>দুয়ারে বাংলাদেশ-অস্ট্রেলিয়া টেস্ট সিরিজ। প্রতীক্ষিত এই টেস্ট সিরিজে ‘অচেনা’ এক অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে খেলতে নামছে বাংলাদেশ। দুই দলের কারও অভিজ্ঞতা নেই একে অপরের বিপক্ষে খেলার। উপমহাদেশে স্মিথ-ওয়ার্নারদের অতীত রেকর্ড আর তাঁদের খেলার ধরন বিশ্লেষণ করেই নামতে হবে মুশফিকদের। পরিসংখ্যান ও বিশেষজ্ঞের পর্যবেক্ষণে অস্ট্রেলিয়া স্কোয়াড তুলে ধরা হবে তিন পর্বে। বিশ্লেষণ করেছেন অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে বাংলাদেশের একমাত্র টেস্ট সেঞ্চুরিয়ান শাহরিয়ার নাফীস। আজ প্রকাশ হলো প্রথমটি
স্টিভেন স্মিথ
লেগ স্পিনার হিসেবে দলে সুযোগ পাওয়া স্মিথ সময়ের সঙ্গে বদলেছেন নিজেকে। সময়ের অন্যতম সেরা এই ব্যাটসম্যান হতে পারেন বাংলাদেশের সামনে সবচেয়ে বড় দেয়াল। দেশে-দেশের বাইরে পেস কিংবা স্পিন—যেকোনো বোলিংয়ের বিপক্ষে সমান কথা বলে তাঁর ব্যাট। এশিয়ায় অস্ট্রেলিয়ার ব্যাটসম্যানদের মধ্যে তাঁর রেকর্ড সবচেয়ে ভালো। দলের ব্যাটিং বিপর্যয়ে তাঁর লড়াকু ইনিংসের উদাহরণ অসংখ্য। অধিনায়কত্বের চাপে অনেক কিংবদন্তি ব্যাটসম্যানের ভেঙে পড়ার উদাহরণ আছে, স্মিথের কাছে সেটিই উপভোগের দারুণ এক মন্ত্র। শুধু ব্যাটসম্যান হিসেবে যে ৩০টা ম্যাচ খেলেছেন তাতে গড় ৫১.৮৩, অধিনায়ক হিসেবে ২৪ টেস্টে নেতৃত্ব দেওয়া স্মিথের গড় ৭৩.২৭। এবারও সাকিব-মোস্তাফিজ-মিরাজদের ভোগাতে ভালোভাবেই তৈরি হয়ে এসেছেন অস্ট্রেলীয় অধিনায়ক।
স্মিথের টেস্ট ক্যারিয়ার: | ||||
| ম্যাচ | গড় | ১০০ | ৫০ |
সামগ্রিক | ৫৪ | ৬১.০৫ | ২০ | ২০ |
দেশে | ২৪ | ৬৮.৬৫ | ১০ | ৮ |
প্রতিপক্ষের মাঠে | ২৬ | ৫৯.৮৬ | ১০ | ৯ |
এশিয়ায় | ১১ | ৫১.৪৭ | ৪ | ৪ |
২০১৭ সাল | ৫ | ৬৪.৬৬ | ৩ | ১ |
স্মিথের উইকেট সবচেয়ে বেশি পেয়েছেন পেসাররা (৮৬-এর মধ্যে ৪৭ বার)। তবে বাংলাদেশের স্পিনাররা খুশি হতে পারেন অস্ট্রেলিয়ার টপ অর্ডার ব্যাটসম্যানের পরিসংখ্যান দেখে। গত দুই বছরে এশিয়ায় খেলা ১৪ ইনিংসের ১১ বারই স্পিনারদের শিকার স্মিথ। এর মধ্যে রঙ্গনা হেরাথ তাঁকে আউট করেছেন পাঁচবার (ছয় ইনিংসের মধ্যে)। রবীন্দ্র জাদেজার শিকার তিনবার। বাঁহাতি স্পিনারদের বিপক্ষে স্মিথের এই পরিসংখ্যান অনুপ্রাণিত করতে পারে সাকিব-তাইজুলদের।
শাহরিয়ারের চোখে স্মিথ
