সবকিছুর শুরু চট্টগ্রাম থেকে। ২০১৮ সালের ২২ নভেম্বর ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিপক্ষে জহুর আহমেদ চৌধুরী স্টেডিয়ামে টেস্ট ক্যাপ পেয়ে যান ১৭ বছর বয়সী চট্টগ্রামের ছেলে নাঈম হাসান। দীর্ঘদেহী, হাই আর্ম অ্যাকশন—এই দুইয়ের কারণে অন্যান্য অফ স্পিনারদের তুলনায় নাঈম বাড়তি বাউন্স পেতেন। হাস্যোজ্জ্বল এই তরুণ স্পিনারকে পছন্দ হওয়ার জন্য এসব কারণই যথেষ্ট ছিল। এরপর টেস্ট ক্রিকেটে দ্বিতীয় দিনের পদচারণই যখন অলংকৃত হয় সর্বকনিষ্ঠ বোলার হিসেবে পাঁচ উইকেট নেওয়ার মতো রেকর্ড গড়ে, তাহলে তো কথাই নেই।
নাঈম এখন ২২। টেস্ট ইতিহাসে সর্বকনিষ্ঠ ৫ উইকেট শিকারের রেকর্ডটি এখনো নাঈমেরই দখলে। কিন্তু প্রথম টেস্টের পর সৃষ্ট সেই প্রত্যাশা গত চার বছরে মেটানোর সুযোগ পাননি এই তরুণ। ক্যারিয়ারের প্রথম চার বছরে নাঈম টেস্ট খেলেছেন মাত্র সাতটি। অফ স্পিনার বলেই টেস্ট দলে তাঁর সুযোগ পাওয়া একটু কঠিন। অভিজ্ঞতায় মেহেদী হাসান মিরাজ যেমন নাঈমের থেকে এগিয়ে, ব্যাটিং দক্ষতায়ও। তাই টেস্ট দলের সফরসঙ্গী হয়েই বেশি সময় কেটেছে নাঈমের।
এর মধ্যেই করোনাভাইরাসের অপ্রত্যাশিত বিরতি। নাঈমের উড়তে থাকা ক্যারিয়ারে তখন পায়ে বেড়ি। অনুশীলনের সুযোগ নেই, খেলা তো বন্ধই। করোনার ওই সময় তাই বাড়ির পাশেই নিজ হাতে উইকেট তৈরি করে বোলিং চালু রাখেন নাঈম। কিন্তু কী দুর্ভাগ্য, খেলা যখন শুরু হলো, তখন চোট এসে দিল হানা।
নাঈমের দুর্ভাগ্যের পথযাত্রার শুরু সেখান থেকেই। একই সময় আঙুলের চোট পেয়েছিলেন মুমিনুল হক। টেস্ট অধিনায়কের চোট সারাতে তাঁকে দুবাইয়ে পাঠানো হয়। কিন্তু ডান হাতের স্পিনিং ফিঙ্গারের সেই চোটের চিকিৎসা বাংলাদেশের এক হাসপাতালে করিয়ে নাঈমের বড় ক্ষতিই করে ফেলে বিসিবি। অস্ত্রোপচারের পরও নাঈমের আঙুলের চিড় সাড়েনি।
তত দিনে (২০২১) বাংলাদেশ সফরে এসে গেছে ওয়েস্ট ইন্ডিজ দল। ২০১৮ সালের মতো আবারও স্পিন দিয়ে ক্যারিবীয়দের ধসিয়ে দিতে চেয়েছিলেন। কিন্তু নাঈমের আঙুল তো আগের মতো নেই। ভারী ব্যান্ডেজে মোড়ানো আঙুল দিয়ে তিনি বোলিং করে গেলেও ভেতরে-ভেতরে চোটের যন্ত্রণা ভুগছিলেন।
করোনার দুই বছরের বিরতি, নিজের ঘরের মাঠ সেই চট্টগ্রামে চেনা প্রতিপক্ষ ক্যারিবীয়দের বিপক্ষে খেলা—নানা কারণে চোটকে জয় করার মিশনে নামেন নাঈম। কিন্তু দুই ইনিংস মিলিয়ে ৫০.২ ওভার করে মাত্র ৩ উইকেট নিতে পেরেছেন নাঈম। সেই ফ্লাইট, বাউন্স, বাঁক—কিছুই ছিল না তরুণ এই অফ স্পিনারের বোলিংয়ে। চতুর্থ ইনিংসে ৩৯৫ রানের বিরাট রান পেয়েও ম্যাচ শেষ করতে পারেননি।
চট্টগ্রামের সেই ব্যর্থতা ঢাকায়ও বয়ে বেড়িয়েছেন নাঈম। দুই ইনিংস মিলিয়ে ৩৯ ওভার করে উইকেট নিয়েছেন মাত্র ৩টি। দলের বাকি স্পিনারদের তুলনায় একেবারেই খারাপ ছিল না। তবু সিরিজ শেষে খড়্গটা যায় নাঈমের ওপর দিয়েই। অথচ বিসিবির মেডিকেল বিভাগের সঠিক পরিচর্যা পেলে হয়তো গল্পটা ভিন্ন হতেও পারত।
নাঈমকে অবশ্য অনুপ্রাণিত করে রাখতেন স্পিন বোলিং কোচ রঙ্গনা হেরাথ। ৪৩৩ টেস্ট উইকেট নেওয়া ইতিহাসের সেরা বাঁহাতি স্পিনার হেরাথের ক্যারিয়ারের প্রথম এক দশক কেটেছে মুত্তিয়া মুরলিধরনের ছায়ায়। ছাত্রকে সেই গল্পই শোনাতেন তিনি। সে কারণেই কিনা জাতীয় দলে মিরাজ নিয়মিত খেলে গেলেও নাঈমের নাম বরাবরই জাতীয় লিগ ও বাংলাদেশ ক্রিকেট লিগের সেরা উইকেটশিকারির তালিকায় শীর্ষেই থাকত। নাঈমও একটি সুযোগের অপেক্ষায় ছিলেন।
সেটি এল মিরাজের অপ্রত্যাশিত আঙুলের চোটে। শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে চট্টগ্রাম টেস্টের দলে ডাক পেয়েছেন নাঈম। যে মাঠ থেকে উত্থান ও পতন, সেখানেই এল নব উন্মেষের সুযোগ। আজ জহুর আহমেদ চৌধুরী স্টেডিয়ামে টেস্ট দলের অনুশীলনের একফাঁকে ফেরার অনুভূতি জানতে চাইলে প্রথমে একচিলতে হাসি দিলেন নাঈম। এরপর তাঁর ছোট্ট উত্তর, ‘ভালো লাগছে। আবার সুযোগ পেয়েছি, আলহামদুলিল্লাহ। বড় ভাইদের সঙ্গে ড্রেসিংরুম ভাগাভাগি করতে খুব ভালো লাগে। ওদের থেকে অনেক কিছু শেখা যায়।’
কথাটা শেষ হলো আরও একটি হাসি দিয়ে। হয়তো ওই মুহূর্তে গত দেড় বছরের উত্থান–পতনের যাত্রা একবার স্মরণ করলেন নাঈম। ১৫ মে শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে চট্টগ্রাম টেস্টের একাদশে থাকলে হয়তো নাঈমের হাসিটা হয়তো আরও চওড়া হবে।