই তাই প্রতিক্রিয়া জানাতে হয়েছিল শোকবিহ্বল অস্ট্রেলিয়ান সহ-অধিনায়ককে। গিলক্রিস্টের পাশের রুমেই ছিলেন শেন ওয়ার্ন। ফোনে তাঁকে ঘুম ভাঙিয়ে খবরটা দিয়েছিলেন একই হোটেলে থাকা এক টেলিভিশন রিপোর্টার।
অস্ট্রেলিয়া দলের মিডিয়া ম্যানেজার ব্রায়ান মুর্গাট্রয়েড খবরটা পান মেলবোর্ন থেকে ফোনে। ফোনটা করেছিলেন বোর্ডেরই কেউ একজন। মুর্গাট্রয়েড সঙ্গে সঙ্গে কাগজ-কলম নিয়ে টেবিলে বসে যান। ‘প্লিজ, বি অ্যাওয়্যার দ্যাট স্যার ডোনাল্ড ব্র্যাডম্যান হ্যাজ পাস্ড অ্যাওয়ে’—এ কথাটাই অনেকগুলো কাগজে লিখে তা ঢুকিয়ে দেন অস্ট্রেলিয়া দলের প্রত্যেক সদস্যের দরজার নিচ দিয়ে। পরদিন সকালে অবশ্য জানতে পারেন, এটা না করলেও হতো। পরিবার অথবা মিডিয়ার মাধ্যমে সবাই যে তা আগেই জেনে গিয়েছিলেন। অনেকেই টেলিভিশন চালিয়ে সিএনএনে বিস্তারিতও। হ্যাঁ, স্যার ডনের মৃত্যু আমেরিকান চ্যানেল সিএনএনের জন্যও বড় খবরই ছিল।
তা ২০০১ সালের ২৫ ফেব্রুয়ারি স্যার ডন ব্র্যাডম্যান যখন চিরতরে চোখ বুজলেন, স্টিভ ওয়াহরা তখন কোথায় ছিলেন? স্বঘোষিত ‘ফাইনাল ফ্রন্টিয়ার’ জয় করতে অস্ট্রেলিয়া দল নিয়ে স্টিভ ওয়াহ তখন ভারতে। ভোররাতে খবরটা পেয়ে শোকে মুহ্যমান অস্ট্রেলিয়ান ক্রিকেটাররা সকালে মুম্বাইয়ের তাজমহল হোটেলের লবিতে নেমেই দেখেন সাংবাদিকদের গিজগিজে ভিড়। যাঁদের চাহিদা মেটাতে সুইমিংপুলের পাড়ে স্টিভ ওয়াহ ও শেন ওয়ার্নকে তাৎক্ষণিক সংবাদ সম্মেলন করতে হয়। কিছুক্ষণ পর মাঠের পূর্বনির্ধারিত সংবাদ সম্মেলনেও স্যার ডনকে নিয়েই সব প্রশ্ন। একটা সময় ব্রায়ান মুর্গাট্রয়েডকে তাই মনে করিয়ে দিতে হয়, এই সংবাদ সম্মেলনটা পরদিন শুরু হতে যাওয়া সিরিজের প্রথম টেস্ট ম্যাচ নিয়ে। কিন্তু স্যার ডনের মৃত্যু নিয়ে সবাই তখন এমনই আলোড়িত যে টেস্ট ম্যাচ নিয়ে কে মাথা ঘামায়!
ডন ব্র্যাডম্যানের মৃত্যুবার্ষিকী ২১ বছর আগের সেই দিনে ফিরে যাওয়ার উপলক্ষ তো হতেই পারে। তবে লেখাটা এভাবে শুরু করার আরেকটা কারণও আছে। নতুন কীই–বা বলার আছে তাঁকে নিয়ে! কোন তথ্যটা ক্রিকেটপ্রেমীদের অজানা? ৯৯.৯৪–এর মতো খটোমটো একটা সংখ্যাও তো তাঁর কল্যাণে সবার মুখস্থ। যা বলামাত্র সবাই বুঝে ফেলেন, এটা টেস্ট ক্রিকেটে স্যার ডন ব্র্যাডম্যানের ব্যাটিং গড়। শেষ ইনিংসে ৪ রান করলেই সেই গড় হতো ১০০—সেভাবে ক্রিকেট অনুসরণ করেন না, এমন মানুষও তা জানেন।
এই ৯৯.৯৪-এর মহিমা বুঝতে আপনাকে একটু অন্যদের দিকে তাকাতে হবে। টেস্ট ক্রিকেটে কমপক্ষে ২০টি ইনিংস খেলেছেন, এমন ব্যাটসম্যানদের মধ্যে দ্বিতীয় সর্বোচ্চ ব্যাটিং গড় ব্র্যাডম্যানের চেয়ে ৩৮.০৭ কম। যা ব্র্যাডম্যান-পূর্ব অস্ট্রেলিয়ার সেরা ব্যাটসম্যান হিসেবে বিবেচিত ভিক্টর ট্রাম্পারের ব্যাটিং গড়ের (৩৯.০৪) প্রায় সমান। ব্যাটিং গড় দিয়ে ভিক্টর ট্রাম্পারের বিচার করতে গেলে নির্ঘাত ক্রিকেট-মূর্খ অপবাদ জুটবে। তারপরও ট্রাম্পারকে টেনে আনার কারণ, ব্র্যাডম্যানের অসাধারণত্ব বোঝাতে এর চেয়ে ভালো উদাহরণ কই পাবেন!
