সেই তাঁরাই আবার অপরাজেয় বীর

>প্রভাত কি সব সময় দিনের সঠিক পূর্বাভাস দেয়? কখনো দেয়, কখনো দেয় না। ক্রিকেটও এমনই। দুঃস্বপ্নের মতো শুরুর পরও যেমন আলো ছড়ানোর গল্প আছে, তেমনি হইচই ফেলে দেওয়া আবির্ভাবের পর পথ হারিয়ে ফেলারও। এসব গল্প নিয়েই নতুন এই ধারাবাহিক শুরু করলেন উৎপল শুভ্র
আনোয়ার-আতাপাত্তু-গুচ: টেস্ট অভিষেকে ‘পেয়ার’ পেয়েছেন, পরে ব্যাট ক্যারিও করেছেন। ফাইল ছবি
আনোয়ার-আতাপাত্তু-গুচ: টেস্ট অভিষেকে ‘পেয়ার’ পেয়েছেন, পরে ব্যাট ক্যারিও করেছেন। ফাইল ছবি

আচ্ছা বলুন তো, একজন ওপেনারের আজন্ম আরাধ্য স্বপ্ন কী হতে পারে? অনেক রান, সেঞ্চুরি, ডাবল সেঞ্চুরি, ট্রিপল….। থামুন, থামুন, এই চাওয়া তো যেকোনো ব্যাটসম্যানের জন্যই সর্বজনীন, তাঁকে ওপেনারই হতে হবে কেন? ওপেনারের জন্য বিশেষায়িত চাওয়া হতে পারে একটাই—ইনিংসের আদ্যন্ত ব্যাটিং অর্থাৎ ইনিংস ওপেন করতে নেমে শেষ পর্যন্ত অপরাজিত থাকা। ক্রিকেটীয় পরিভাষায় যেটিকে বলে 'ক্যারিয়িং দ্য ব্যাট থ্রু আউট দ্য ইনিংস।'

এ এমন কীর্তি যে, তুমি যত বড় ব্যাটসম্যানই হও না কেন, এমনকি ব্র্যাডম্যান-রিচার্ডস হলেও কিছু আসে যায় না, ওপেনার ছাড়া আর কারও যা করার সুযোগ নেই। শুধু টেস্ট অভিষেকে জোড়া শূন্যতেই নয়; গ্রাহাম গুচ, সাঈদ আনোয়ার ও মারভান আতাপাত্তুর মিল আছে এখানেও। যাঁদের জন্য প্রথম টেস্টে ব্যাটিং ব্যাপারটা ছিল উইকেটে যাওয়া আর আসা, সেই তাঁরাই পরে ইনিংসের শুরু থেকে এক প্রান্তে অনড় দাঁড়িয়ে অন্য প্রান্তে বাকি দশ জন ব্যাটসম্যানকে আউট হতে দেখেছেন। মাঠ ছেড়ে বেরিয়ে এসেছেন অপরাজেয় বীরের বেশে।

তিনজনেরই মূল পরিচয় ওপেনার। তবে অভিষেক টেস্টে ওপেনিং করতে নেমেছিলেন শুধু সাঈদ আনোয়ার। গুচ ব্যাটিং করেছেন ৫ নম্বরে। আতাপাত্তু প্রথম ইনিংসে সাত নম্বরে ব্যাটিং করে শূন্য রানে আউট হওয়ার পরও দ্বিতীয় ইনিংসে এক ধাপ প্রমোশন পান। অভিষেক টেস্টে গুচ উইকেটে ছিলেন সাকল্যে আট মিনিট। প্রথম ইনিংসে তৃতীয় বলে আউট হওয়ার পর দ্বিতীয় ইনিংসে সামান্য 'উন্নতি' হয়েছিল। এবার আউট সপ্তম বলে। এই বিচারে সাঈদ আনোয়ারের 'অবনতি'-ই হয়েছিল বলতে হয়। প্রথম ইনিংসে পঞ্চম বলে কার্টলি অ্যামব্রোসের শিকার হওয়ার পর দ্বিতীয় ইনিংসে তৃতীয় বলেই তাঁকে তুলে নেন ইয়ান বিশপ। অভিষেকে আতাপাত্তুর জোড়া শুন্যের এমন বিস্তারিত জানাতে পারছি না। খুঁজতে গিয়ে একটু অবাকই হলাম, তাঁর বলের হিসাবটা কেন যেন রেকর্ড বইয়ে নেই।