‘বাংলাদেশের সামনে সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হবে স্মিথ। গত ভারত সফরটা দেখেন, পুরো অস্ট্রেলিয়ার হয়ে একা লড়াই করে গেছে সে। টেকনিক্যালি আন অর্থোডক্স, খেলার ধরনটা ভিন্ন। অস্ট্রেলিয়ানদের মধ্যে যে দৃঢ়চেতা মানসিকতা থাকে এটার চূড়ান্ত উদাহরণ হচ্ছে স্টিভেন স্মিথ। বাংলাদেশের জন্য বিরাট মাথাব্যথার কারণ হতে পারে সে।
অনেকটা হ্যান্ড-আই কো-অর্ডিনেশনের ওপর নির্ভর করে খেলে সে। অনেক নড়েচড়ে খেলে। ফুট মুভমেন্ট বেশি। স্পিনের বিপক্ষে সফল হতে ওর এই টেকনিকটা ভীষণ কাজে দেয়। পুরো ক্রিজটা ব্যবহার করে। অফ স্পিনের ক্ষেত্রে লেগ স্টাম্প ছেড়ে দেয় আবার লেগ স্পিনের ক্ষেত্রে অফ স্টাম্প ছেড়ে দেয়। এই নড়েচড়ে খেলায় স্পিনের বিপক্ষে সে বেশি সফল।
স্মিথের উইকেট নিতে হলে বাংলাদেশের পেসারদের একটা নির্দিষ্ট চ্যানেলে বোলিং করতে হবে। বলের ওপর সে উঠে আসে। লেগ স্টাম্পের বল খুবই ভালো খেলে। শরীর বরাবার বল পছন্দ করে বেশি। তাকে শর্ট বা হাফভলি দেওয়া যাবে না। আমাদের উইকেটে তাকে শর্ট বল করলে অনেক সময় পেয়ে যাবে। ওপরে বোলিং করলে সে আরামে খেলবে। তবে বল রিভার্স করা শুরু করলে তাঁর এলবিডব্লু হওয়ার সম্ভাবনা বেশি।
স্পিনারদের বেশি সফল হওয়ার সম্ভাবনা আছে ওর বিপক্ষে। আমাদের উইকেটে বল টার্ন কম করে। স্কিড করে সোজা আসে বেশি। ও যেহেতু নড়েচড়ে খেলে, তাইজুল-সাকিব-মিরাজ স্টাম্পে বোলিং করতে পারলে ওকে এলবিডব্লু করার সুযোগ বেশি। যদি সোজা আসে বা বল টার্ন করলে ওর ক্যাচ হওয়ার সম্ভাবনা বেশি থাকবে। এশিয়ায় ১১ বার স্পিনারের শিকার হয়েছে বলে স্পিনে তাকে দুর্বল ভাবার কারণ নেই। উপমহাদেশে ১০০ ওভার খেললে ৯০ ওভারই খেলতে হয় স্পিনারদের। তার সাফল্য দেখে বোঝার উপায় নেই যে সে স্পিনে দুর্বল।’
ডেভিড ওয়ার্নার
কোনো প্রথম শ্রেণির ম্যাচ খেলার অভিজ্ঞতা ছাড়াই ডাক পেয়েছিলেন অস্ট্রেলিয়া টেস্ট দলে। প্রতিভার বিচ্ছুরণে বাঁহাতি ওপেনার নিজেকে প্রতিষ্ঠ করেছেন দলের অন্যতম ভরসা হিসেবে। এরই মধ্যে ঠাঁই করে নিয়েছেন রেকর্ড বইয়ের অনেক অধ্যায়ে। গত জানুয়ারিতে পাকিস্তানের বিপক্ষে সিডনি টেস্টের প্রথম দিনে লাঞ্চের আগে সেঞ্চুরি করেছেন। টেস্ট ইতিহাসে এই রেকর্ড তাঁর আগে নাম তুলেছেন মাত্র চার ব্যাটসম্যান।
বিধ্বংসী ওই ওপেনারের সব কারিকুরি যেন দেশের মাঠেই। বিদেশে, বিশেষ করে এশিয়া এখনো ওয়ার্নারের কাছে বিরাট ধাঁধা। ৬৪ টেস্ট খেলা ওয়ার্নারের গড় ৪৭.৪২, এশিয়ার মাটিতে সেটি ৩০.৩৮। ১৮ টেস্ট সেঞ্চুরির মাত্র একটি পেয়েছেন এশিয়ায়। ২০১৪ সালের অক্টোবরে দুবাইয়ে পাকিস্তানের বিপক্ষে ওই একটাই সেঞ্চুরি।