পরিসংখ্যান অনেক কিছু বলে, আবার ধোঁকাও দেয়। ব্র্যাডম্যানের ক্ষেত্রে এ সমস্যা নেই। ব্যাটিংয়ের মতো ভাগ্যনির্ভর অনিশ্চিত একটা কাজকে এমনই দুই আর দুইয়ে চারের মতো বানিয়ে ফেলেছিলেন যে ভাবলে স্তম্ভিত হয়ে যেতে হয়। ৩৩৮টি প্রথম শ্রেণির ইনিংসের ২২১টিতে সেঞ্চুরি পাননি। সেই ইনিংসগুলোর গড় ৫৮.২০! যা জ্যাক হবস, ওয়ালি হ্যামন্ড, রণজিৎসিংজি, সিবি ফ্রাই, গ্যারি সোবার্স, ভিভ রিচার্ডস ও জিওফ বয়কটের মতো গ্রেটদের সেঞ্চুরিসহ ব্যাটিং গড়ের চেয়েও বেশি!
প্রায় অতিপ্রাকৃত রূপ নেওয়া ব্র্যাডম্যানের মহিমা তাই শুধু ক্রিকেটেই সীমাবদ্ধ থাকছে না। অন্য কোনো খেলাতেও তো কারও বাকি সবার চেয়ে এমন আলোকবর্ষ এগিয়ে থাকার কাহিনি নেই। ডন ব্র্যাডম্যানের মৃত্যুর কিছুদিন আগে প্রকাশিত চার্লস ডেভিস নামে মেলবোর্নের এক গণিতবিদের দ্য বেস্ট অব দ্য বেস্ট বইয়ের বিষয়ও ছিল মূলত এটাই। যাতে নানা মানদণ্ডের ভিত্তিতে ডন ব্র্যাডম্যানের রেটিং দাঁড়িয়েছিল ৪.৪। অন্য খেলার চ্যাম্পিয়নদের মধ্যে সবচেয়ে কাছাকাছি ছিলেন পেলে (৩.৭ )। এরপরের নামগুলো ছিল এমন: বেসবলের টাই কব (৩.৬), গলফের জ্যাক নিকলাস (৩.৫), বাস্কেটবলের মাইকেল জর্ডান (৩.৪) ও আমেরিকান ফুটবলের জো মন্টানা (৩.১)। ডেভিস হিসাব করে দেখিয়েছেন, টাই কবকে বেসবলে ব্র্যাডম্যানের মতো আধিপত্য দেখাতে তাঁর ক্যারিয়ার ব্যাটিং গড় হতে হতো .৩৯২। আসলে যা .৩৬৬। নিকলাসকে জিততে হতো ২৫টি মেজর গলফ শিরোপা (জিতেছেন ১৮টি)। মাইকেল জর্ডানকে প্রতিটি খেলায় ৪৩ পয়েন্ট স্কোর করতে হতো, তিনি করেছেন ৩২।
ব্র্যাডম্যানকে বুঝতে তাই ব্র্যাডম্যানেই ভরসা করতে হয়। যা শুধু খেলার সীমানায় আবদ্ধ থাকতে চায় না। বিখ্যাত অঙ্কবিদ টমাস হার্ডি তাই ‘ব্র্যাডম্যান ক্লাস’ বলে একটা টার্ম বের করেছিলেন। যেটি ছিল মানবীয় সব কীর্তির চূড়ান্ত মানদণ্ড। হার্ডির চোখে গ্যালিলিও, নিউটন, আইনস্টাইনরা স্বীকৃতি পেয়েছিলেন ‘ব্র্যাডম্যান ক্লাস’ বলে।
শেষ টেস্ট খেলেছেন প্রায় ৭৪ বছর আগে। স্যার ডন ব্র্যাডম্যান নামের মহিমা যে কমার বদলে দিন দিন বেড়ে চলেছে, তা তো আর এমনিতেই নয়।
স্যার ডন ইজ ডেড। লং লিভ স্যার ডন।