তবে একটা লাভ হলো। সাঈদ আনোয়ার ও আতাপাত্তুর মধ্যে আগে চোখ এড়িয়ে যাওয়া আরেকটি কাকতালীয় মিল চোখে পড়ল। এই দুজনের টেস্ট অভিষেক হয়েছিল একই দিনে ---১৯৯০ সালের ২৩ নভেম্বর। আতাপাত্তু টেস্টে অবশ্য প্রথম ব্যাটিং করতে নামেন টেস্টের দ্বিতীয় দিনে। ততক্ষণে পরপর দুই দিনে দুই শূন্যতে সাঈদ আনোয়ারের 'পেয়ার' পাওয়া সারা!

ইনিংসের আদ্যন্ত ব্যাটিং করা এই তিনজনের তিনটি ইনিংসের মধ্যে সবচেয়ে বিখ্যাত গ্রাহাম গুচের অপরাজিত ১৫৪। ট্রিপল সেঞ্চুরির নাম সার্থক করা ৩৩৩ রানের ইনিংস আছে তাঁর, আছে একটি ডাবল সেঞ্চুরিও। তারপরও এই ১৫৪-ই তর্কযোগ্যভাবে টেস্টে গ্রাহাম গুচের সেরা ইনিংস। শুধু রান সংখ্যা দিয়ে তো আর সেরার বিচার হয় না। সাঈদ আনোয়ারের ক্ষেত্রে এই সমস্যা নেই। ব্যাট ক্যারি করা অপরাজিত ১৮৮ সন্দেহাতীতভাবে টেস্টে তাঁর সেরা ইনিংস, একই সঙ্গে সর্বোচ্চও। দুটি ইনিংসই আরেকটু বিস্তারিত বর্ণনা দাবি করে বলে আতাপাত্তুর অংশটুকু আগে শেষ করে নেওয়া ভালো। রানের হিসাবে তাঁর ইনিংসটাই সবচেয়ে বড়। তবে ১৯৯৯ সালে জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে বুলাওয়েতে অপরাজিত ২১৬ আতাপাত্তুর সেরা ইনিংস কি না, এটা নিয়ে সংশয় আছে। যদিও আদর্শ এক টেস্ট ইনিংসের সব উপাদানই ছিল এতে। উইকেটে প্রায় সাড়ে দশ ঘণ্টা কাটিয়ে ৪২৭ বলে ওই অপরাজিত ২১৬। শ্রীলঙ্কান ইনিংসে আর কেউ যেখানে হাফ সেঞ্চুরিও করতে পারেননি। দ্বিতীয় সর্বোচ্চ আতাপাত্তুর ওপেনিং পার্টনার সনাৎ জয়াসুরিয়ার ৪৯। উইজডেনের রিপোর্ট বলছে, হাফ সেঞ্চুরি করার পরই আম্পায়ারের সাড়া না পাওয়া জোরালো এলবিডব্লুর একটা আবেদন ছাড়া পুরো ইনিংসে আর কোনো সুযোগ দেননি আতাপাত্তু। সেটি যে ম্যাচ জেতাতে পারেনি, এটা আতাপাত্তুর দোষ নয়। দোষ বৃষ্টির, যা তৃতীয় দিনের প্রায় অর্ধেকটা খেয়ে ফেলার পর পঞ্চম দিনে আর খেলাই হতে দেয়নি।

