টানা দুই টেস্টে বাংলাদেশের জন্য দুঃস্বপ্নের অন্য নাম কেশব মহারাজ
টানা দুই টেস্টে বাংলাদেশের জন্য দুঃস্বপ্নের অন্য নাম কেশব মহারাজ

উৎপল শুভ্রর লেখা

স্পিন–বিষে চিরকালই নীল বাংলাদেশ

বাংলাদেশের বিপক্ষে টেস্টে সেরা বোলিং কার?

—এক অফ স্পিনারের (৮/৪২)।

দ্বিতীয় সেরা বোলিং?

—এক লেগ স্পিনারের (৮/১০৮)।

তৃতীয় সেরা বোলিং?

—এক বাঁহাতি স্পিনারের (৭/৩২)।

কী বুঝলেন? বাংলাদেশের ব্যাটসম্যানদের দুর্বলতা নির্দিষ্ট কোনো স্পিনে নয়। এ ব্যাপারে তাঁরা সাম্যবাদে বিশ্বাসী। নইলে কি বাংলাদেশের বিপক্ষে সেরা বোলিংয়ের ‘টপ থ্রি’-তে তিন ধরনের স্পিনারেরই নাম থাকে!

এর মধ্যে দুটি তো একেবারেই সাম্প্রতিক ঘটনা।

৩২ রানে ৭ উইকেট গত সপ্তাহেই। ডারবান টেস্টে দক্ষিণ আফ্রিকান বাঁহাতি স্পিনার কেশব মহারাজের। বাংলাদেশের বিপক্ষে তৃতীয় সেরা বোলিংয়ের এই রেকর্ড পোর্ট এলিজাবেথে পরের টেস্টেই প্রায় ভেঙে দিয়েছিলেন মহারাজ। উইকেট ৭টিই নিয়েছেন, তবে বিনিময়মূল্য হিসেবে ৮টা রান বেশি দিয়ে দেওয়ায় তা আছে তালিকার ৪ নম্বরে।

বাংলাদেশের বিপক্ষে টেস্টে সেরা বোলিংয়ের রেকর্ড পাকিস্তানি অফ স্পিনার সাজিদ খানের

৪২ রানে ৮ উইকেট নিয়ে বাংলাদেশের বিপক্ষে সেরা বোলিংয়ের রেকর্ডটি যে অফ স্পিনারের, তাঁর নাম সাজিদ খান। উইকেট পাওয়ার আনন্দ উদ্‌যাপন করতে যাঁর ঊরুতে চাপড় মারার অভ্যাস। গত ডিসেম্বরে মিরপুরে সাজিদ খানের ঊরুতে এত চাপড় পড়েছে যে তা লাল হয়ে যাওয়ার কথা!

সমান ৮ উইকেট নিয়েও রান বেশি দেওয়ায় যে লেগ স্পিনার তালিকায় সাজিদ খানের পেছনে পড়ে গেছেন, তাঁর নাম স্টুয়ার্ট ম্যাকগিল। অস্ট্রেলিয়ান লেগ স্পিনারের এই কীর্তি ২০০৬ সালে ফতুল্লা টেস্টে।

সমান ৮ উইকেট নিয়েও রান বেশি দেওয়ায় অস্ট্রেলিয়ান লেগ স্পিনার স্টুয়া্র্ট ম্যাকগিল আছেন সাজিদ খানের পেছনে

দক্ষিণ আফ্রিকার বিপক্ষে টেস্ট সিরিজে বাংলাদেশের ব্যাটসম্যানদের স্পিন-বিষে নীল হয়ে যাওয়া দেখতে দেখতে একটু অতীতে ফিরে গিয়েছিলাম। বাহন অবশ্যই রেকর্ড। যা জানিয়ে দিচ্ছে, উপমহাদেশের ব্যাটসম্যানদের স্পিন খেলার দক্ষতা নিয়ে এত যে কথা, বাংলাদেশ সেখানে উল্টোরথের যাত্রী। বাংলাদেশের বিপক্ষে ইনিংসে ৭ বা এর বেশি উইকেট নেওয়ার ঘটনা আছে ৯টি। যার ৭টিই স্পিনারদের কীর্তি। তিনজনের নাম তো জেনেই গেছেন। বাকি চারজন দানিশ কানেরিয়া, রঙ্গনা হেরাথ, নাথান লায়ন...। একটু ভুল হয়ে গেছে, বাকি চারজন না, তিনজন হবে। কেশব মহারাজের নাম যে দুবার আছে এই তালিকায়। যে দুজন পেসার স্পিন–রাজত্বে একটু ‘অনাসৃষ্টি’র জন্ম দিয়েছেন, তাঁদের নাম ক্রিস কেয়ার্নস ও জহির খান।

