সিদ্ধান্ত গেছে তৃতীয় আম্পায়ারের কাছে। সিলেটের পাহাড়-গ্যালারির পাশে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে থাকা ডিজিটাল পর্দায় তখন সবার চোখ। ক্যারিবীয় ফিল্ডাররা সবাই গোল হয়ে দাঁড়িয়ে। উইকেটের অন্য পাশে তামিম ইকবাল ও সৌম্য সরকার। তামিমের একটা হাত সৌম্যের কাঁধে। বড় ভালো লাগল দৃশ্যটা! দলের সবচেয়ে সফল ব্যাটসম্যানটি যেন নির্ভরতার হাত বাড়িয়ে দিয়েছেন এমন একজনের কাঁধে, আগামীর নির্ভরতা হয়ে ওঠার সব সম্ভাবনা যাঁর মধ্যে। যেন বড় ভাইটি পরম মমতায় আগলে রাখছেন ছোট ভাইকে।
যে সময়ের ঘটনার কথা বলা হচ্ছে, ৩৫তম ওভারের তৃতীয় বল, বাংলাদেশের জয়ের জন্য দরকার ২৪ রান, সৌম্যের সেঞ্চুরির জন্য ২১। রিভিউ আবেদন সৌম্যের বিপক্ষেই। সৌম্য আম্পায়ার্স কলে বেঁচে গেলেন। বেঁচে থাকল তাঁর সেঞ্চুরির আশাও। আর এর কয় বল পরই তামিম জন্ম দিলেন দুটি ডট বল। অনেকের চোখ এড়িয়ে যাওয়া দুটি ডট!
গত এশিয়া কাপে তামিম ইকবালের ভাঙা এক হাত নিয়ে অন্য হাতে ব্যাটিং করার ছবিটা বাংলাদেশের ক্রিকেটীয় রূপকথার অংশ হয়ে থাকবে। সেবার তামিম দুটি বল ঠেকিয়ে বীরত্বের এক গল্পগাথার জন্ম দিয়েছিলেন। কাল হয়তো অনেকের চোখে পড়েনি। এশিয়া কাপের মতো অত বড় তাৎপর্যেরও হয়তো নয়; তবু তামিমের দুটি ডট বল খেলার মাহাত্ম্য অন্য রকম এক আবেদন তৈরি করে রাখল। সৌম্য সরকার তাঁর ক্যারিয়ারের সম্ভাবনার রেখাটিকে হতাশার কক্ষচ্যুতি থেকে ফিরিয়ে আনতে অনুপ্রেরণার উপাদান হিসেবে বারবার ফিরে তাকাতে পারেন এই দুই ডট বলে!
সৌম্য যখন কাল তিনে ব্যাট করতে নামেন, ততক্ষণে তামিমের রান হয়ে গেছে ২২। আয়ুরেখা ধরে ইনিংস যতটা হেঁটে গেছে, ততটাই ব্যবধান কমিয়েছেন সৌম্য। ৩১ ওভার শেষে দুজনেরই রান হয়ে গেল সমান—৬২! ওয়েস্ট ইন্ডিজকে মাত্র ১৯৮ রানে আটকে ফেলার উচ্ছ্বাসটা তখন কৃত্রিম হতাশায় রূপ নিল প্রেসবক্সে। এক সতীর্থ সাংবাদিক অনুযোগের সুরে কৌতুকটা করলেন, ধুর, ওয়েস্ট ইন্ডিজ আরও একটু বেশি রান করতে পারল না!
বাংলাদেশের জয়ের জন্য দরকার তখন ঠিক ৫০। হাতে ৯ উইকেট আর ১৯ ওভারের পর্যাপ্ত সময়। ক্রিকেটীয় অনিশ্চয়তার সূত্রও তখন ম্যাচের ফল নিয়ে টেনশন করতে দিচ্ছে না। তখন প্রশ্নটা হলো এই: দুজনের একজন কি সেঞ্চুরি পাবেন?
আগের ওভারেই তিন বলে দুটি বিশাল ছক্কা হাঁকিয়েছেন সৌম্য। তামিম এরপর এগিয়ে এসে সৌম্যকে কী যেন বললেন। প্রেসবক্সের কাচ ভেদ করে কর্ণকুহরে হয়তো সে কথা পৌঁছাল না। তবে হৃদয়ের তরঙ্গে ঠিকই পৌঁছে গেল সেই ডেসিবেল। তামিম সৌম্যকে বলছেন, তুই চেষ্টা কর, আমি আছি!
তামিম ততক্ষণে ব্যাক সিটে আসন নিয়েছেন। ফিফটির পর একটিও চার মারেননি। তবু ইনিংসের গতিময়তায় কিছু রান তো ওঠেই। সৌম্যকে আরও অভয়বার্তা দিতে তামিম সেই ৩৫তম ওভারের শেষ দুই বল খেললেন সোজা ডিফেন্সে। ইচ্ছে করেই!
কিন্তু হলো না। সৌম্য এরপর ইনিংসে আরও ১ রান যোগ করে সেঞ্চুরি থেকে ২০ রান দূরে থাকতেই ফিরে গেলেন। মেরে খেলতে গিয়েই আউট হয়েছেন। একটু হতাশা তো ভর করেই। সমান ৫টি করে চার-ছয়ে ৮১ বলে ৮০ রানের ইনিংস খেলে সৌম্য যখন ফিরছেন, ভরা গ্যালারির অভিবাদনবৃষ্টির মধ্যেও তাঁর হতাশাটা বোঝা গেল। এক পলকের জন্য তামিমের দিকে তাকাতেই মনে হলো, কিছুটা এলায়িত ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে থাকা তামিমই যেন সবচেয়ে হতাশ হয়েছেন!
কিন্তু কিছু কিছু গল্পের শেষটাই তার শীর্ষবিন্দু হয়তো নয়। যেমন কালকের এই গল্পটার, যে গল্প মমতার রাংতা কাগজে আরও আগেই তামিম মুড়িয়ে ফেলেছিলেন। অনুজের জন্য যখন ছেড়ে দিলেন নিজের সম্ভাবনা; বাংলাদেশ দলটাকে এ কারণেই কখনো কখনো দল মনে হয় না, মনে হয় একটা পরিবার।
অন্তত এই কারণে হলেও ভাবতে ইচ্ছে করছে, কাল ড্রেসিংরুমে সৌম্যকে সবচেয়ে বড় অভিবাদনটি জানিয়েছেন আগের সিরিজে তিন ওয়ানডেতে ৩৪৯ রান করেও বাদ পড়া ইমরুল কায়েস!