গ্রাহাম গুচ ও সাঈদ আনোয়ারের ব্যাট ক্যারি করার ম্যাচে দল জিতেছে। সেই জয়ের সন্দেহাতীত নায়কও তাঁরা। ১৯৯১ সালে লিডসের হেডিংলিতে গুচের অপরাজিত ১৫৪ শুধু আধুনিক ক্রিকেটের এক ক্লাসিকই নয়, সর্বকালের সেরা টেস্ট ইনিংসের স্বীকৃতি পাওয়ার দৌড়েও থাকে। কারণটা বুঝতে সেই টেস্টে ওয়েস্ট ইন্ডিজের বোলিং আক্রমণের দিকে তাকালেই চলছে। ম্যালকম মার্শাল, প্যাট্রিক প্যাটারসন, কার্টলি অ্যামব্রোস ও কোর্টনি ওয়ালশের নিরবিচ্ছিন্ন আগুনে গোলার সামনে বুক চিতিয়ে লড়াইয়ের এক ডকুমেন্টারি গুচের ওই ইনিংস। সঙ্গে যোগ করুন হেডিংলির উইকেটের সে সময়কার চরিত্র। বল বাতাসে ইচ্ছামতো সুইং করে, উইকেটে পড়ার পরও নাচতে থাকে এদিক-ওদিক। সব মিলিয়ে হেডিংলি তখন ব্যাটসম্যানদের চরমতম পরীক্ষার নাম। সাধারণ বোলাররাও যেখানে অসাধারণ হয়ে উঠেন, সেখানে ওয়েস্ট ইন্ডিজের ভয়ঙ্কর ওই পেস চতুষ্টয়ের বিপক্ষে বলতে গেলে একাই লড়েছেন গুচ। ১২৪ রানে ৬ উইকেট পড়ে যাওয়ার পরও ইংল্যান্ডের ২৫২ তাঁর সৌজন্যেই। ইনিংসে দ্বিতীয় সর্বোচ্চ যেখানে মাত্র ২৭ (মার্ক রামপ্রকাশ ও ডেরেক প্রিঙ্গল)। দলের রানের ৬১.১১ শতাংশই গুচের ব্যাট থেকে। টেস্ট ক্রিকেটে ব্যাট ক্যারি করার যে ৫৬টি ঘটনা, তাতে দলের রানে এর চেয়ে বেশি অবদান নেই আর কারও (কাছাকাছি আছেন বীরেন্দর শেবাগ, ৬০.০৯ শতাংশ)।

গুচের এই কীর্তির মহিমা আরও বেড়ে যাচ্ছে সেটি ম্যাচের তৃতীয় ইনিংসে বলে। ২৭৮ রানের জয়ের লক্ষ্য নিয়ে নেমে ম্যালকম-ডিফ্রেটাস-ওয়াটকিন-প্রিঙ্গলের বোলিংয়েই ওয়েস্ট ইন্ডিজের ১৬২ রানে অলআউট হয়ে যাওয়া থেকেও আপনি কিছুটা বুঝে নিতে পারেন উইকেটের চরিত্র। সে সময় প্রায় অজেয় ওই ওয়েস্ট ইন্ডিজ দলের কারও জানাই ছিল না, ইংল্যান্ডের মাটিতে টেস্ট হারতে কেমন লাগে। সর্বশেষ এই ঘটনা ঘটেছিল যে ২২ বছর আগে্। প্রায় অসম্ভবকে সম্ভব করার মূলে গুচের ওই ইনিংস। ২০০১ সালে উইজডেন নানা হিসাব-নিকাশ করে টেস্ট ইতিহাসের সেরা ১০০ ইনিংসের যে তালিকা প্রকাশ করেছিল, তাতে যেটি ছিল তিন নম্বরে। এর উপরে শুধু ডন ব্র্যাডম্যানের ২৭০ (১৯৩৬-৩৭ সিরিজে ইংল্যান্ডের বিপক্ষে মেলবোর্নে) আর ব্রায়ান লারার অপরাজিত ১৫৩ (বিপক্ষ অস্ট্রেলিয়া, ব্রিজটাউন, ১৯৯৮-৯৯)। ২০১৮ সালে ইএসপিএন ক্রিকইনফোর এক পরিসংখ্যানবিদ তো আরও এক ধাপ এগিয়ে গিয়ে বোলিং আক্রমণ, উইকেট এবং ম্যাচের পরিস্থিতি বিবেচনায় এক নম্বরেই স্থান দিয়ে দেন এটিকে।

