দুজনের কোনো তুলনাই চলে না।
একজন তাঁর সময়ের সেরা ব্যাটসম্যানদের একজন। তার চেয়েও বড় পরিচয়, ওয়েস্ট ইন্ডিজের স্বর্ণযুগের সারথি।
অন্যজন একটু ব্যাটিং পারা-একটু বোলিং পারা অলরাউন্ডার। ক্রিকেটীয় পরিভাষায় যাকে বলে ‘বিটস অ্যান্ড পিসেস্ ক্রিকেটার।’
চরিত্রেও কোনো মিল নেই।
একজন রাশভারী, বেশির ভাগ সময়ই গম্ভীর মুখ যেন জানিয়ে দেয়, জীবনটা হাসি-তামাশার ব্যাপার নয়।
অন্যজনের মুখে সব সময়ই হাসি। কথাবার্তায়, দেহভঙ্গিমায় চারপাশে ছড়িয়ে দেওয়া বার্তা—জীবন হলো উপভোগের আরেক নাম।
একজন ক্লাইভ লয়েড।
অন্যজন ড্যারেন স্যামি।
খেলোয়াড়ি কীর্তি আর চরিত্রে বিপরীত এই দুজনকে একটা জায়গায় মিলিয়ে দিতে পারে আজকের রাত।
ক্রিকেটের প্রথম দুটি বিশ্বকাপ জিতেছিল ওয়েস্ট ইন্ডিজ। দুবারই অধিনায়ক ক্লাইভ লয়েড। আজ ওয়েস্ট ইন্ডিজ জিতলে প্রথমবারের মতো একই অধিনায়কের হাতে দুবার টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপ উঠবে। মিলে যাবেন ক্লাইভ লয়েড আর ড্যারেন স্যামি। ট্রফি নিয়ে দুজনের একটা ছবিও হয়ে যাওয়ার কথা। এখন ওয়েস্ট ইন্ডিজ ক্রিকেটের প্রধান নির্বাচক লয়েড তো স্যামির দলের সঙ্গেই ঘুরছেন।
স্যামির অধিনায়কত্ব পাওয়ায় টাকাপয়সা নিয়ে বোর্ডের সঙ্গে ওয়েস্ট ইন্ডিয়ান খেলোয়াড়দের বিরোধের বড় ভূমিকা ছিল। সঙ্গে তাঁর আমুদে চরিত্র আর ইতিবাচক মানসিকতারও। ওয়েস্ট ইন্ডিজ মানে এক ছাতার নিচে ক্যারিবিয়ান সাগরের বুকে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা সব দ্বীপরাষ্ট্রের খেলোয়াড়। যাঁদের একতাবদ্ধ রাখাটা অধিনায়কের জন্য সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ। লয়েড তা খুব ভালো পেরেছিলেন। অতটা না হলেও পেরেছেন স্যামিও। ২০১২ টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপে ওয়েস্ট ইন্ডিজের স্লোগান ছিল—এক দল, এক মানুষ, এক লক্ষ্য। যেটি পূর্ণতা পেয়েছিল শিরোপা জয়ে। এই বিশ্বকাপের ওয়েস্ট ইন্ডিজও মনে করিয়ে দিচ্ছে সেই স্লোগানটা। স্যামি-গেইল-ব্রাভোরা যেন বিনি সুতোয় গাঁথা এক মালা। তা এই মালা গাঁথার কাজটা কে করল? স্যামির অবশ্যই ভূমিকা আছে। তবে আসল কাজটা করে দিয়েছে বিতর্ক আর সমালোচনা। এই বিশ্বকাপের আগেও গত কয়েক বছর নিয়মিত হয়ে যাওয়া ওয়েস্ট ইন্ডিজ ক্রিকেটের সেই পুরোনো সমস্যা। টাকাপয়সা নিয়ে গন্ডগোলে মূল দল পাঠানোই পড়ে গিয়েছিল সংশয়ের আবর্তে। দলকে এমন একতাবদ্ধ করে তোলায় অনিশ্চয়তার ওই সময়টার বড় ভূমিকা দেখেন স্যামি।