ওয়ার্নারের টেস্ট ক্যারিয়ার: | ||||
| ম্যাচ | গড় | ১০০ | ৫০ |
সামগ্রিক | ৬৪ | ৪৭.৪২ | ১৮ | ২৪ |
দেশে | ৩৩ | ৫৯.২১ | ১৪ | ৯ |
প্রতিপক্ষের মাঠে | ২৯ | ৩৪.৯৬ | ৩ | ১৪ |
এশিয়ায় | ১৩ | ৩০.৩৮ | ১ | ৫ |
২০১৭ সাল | ৫ | ৩৬.১০ | ১ | ২ |
শাহরিয়ারের চোখে ওয়ার্নার
‘গতিময়-বাউন্সি উইকেটে খুবই ভালো ব্যাটসম্যান। ফাস্ট বোলিং দুর্দান্ত খেলে। মাঝেমধ্যে রাউন্ড দ্য উইকেটে বল সুইং করাতে পারলে সে বিপাকে পড়বে। সেটি কাজে না দিলে তার বিপক্ষে সবচেয়ে মোক্ষম অস্ত্র হতে পারে আমাদের মেহেদী হাসান মিরাজ। অফ স্পিনে সে যে ভুগে থাকে, সেটি অতীতে অনেকবারই দেখা গেছে। তবে উপমহাদেশে তার রেকর্ড যেহেতু ভালো না, সেটা মাথায় রেখেই সে আসছে। সে দ্রুত ডাউন দ্য উইকেটে এসে খেলার চেষ্টা করে। এটার সুযোগ তাকে দেওয়া যাবে না।’
ম্যাট রেনশ
আন্তর্জাতিক ক্যারিয়ার শুরুই হয়েছে গত বছর নভেম্বরে। ব্রিটিশ পাসপোর্টধারী অস্ট্রেলিয়ার এই তরুণ ওপেনারের ব্যাটিংয়ের ধরন ওয়ার্নারের মতো বিধ্বংসী নয়। তবে ধৈর্যের প্রতিমূর্তি হয়ে যে লম্বা ইনিংস খেলতে পারেন, সেটির উজ্জ্বল উদাহরণ গত জানুয়ারিতে সিডনি টেস্টে পাকিস্তানের বিপক্ষে করা ১৮৪ রান। অথচ তাঁর পার্টনার ওয়ার্নার সেঞ্চুরির দেখা পেয়েছিলেন লাঞ্চের আগেই।
রেনশ স্পিনটা যে দারুণ খেলেন গত ভারত সফরে সেটা দেখা গেছে। ৮ ইনিংসের তিনবার তাঁর উইকেট পেয়েছেন ভারতীয় স্পিনাররা। পুনে টেস্টে ভারতের বিপক্ষে যে দুর্দান্ত জয় পেয়েছিল অস্ট্রেলিয়া, তাতে গুরুত্বপূর্ণ অবদান ছিল রেনশর। প্রথমবারের মতো উপমহাদেশে টেস্ট খেলতে নেমে খেলেছিলেন ৬৮ রানের অসাধারণ এক ইনিংস। ফিফটি করেছিলেন বেঙ্গালুরুতে পরের টেস্টেও। রাঁচিতে যে টেস্ট অস্ট্রেলিয়া ড্র করেছিল সেটির প্রথম ইনিংসে রেনশ খেলেছিলেন ৪৪ রানের আরেকটি ইনিংস। বাংলাদেশের বিপক্ষে নিশ্চয়ই ফিফটির ‘গেরো’ থেকে বেরোতে চাইবেন তরুণ ওপেনার।
রেনশর টেস্ট ক্যারিয়ার: | ||||
| ম্যাচ | গড় | ১০০ | ৫০ |
সামগ্রিক | ৮ | ৪২.০৭ | ১ | ৩ |
দেশে | ৪ | ৬৩.০০ | ১ | ১ |
বিদেশে | ৪ | ২৯.০০ | ০ | ২ |
এশিয়ায় | ৪ | ২৯.০০ | ০ | ২ |
২০১৭ সাল | ৫ | ৪৬.২২ | ১ | ২ |
শাহরিয়ারের চোখে রেনশ