এই ইনিংস নিয়ে গুচের তাই গর্ব করাটাই স্বাভাবিক। যেমন স্বাভাবিক তিন বছর আগে এই ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিপক্ষেই আরেকটি ইনিংস নিয়ে আফসোস করাটাও। ১৯৮৮ সালে ওভালেও তাঁর সামনে ওয়েস্ট ইন্ডিজের প্রমত্ত চার ফাস্ট বোলার। পরের বারের চারজনের মধ্যে শুধু প্যাট্রিক প্যাটারসন ছিলেন না, মার্শাল-অ্যামব্রোস-ওয়ালশের সঙ্গে সেবার উইনস্টন বেঞ্জামিন। আবারও ম্যাচের তৃতীয়, আর ইংল্যান্ডের দ্বিতীয় ইনিংসের শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত উইকেটে গ্রাহাম গুচ। পার্থক্য বলতে, এবার আর অপরাজিত থেকে বেরিয়ে আসতে পারেননি। আউট হয়ে গেছেন শেষ ব্যাটসম্যান হিসাবে। নইলে একাধিকবার ব্যাট ক্যারি করা কীর্তিমানদের সংক্ষিপ্ত তালিকায় তাঁর নামটাও থাকত (যা পেরেছেন মাত্র ছয়জন)।

সাঈদ আনোয়ারের অপরাজিত ১৮৮-ও ম্যাচের তৃতীয় ইনিংসে। 'পেয়ার' দিয়ে শুরু আর সেঞ্চুরিতে শেষ টেস্ট ক্যারিয়ারের মতো এই টেস্টের দুই ইনিংসেও একই রকম বৈপরীত্য। প্রথম ইনিংসে আউট হয়েছিলেন শূন্য রানে। এটি কলকাতায় এশিয়ান টেস্ট চ্যাম্পিয়নশিপের সেই ম্যাচ, যেটির প্রথম দিন সকালে ২৬ রানে ৬ উইকেট হারিয়ে ফেলার পর পাকিস্তান জিতবে বলে কেউ কল্পনাও করেনি। অবিশ্বাস্য এক কামব্যাকের গল্প লেখা সেই জয়ে সবচেয়ে বড় অবদান অবশ্যই সাঈদ আনোয়ারের। যদিও পরপর দুই বলে দ্রাবিড় ও টেন্ডুলকারের স্টাম্প ছত্রখান করে তাঁর চেয়েও বেশি আলোচিত হয়ে উঠেন শোয়েব আখতার। ম্যাচে ১৩ (৫+৮) উইকেট নিয়ে জাভাগাল শ্রীনাথও কিছুটা আলো টেনে নেন নিজের দিকে। ভাগ বসান ম্যাচসেরার পুরস্কারেও। উইজডেন নির্বাচিত যে সেরা ১০০ টেস্ট ইনিংসের কথা বলছিলাম, সেই তালিকায় সাঈদ আনোয়ারের এই ইনিংসটিও আছে। গুচের মতো একেবারে উপরের দিকে নয়, তবে এত এত ইনিংসের ভিড়ে ৪৩ নম্বরে থাকতে পারাটাও কি কম নাকি!

