জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে সিরিজের শেষ ওয়ানডেতে মুগ্ধ করা এক ইনিংস খেলেছেন। তিন অঙ্ক ছুঁয়ে দিয়েছেন শূন্যে লাফ। অনেক দিন পর সৌম্য যেন ডানা মেলে ওড়ার সুযোগ পেয়েছেন। উদ্যাপনের সময় সৌম্য চুমু খান ডান হাতের কালো রিস্ট ব্যান্ডেও। এ চুমুর রহস্যটা কী?
ননিতা সরকার হঠাৎ লক্ষ্য করেন তাঁর ছেলে ইদানীং কালো রিস্ট ব্যান্ডটা পরে খেলেন না। ছেলেকে তাই প্রশ্নটা করে বসেন, ‘কী ব্যাপার, তুমি এখন আর কালো ব্যান্ড পরে খেলো না কেন?’
তাই তো! সৌম্য সরকারের মাথায় প্রশ্নটা ঘুরপাক খেতে থাকে। মা আদেশের সুরে বলেন, ‘পরের ম্যাচ থেকে কালো রিস্ট ব্যান্ডটা পরেই খেলবে।’
সৌম্যকে নিয়ে মায়ের অনেক চিন্তা। আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে কী দুর্দান্ত শুরুটা না হয়েছিল তাঁর ছেলেটার। মাঝে একটু খারাপ সময় গেছে, অমনি সমালোচকেরা ঝাঁপিয়ে পড়েছে তাঁর ছেলের ওপর। ননিতা সরকার ফেসবুক ব্যবহার করেন না। তবুও এ কান-ও কান হয়ে তাঁর কাছে খবর আসে। ফেসবুকে সৌম্যকে নিয়ে নানা আলোচনা-সমালোচনায় ননিতা সরকারের মনটা কালো মেঘে ঢেকে যায়। মন্দিরে যান, প্রার্থনা করেন, সৌম্য যেন রানে ফিরে আসেন। মনে অনেক সংস্কার কাজ করে তাঁর। তিনি খেয়াল করেছেন, ছেলে কালো ব্যান্ড পরলেই দুর্দান্ত খেলে। ২০১৫ সালে পাকিস্তানের বিপক্ষে অপরাজিত ১২৭ রান, দক্ষিণ আফ্রিকার বিপক্ষে ম্যাচ জেতানো দুটি ম্যাচে অসাধারণ খেলেছেন কালো রিস্ট ব্যান্ড পরেই।
ব্যান্ডটা পরলেই যে ব্যাট কথা বলবে, এমন নয়। তবু মায়ের মন বলে, সৌম্য রানে ফিরবে ওই ব্যান্ড পরলেই। ব্যান্ড নিয়ে মায়ের পরামর্শ শুনে সৌম্য হাসেন। তবে উড়িয়ে দেন না। বিষয়টা গুরুত্বের সঙ্গেই নেন। ঠিক করেন পরের ম্যাচ থেকেই মায়ের আদেশটা মানবেন। কিন্তু সেটি হয় না। ১৯ অক্টোবর তড়িঘড়ি করে বিকেএসপিতে জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে প্রস্তুতি ম্যাচ খেলতে নামায় বেমালুম ভুলে যান কালো ব্যান্ডটার কথা। কিন্তু অবচেতন মনে তিনি যেন সেটি পরেই খেলেন। জিম্বাবুইয়ের বিপক্ষে ধূসর বাদামি রাঙা ব্যান্ড পরে দ্যুতি ছড়ান, পেয়ে যান সেঞ্চুরির দেখা।
চট্টগ্রামে জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে সিরিজের শেষ ওয়ানডেতে যখন আকস্মিক সুযোগ পান দলে, সৌম্য এবার আর ভুল করেন না। মায়ের কথা মতো কালো ব্যান্ডটা পরে খেলতে নামেন। আর এ ম্যাচ দিয়ে অনেক দিন পর আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে আবির্ভূত হন চেনা রূপে। মুগ্ধ করা এক ইনিংস খেলেন। তিন অঙ্ক ছুঁয়ে দেন শূন্যে লাফ। অনেক দিন পর যেন সৌম্য ডানা মেলে ওড়ার সুযোগ পান। উদ্যাপনের সময় সৌম্য চুমু খান ডান হাতের কালো রিস্ট ব্যান্ডে। ওখানেই যে মায়ের আশীর্বাদ! ‘মা বলার পর ভাবলাম, তিনি যখন বললেন আবার পরে খেলব। হয়তো সংস্কার বলবেন, কিন্তু আমি এটিকে মায়ের আশীর্বাদ হিসেবে দেখছি’—বলছিলেন সৌম্য।
ননিতা সরকার ছেলের খেলা সাধারণত দেখেন না। তিনি তখন ব্যস্ত থাকেন পূজা-আর্চনায়। সৌম্যর বাবা কিশোরী মোহন সরকার সরকারি চাকুরে, কবিতাও লেখেন। তিনি অবশ্য কোনো সংস্কারে বিশ্বাসী নন। তবে ছেলের ইনিংসটা তাঁকেও স্বস্তি দিচ্ছে। কিশোরী মোহন একটু বিচলিত সৌম্যর দৌড়ঝাঁপ নিয়ে।
এই অভিজ্ঞতার মুখোমুখি সৌম্য গত কিছুদিনে বেশ কয়েকবার হয়েছেন। এশিয়া কাপের যে ১৬ জনের দলটা দেওয়া হয়েছিল, সেটিতে তিনি ছিলেন না। এশিয়া কাপের দলে না থাকা সৌম্য গেলেন খুলনায়, বিসিবির একটি চার দিনের ম্যাচ খেলতে। টুর্নামেন্টের মাঝে হুট করে সৌম্য খবর পেলেন ইমরুল কায়েসের সঙ্গে উড়ে যেতে হবে আরব আমিরাতে। এশিয়া কাপের পর জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে ওয়ানডে সিরিজে বিস্ময়ের সঙ্গে আবিষ্কার করলেন তিনি দলে নেই! জাতীয় লিগেই ব্যস্ত থাকতে হলো সৌম্যকে। জাতীয় লিগে দুর্দান্ত খেলা বাঁহাতি ব্যাটসম্যান হঠাৎ আবার ডাক পেলেন জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে প্রস্তুতি ম্যাচে। তড়িঘড়ি করে রাজশাহী থেকে চলে এলেন বিকেএসপিতে। করলেন দুর্দান্ত এক সেঞ্চুরি। সেঞ্চুরির পর আবার চলে গেলেন খুলনায়, ব্যস্ত হয়ে পড়লেন জাতীয় লিগের ম্যাচে। ম্যাচ চলার সময়ই খবর পেলেন খেলতে হবে জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে সিরিজের শেষ ওয়ানডে। আবারও তড়িঘড়ি করে উড়ে এলেন চট্টগ্রামে। জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে শেষ ম্যাচ খেলে সৌম্য আবার রওনা হয়েছেন বরিশালে জাতীয় লিগের ম্যাচ খেলতে। হঠাৎ যদি আবারও জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে টেস্ট সিরিজে ডাক পান, তাতে অবাক হওয়ার কিছু থাকবে না!
এত ভ্রমণেও সৌম্যকে ক্লান্ত স্পর্শ করে না। হারানো ছন্দ ফিরে পেয়েছেন, এটি ধরে রাখতে যত ত্যাগ স্বীকার করতে হয়, তিনি করবেন!