বাংলাদেশের বিপক্ষে তৃতীয় ও চতুর্থ সেরা বোলিং কেশব মহারাজের

উপমহাদেশের ব্যাটসম্যানদের জন্য কঠিনতম পরীক্ষা বলে পেস আর বাউন্সের কথাই আলোচিত হয়েছে চিরদিন। বাংলাদেশের ব্যাটসম্যানরাও এই যুগলবন্দী পছন্দ করেন বলে দুর্নাম নেই। কিন্তু এখন তো মনে হচ্ছে, এই ক্ষেত্রে মিল থাকলেও বাংলাদেশ উপমহাদেশের দল হয়েও উপমহাদেশের নয়। স্পিন খেলে খেলে বড় হওয়ার পরও কোয়ালিটি স্পিন তাঁদের কাছে আরও বেশি দুর্বোধ্য। কেশব মহারাজ আর সাইমন হারমারের স্পিনে হাঁসফাঁস করার দৃশ্য চোখে ভাসছে বলে এ কথা বলছি না। রেকর্ডও আছে সমর্থন দিতে।

বাংলাদেশের বিপক্ষে টেস্টে প্রতিপক্ষ বোলাররা ইনিংসে ৫ উইকেট নিয়েছেন মোট ১১১ বার। পেসার আর স্পিনারে যেখানে প্রায় সমতা। পেসাররা ৫ উইকেট নিয়েছেন ৫৭ বার, স্পিনাররা ৫৪ বার। উপমহাদেশের মাঠে টেস্ট ম্যাচ হলে কখনো কখনো বোলিং আক্রমণে স্পিনাররা সংখ্যাগরিষ্ঠ হয়ে যান, তবে সার্বিক হিসাবে বোলারদের মধ্যে পেসারই তো বেশি থাকে। এই বিবেচনায় বাংলাদেশের বিপক্ষে ইনিংসে ৫ উইকেট নেওয়ায় পেসার-স্পিনারে প্রায় সমতা কী জানিয়ে দেয়? জানিয়ে দেয়, স্পিনটা বাংলাদেশের ব্যাটসম্যানরা মোটেই ভালো খেলেন না। দক্ষিণ আফ্রিকায় টানা দুই টেস্টে স্পিনে অসহায় আত্মসমর্পণ করার পর মুমিনুল হকও যা স্বীকার করতে বাধ্য হয়েছেন।

অসহায় আত্মসমর্পণেরও তো ধরন থাকে। ডারবানে বাংলাদেশের দ্বিতীয় ইনিংস স্থায়ী হয়েছিল মাত্র ১৯ ওভার, পোর্ট এলিজাবেথে সাড়ে ৪ ওভার বেশি। দক্ষিণ আফ্রিকার মাটিতে দুই স্পিনার বোলিং শুরু করছেন, এই দৃশ্যই অভাবিত ছিল। সেই দুই স্পিনার মুড়িমুড়কির মতো উইকেট তুলে নিয়ে আর কাউকে বোলিং করারই সুযোগ দিচ্ছেন না, এটাকে তাহলে কী বলবেন? টানা দুই টেস্টে এমন কিছু এর আগে দেখেনি টেস্ট ক্রিকেট।

স্পিনে বাংলাদেশের ব্যাটসম্যানদের অসহায়ত্বের ছবি ফুটে উঠেছে আরেকবার

দুজন বোলার বোলিং করেই ইনিংসের ১০ উইকেট তুলে নেওয়ার ঘটনা অনেকই আছে—নির্দিষ্ট করে বললে ২৯ বার। তবে হারমার-মহারাজ ছাড়া একাধিকবার তা করতে পেরেছে মাত্র একটা জোড়াই। অস্ট্রেলিয়ার পেস বোলিং চার্লি টার্নার ও জন ফেরিসের ওই কীর্তি টেস্ট ক্রিকেটের একেবারে শুরুর দিকে এবং তা টানা দুই টেস্টে নয়।

দক্ষিণ আফ্রিকার মাটিতে উপমহাদেশীয় কোনো দলের স্পিনে এমন নাস্তানাবুদ হওয়ার কারণে ব্যতিক্রমী হয়ে থাকবে এই সিরিজ। শুরুর আগে যা কারও কল্পনাতেও ছিল না। এমন বিপর্যস্ত বাংলাদেশও তো নয়। এর আগে দক্ষিণ আফ্রিকায় তিনটি সফরেই নিশ্চিত পরাজয় মেনে নিয়ে বিমানে উঠেছিল বাংলাদেশ দল। এবারই ছিল ব্যতিক্রম। নিউজিল্যান্ডের মাটিতে নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে টেস্ট জেতার স্মৃতি অনুপ্রেরণা হয়ে ছিল, দক্ষিণ আফ্রিকায় গিয়ে এর সঙ্গে যোগ হলো ওয়ানডে সিরিজে অবিস্মরণীয় জয়...আইপিএল দক্ষিণ আফ্রিকাকে হীনবল করে দেওয়ার পর তো ডারবান বা পোর্ট এলিজাবেথে মাউন্ট মঙ্গানুই ফিরে আসাকে খুবই বাস্তব সম্ভাবনা বলে মনে হচ্ছিল। ডারবান টেস্টের প্রথম চার দিনও তো অনুসরণ করেছিল অনুমিত সেই পাণ্ডুলিপিই। এরপর?

এরপর যা হলো, তাকে দুঃস্বপ্ন বলে। যে দুঃস্বপ্নের একটা অবয়বও আছে।

কেশব মহারাজ!