ইনিংসের আদ্যন্ত ব্যাটিং করাটাকে বলেছিলাম একজন ওপেনারের আজন্ম আরাধ্য স্বপ্ন। তা টেস্ট অভিষেকেই যদি কারও এই স্বপ্ন পূরণ হয়ে যায়, তাহলে তো সেটিকে স্বপ্নের অভিষেক বলতেই হয়। মাত্র তিনজন ওপেনার পেয়েছেন এই অমৃতের স্বাদ। এঁদের মধ্যে সর্বশেষ যিনি, তিনি আবার বাংলাদেশের। সম্প্রতি দু:খজনক এক কারণে খবরে আসা জাভেদ ওমর। জাভেদের ব্যাটিংয়ের ধরনের সঙ্গে অবশ্য এই কীর্তিটা খুবই যায়। ধরে খেলার জন্য বলতে গেলে সারা জীবনই তো ওয়ানডে খেলার সময় 'টেস্ট ব্যাটসম্যান'-এর অপবাদ শুনে এসেছেন। পরিহাসই বলতে হবে, বাংলাদেশ যখন সত্যি সত্যি টেস্ট ম্যাচ খেলত নামল, তখন দেখা গেল, সেই জাভেদ ওমরই দলে নেই! বাংলাদেশের অভিষেক টেস্টে দর্শক হয়ে থাকার পর জাভেদের টেস্ট অভিষেক মাস পাঁচেক পর জিম্বাবুয়ে সফরে। বুলাওয়েতে দেশের বাইরে বাংলাদেশের প্রথম টেস্ট ম্যাচের দ্বিতীয় ইনিংসে ওপেন করতে নেমে শেষ পর্যন্ত ৮৫ রানে অপরাজিত জাভেদ। ইনিংস ব্যবধানে হারার পরও যাতে ছোট্ট একটা 'জয়' খুঁজে নিয়েছিল বাংলাদেশ। এতটাই যে, শেষ ব্যাটসম্যান মঞ্জুরুল ইসলাম ব্যাটিংয়ে নেমেছিলেন এক রকম আউট হয়ে 'নির্দেশ' নিয়েই! ২১ মিনিট টিকে থেকে টিম ম্যানেজমেন্টের বিস্তর বিরক্তির কারণও হয়েছিলেন। টেস্ট ক্রিকেটে এমন ঘটনা মনে হয় না আর ঘটেছে, যেখানে ইনিংস পরাজয় নিশ্চিত হওয়া শেষ উইকেটটি পড়ার পর বোলিং টিমের মতো ব্যাটিং টিমও উল্লাস করছে!

তা উল্লাস করার কারণ ছিল বৈকি! এমন এক কীর্তি গড়ে ফেলেছেন জাভেদ ওমর, যেটির সর্বশেষ উদাহরণ খুঁজতে পিছিয়ে যেতে হচ্ছে এক শ বছরেরও বেশি। জাভেদের আগে টেস্ট অভিষেকেই ব্যাট ক্যারি করেছেন শুধু অস্ট্রেলিয়ার জ্যাক ব্যারেট ও ইংল্যান্ডের স্যার পেলহাম ওয়ার্নার। ব্যারেট ১৮৯০ সালে, এর সাড়ে আট বছর পর ওয়ার্নার। জাভেদ ওমর ৪০টি টেস্ট খেলেছেন, খেলোয়াড়ি জীবন শেষে লেখক-সাংবাদিক-প্রশাসকের ভূমিকায় দেখা দিয়ে 'গ্র্যান্ড ওল্ড ম্যান অব ক্রিকেট' নামে পরিচিতি পেয়ে যাওয়া ওয়ার্নার ১৫টি। শুরুর সঙ্গে শেষ মেলেনি মনে করে এই দুজনের তাই খুব একটা আক্ষেপ থাকার কথা নয়। যা থাকতে পারত ব্যারেটের। তাঁরও নেই। অভিষেকে ৬৭ রানে অপরাজিত বার্নেট এরপর খেলেছেনই আর মাত্র একটি টেস্ট, তারপরও না। পেশায় ছিলেন ডাক্তার, সেটিতে আরও বেশি মন দিতে নিজেই দূরে সরিয়ে দিয়েছেন ক্রিকেটকে। ব্যারেটের মাত্র দুই টেস্টের ক্যারিয়ার ঘেঁটেই মজার একটা জিনিস পেলাম। লর্ডস আর ওভালে তাঁর দুটি টেস্ট ম্যাচেই প্রথম ইনিংসে ৪ নম্বরে ব্যাটিং করেছেন, দ্বিতীয় ইনিংসে ওপেনিং। দুই টেস্টেই জন লায়নস্ নামে এক ব্যাটসম্যানের সঙ্গে অদল-বদল হয়েছে ব্যাটিং অর্ডার। লর্ডসে ইংল্যান্ডের প্রথম ইনিংসে সর্বোচ্চ ৫৫ রান করার পরও দ্বিতীয় ইনিংসে ব্যারেটকে জায়গা দিতে চারে নেমে যেতে হয়েছে লায়নসকে। দ্বিতীয় ইনিংসে ব্যারেট ব্যাট ক্যারি করার পরও ওভালে পরের টেস্টের প্রথম ইনিংসে আবার তিনি চার নম্বরে, লায়নস ওপেনার। কী ভেবে এমন করা হয়েছিল, তা জানতে বড় কৌতুহল হয়।