‘তরুণ এই ওপেনার লড়াই করছে দলে জায়গা পোক্ত করতে। ভারতে সে বেশ কিছু ভালো ইনিংস খেলে গেছে। অস্ট্রেলিয়ান ওপেনারদের সাধারণত আমরা বিধ্বংসী ব্যাটিং করতে দেখি। রেনশ ঠিক ওই ধাঁচের নয়। হেইডেন বা ওয়ার্নারকে আমরা যেভাবে দেখেছি, রেনশর ব্যাটিং ঠিক ওই ধরনের নয়। প্রথাগত ব্যাটিংই সে করে। ভারতের বিপক্ষে দেখলাম তার পায়ের ব্যবহার ভালো। খুব পরিশ্রমী ক্রিকেটার। দাঁত কামড়ে উইকেটে থেকে রান করে। বাজে বল ছাড়া শট খেলে না। ওর উইকেটটা তুলে নিতে আমাদের পেসাররা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে। আমাদের উইকেট যেহেতু নিচু থাকে, ওর জন্য কষ্টই হবে রান তুলতে। টাইট লাইন-লেংথে বোলিং করলে ও অধৈর্য হয়ে উইকেট দিতে পারে।’
পিটার হ্যান্ডসকম্ব
গত নভেম্বরে টেস্ট অভিষেক হওয়া এই উইকেটকিপার ব্যাটসম্যান নিজেকে দারুণভাবে চিনিয়েছেন ঘরের মাঠে সর্বশেষ মৌসুমে। পাকিস্তানের বিপক্ষে সিরিজটা তো দুর্দান্ত গেছে তাঁর। ৩ ম্যাচে ৭১.২০ গড়ে ২ সেঞ্চুরি ও ১ ফিফটিতে করেছেন ৩৫৬ রান। পুরস্কার হিসেবে ছিলেন ভারত সফরেও। পুরো সফরে খুব যে ভালো ব্যাটিং করেছেন, তা নয়। তবে ভারত সফরটা হ্যান্ডসকম্বের কাছে স্মরণীয় হয়ে থাকবে রাঁচিতে খেলা ২০০ বলে ৭২ রানের ইনিংসের জন্য। যে ইনিংসটার সৌজন্যে অস্ট্রেলিয়া পেয়েছিল জয় সমতুল্য ড্র। তবে ইনিংসের পরও স্পিনের বিপক্ষে যে তিনি দুর্বল, সেটি ঢাকতে পারেননি হ্যান্ডসকম্ব। বাকি যে সাতটি ইনিংস খেলেছেন প্রতিটিতেই আউট হয়েছেন স্পিনারদের বলে।
হ্যান্ডসকম্বের টেস্ট ক্যারিয়ার: | ||||
| ম্যাচ | গড় | ১০০ | ৫০ |
সামগ্রিক | ৮ | ৫৪.২৭ | ২ | ৩ |
দেশে | ৪ | ৯৯.৭৫ | ২ | ২ |
বিদেশে | ৪ | ২৮.২৮ | ০ | ১ |
এশিয়ায় | ৪ | ২৮.২৮ | ০ | ১ |
২০১৭ সাল | ৫ | ৪৩.৫০ | ১ | ১ |
শাহরিয়ারের চোখে হ্যান্ডসকম্ব
‘দেশের মাঠে সর্বশেষ মৌসুমে দুর্দান্ত খেলেছে হ্যান্ডসকম্ব। ন্যাচারাল স্ট্রোকমেকার সে নয়। পরিশ্রম করে রান করে, দৃঢ়চেতা মানসিকতার ব্যাটসম্যান। টেকনিক্যালি স্পিনের বিপক্ষে খুব একটা ভালো নয়। ভারতের বিপক্ষে তাকে ভুগতে দেখা গেছে। পেস বোলিংয়েও তার ফুট মুভমেন্ট খুব যে ভালো, তা নয়। সামনের বল বা সুইং বোলিংয়ের বিপক্ষে তাকে ভুগতে দেখা গেছে। তবে শর্ট বলে খুবই ভালো। স্পিনারদের সুযোগ দিতে পারে, বাংলাদেশকে সেটা কাজে লাগাতে হবে। তাকে রান করতে দেওয়া যাবে না। রান না পেলে অধৈর্য হয়ে উইকেট দিয়ে দেবে। হ্যান্ডসকম্বের বিপক্ষে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে সাকিব-তাইজুল।’