সঙ্গে যোগ হয়েছে আরও কিছু ব্যাপার। পরের টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপ চার বছর পর, ৫০ ওভারের বিশ্বকাপেরও তিন বছর বাকি। এই দলের অনেকের জন্য এটাই তাই হতে যাচ্ছে শেষ বিশ্বকাপ। সেটি স্মরণীয় করে রাখার একটা বাড়তি প্রেরণা তো থাকবেই। স্যামি সেই প্রেরণার আগুনটাই জ্বেলে দিয়েছেন গেইল-স্যামুয়েলস-বদ্রিদের বুকে। বাকি কাজটা করেছেন মার্ক নিকোলাস। ওয়েস্ট ইন্ডিজ এই বিশ্বকাপ জিতলে নিশ্চিতভাবেই একটা ‘ধন্যবাদ’ পাবেন সাবেক হ্যাম্পশায়ার ব্যাটসম্যান। স্যামিদের তাতিয়ে তোলার কৃতিত্ব তো তাঁরই।
টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপ শুরুর আগে ক্রিকেটের বিখ্যাত ওয়েবসাইট ক্রিকইনফোতে একটা কলাম লিখেছেন মার্ক নিকোলাস। যাতে ওয়েস্ট ইন্ডিয়ান ক্রিকেটারদের মাথায় মস্তিষ্ক নামক বস্তুটির অস্তিত্ব নিয়ে সন্দেহ প্রকাশ করা হয়েছে। সেমিফাইনালে জেতার পরই টুইটারে যেটির জবাব দিয়েছেন কোচ ফিল সিমন্স—‘মস্তিষ্কহীন কিছু মানুষের কী দুর্দান্ত প্রদর্শন—মস্তিষ্ক থাকলে না জানি কী হতো!’ স্যামির সংবাদ সম্মেলনেও প্রসঙ্গটা উঠল। ড্যারেন স্যামি যে রাগতেও জানেন, সেটিও জানা গেল এর কল্যাণে! ‘কীভাবে কেউ কারও সম্পর্কে বলে যে, তাঁর মস্তিষ্ক নেই। আরে, জন্তুদেরও তো মস্তিষ্ক আছে। আমরা তো জড়বস্তু নই। ওই কথাটাই আমাদের সবাইকে তাতিয়ে দিয়েছে’—এটি বলার পরই রাগত মুখে আবার ফিরে এল হাসি। ওয়েস্ট ইন্ডিয়ানরা খুব রংচং মাখিয়ে কথা বলেন। স্যামিও যেমন বললেন, ‘ঈশ্বর কুৎসিত কিছু পছন্দ করেন না। আমাদেরও খুব সুন্দর করে বানানো হয়েছে। এ কারণেই আমরা এমন রোমাঞ্চক ক্রিকেট খেলি।’
এর আগেও বলেছেন, ওয়েস্ট ইন্ডিজ দলের জন্য এই বিশ্বকাপ ‘আমরা বনাম বাকি সবাই’। ফাইনালের আগে আবারও সেই একই কথা। বোর্ডের সঙ্গে সমস্যা, ওয়েস্ট ইন্ডিজ ক্রিকেটকে হেয় চোখে দেখা, মার্ক নিকোলাসের ওই মন্তব্য—এসব কিছু মিলিয়ে-মিশিয়ে ‘আমরা বনাম বাকি সবাই’-কে দলের জন্য জ্বালানি বানিয়ে নিয়েছেন স্যামি। যে কারণে তাঁর কণ্ঠে খেলা করে অপার আত্মবিশ্বাস, ‘কাপটা হাতে নিতে আর একটা ধাপ বাকি। আমরা বিশ্বাস করি, আমরা তা করতে পারব।’
তা পারলে ম্যাচ শেষের উদ্যাপনটাও দেখার মতোই হবে। প্রতিপক্ষের সঙ্গে নিজেদের ব্যাটিং-বোলিংয়ের তুলনা করতে করতেই স্যামি বলে দিলেন, ‘উদ্যাপনের কথা যদি বলেন, ওরা আমাদের কাছে পাত্তাই পাবে না।’
ওয়েস্ট ইন্ডিজ জিতলে গেইলই হয়তো মধ্যমণি হয়ে থাকবেন সেই উদ্যাপনের। স্যামিও বোধ হয় খুব একটা পিছিয়ে থাকবেন না। ক্লাইভ লয়েডের পাশে নিজের নাম লেখানোটা তো উদ্দাম উদ্যাপনেরই উপলক্ষ!