জাভেদ ওমর: টেস্ট অভিষেকে শত বছরের পুরনো কীর্তির পুণরাবৃত্তি। ছবি: আইসিসি

ব্যাট ক্যারি করা নিয়ে এত কথা যখন হচ্ছেই, জাভেদ ওমর আরেকটু জায়গা দাবি করতেই পারেন। বুলাওয়ে টেস্টে ব্যাট ক্যারি করার আগে জিম্বাবুয়ের ওই সফরেই একবার এই কীর্তি গড়া হয়ে গেছে তাঁর। দ্বিতীয় ওয়ানডেতে শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত ব্যাট করে অপরাজিত ছিলেন ৩৩ রানে। রানটা এত কম হওয়ার কারণ, ৩০.৪ ওভারে মাত্র ১০৩ রানেই অলআউট হয়ে গিয়েছিল বাংলাদেশ। ওয়ানডেতে ব্যাট ক্যারি করতে পেরেছেন মাত্র ১২ জন ওপেনার। টেস্ট ও ওয়ানডে দুটিতেই তা পেরেছেন, এই হিসাব করলে সংখ্যাটা অর্ধেকে নেমে আসে। জাভেদ ওমর তাই গর্ব করতেই পারেন। তবে টেস্ট অভিষেকেই ব্যাট ক্যারি করা বলুন বা টেস্ট-ওয়ানডে দুটিরই যুগলবন্দি---জাভেদ ওমর এখানে একা নন। রেকর্ড বইয়ের একটা পাতা অবশ্য আছে, যেখানে শুধুই তিনি। যদিও সেটি গৌরব করার মতো কিছু নয়।

এই পুরো লেখাটাই যে ব্যাট ক্যারি করা নিয়ে হয়ে গেল, সেটির কারণ কী ছিল, মনে আছে? কারণ ছিল 'পেয়ার'। গুচ-আনোয়ার-আতাপাত্তু টেস্ট অভিষেকেই 'পেয়ার' পেয়েছেন, আবার ইনিংসের আদ্যন্ত ব্যাটিংও করেছেন, এটা দিয়েই তো কথা শুরু। ওই তিনজন পরে যা করেছেন, জাভেদ ওমর তা করেছেন শুরুতেই। ওই তিনজন শুরুতেই যে 'লজ্জা' পেয়েছিলেন, পরে জাভেদও সেটি পেয়েছেন। 'পেয়ার' পাওয়ার কথাই বলছি। জাভেদের 'পেয়ার' ২০০৭ সালে ভারতের বিপক্ষে। মিরপুর শেরেবাংলা স্টেডিয়ামে সেটি প্রথম টেস্ট ম্যাচ। দুই ইনিংসেই প্রথম বলে আউট হয়ে জাভেদের 'কিং পেয়ার'! তা টেস্ট ক্রিকেটে 'কিং পেয়ার' তো আরও অনেকেই পেয়েছেন, নির্দিষ্ট করে বললে আরও ২০ জন, যাঁদের মধ্যে শেবাগ-গিলক্রিস্টের মতো ব্যাটসম্যানও আছেন। তাহলে জাভেদ অনন্য কোথায়? দুই ইনিংসেই প্রথম বলে আউট হওয়ায়। দুবারই বোলার জহির খান। জাভেদ অবশ্য নিজেকে একটু দুর্ভাগা ভাবতেই পারেন, দ্বিতীয় ইনিংসে আউট তো আম্পায়ারের ভুলে। টিভি রিপ্লে পরিষ্কার বুঝিয়ে দিয়েছে, উইকেটকিপার ধোনির গ্লাভসে যাওয়ার আগে জাভেদের ব্যাটের সঙ্গে বলের কোনো সংস্পর্শ ঘটেনি। তখন তো আর ডিআরএস ছিল না।

লেখাটা এবার শেষ করে আনা উচিত। তার আগে টেস্ট ক্রিকেটে মাত্র যে ছয়জন ব্যাটসম্যান একাধিকবার ব্যাট ক্যারি করেছেন, তাঁদের নামগুলো কি জানিয়ে দেব? দুবার করে তা করেছেন অস্ট্রেলিয়ার বিল উডফুল ও বিল লরি, ইংল্যান্ডের লেন হাটন এবং নিউজিল্যান্ডের গ্লেন টার্নার। বিশ্ব রেকর্ডটা হলো তিনবার। ১৯৯৩ সালে যে রেকর্ড গড়ার পর ২০১৮ সালের মার্চ পর্যন্ত এটির একক অধীশ্বর হয়ে ছিলেন ওয়েস্ট ইন্ডিজ ডেসমন্ড হেইন্স। জানা থাকলে তো কথাই নেই, জানা না থাকলেও নিশ্চয়ই অনুমান করতে পারছেন, এরপর কেউ সেই রেকর্ডে ভাগ বসিয়েছে। নামটাও কি আপনার জানা? জানা থাকলে ভালো, নইলে অনুমান করতে পারবেন বলে মনে হয় না। এত সব বিখ্যাত ওপেনার দেখেছে ক্রিকেট, অথচ হেইন্সের রেকর্ড ছুঁয়েছেন কিনা এমন একজন, ওপেনার হিসাবে যাঁকে নিয়ে কেউ কখনো উচ্ছ্বসিত হয়েছেন বলে জানা নেই। ডিন এলগার! অথচ শুধু এই রেকর্ডের আলোকে বিচার করলে হেইন্সও যাঁর কাছে ম্লান। যে কীর্তি গড়তে ১০৯ টেস্ট লেগেছিল হেইন্সের, ৪৮তম টেস্টেই সেটি ছুঁয়ে ফেলেছেন এলগার। সর্বশেষ দুবারের কীর্তি তো মাত্র চার টেস্টের মধ্যে। সময় হিসাব করলে দুই মাসেরও কম। ২০১৮ সালের শুরুতেই ওই যুগল কীর্তি। টেস্টে একাধিকবার ব্যাট ক্যারি করেছেন আর যে পাঁচ ওপেনার, তাঁদের কেউই একই বছরে বা একই মৌসুমে দুবার তা করতে পারেননি।

এলগার না হয় অদৃষ্টপূর্ব কিছুই করেছেন। কিন্তু 'এমন একটা শুরুর পর...' ধারাবাহিকে আমাদের বিষয় তো শুরু আর শেষের বৈপরীত্য, সেখানে ডিন এলগার আসেন কীভাবে? ভালোভাবেই আসেন। সবচেয়ে বেশিবার ব্যাট ক্যারি করার রেকর্ড যাঁর, সেই এলগারের টেস্ট ক্যারিয়ারের শুরুটাও যে গুচ-আনোয়ার-আতাপাত্তুর মতোই জোড়া শূন্য দিয়ে! গুচ, আনোয়ার, আতাপাত্তু আর এলগার তাই এমন একটি ক্লাব গড়েছেন, যেটির সদস্য শুধুই তাঁরা চারজন।

বিশ্ব রেকর্ডে ডেসমন্ড হেইন্সের পাশে লেখা আছে তাঁরও নাম। ছবি: আইসিসি

অভিষেক টেস্টে 'পেয়ার' পেলে কেমন লাগে--এটা আপনি অনেকের কাছেই জানতে চাইতে পারেন। ব্যাট ক্যারি করার আনন্দটা কেমন, সেটিও। কিন্তু পুরো বিপরীত এই দুই অনুভূতি যদি একজনের মুখ থেকেই শুনতে চান, আপনাকে তা বলতে পারবেন শুধু এই চারজনই!