দুর্দান্ত ইনিংস খেলেছেন ওয়াশিংটন সুন্দর।
দুর্দান্ত ইনিংস খেলেছেন ওয়াশিংটন সুন্দর।

সুন্দরের ইনিংসে তবু অসুন্দর খুঁজে পাচ্ছেন তাঁর বাবা

পুরো ক্রিকেট বিশ্ব প্রশংসা করছে তাঁর ইনিংসের। বিশ্লেষক, সাবেক-বর্তমান ক্রিকেটার, সতীর্থ-প্রতিপক্ষ...ওয়াশিংটন সুন্দরের ইনিংসের প্রশংসা চারদিকেই চলছে। কিন্তু নিজ ঘরেই বুঝি প্রাপ্য প্রশংসাটা পাচ্ছেন না ভারতীয় অলরাউন্ডার।

ব্রিসবেনে আজ ভারতের ব্যাটিং মানেই ওয়াশিংটন সুন্দর আর শার্দুল ঠাকুরের কীর্তি। ১৮৬ রানে ৬ উইকেট হারানো ভারত যে প্রথম ইনিংসে শেষ পর্যন্ত ৩৩৬ রান করতে পেরেছে, অস্ট্রেলিয়ার প্রথম ইনিংসে ৩৬৯ রানের কাছে যেতে পেরেছে, সে তো এই দুজনের দুর্দান্ত দুটি ফিফটির সৌজন্যেই!

ভারতের ইনিংসে আর কোনো ফিফটি নেই, রোহিত শর্মা-চেতেশ্বর পূজারার মতো ব্যাটসম্যানরা শুরুটাকে বড় করতে পারেননি, সেখানে শার্দুল করেছেন ১১৫ বলে ৬৭ আর সুন্দর খেলেছেন ১৪৪ বলে ৬২ রানের ইনিংস।

সপ্তম উইকেটে দুজনে গড়েছেন ১২৩ রানের জুটি। শার্দুল ফিরে গেলেও সুন্দর টিকে ছিলেন আরও কিছুক্ষণ, আউট হয়েছেন নবম ব্যাটসম্যান হিসেবে। আরও আশ্চর্য এটি যে এই টেস্টেই লাল বলের ক্রিকেটে অভিষেক হয়েছে সুন্দরের। কিন্তু এত দারুণ ইনিংসের পরও নিজের বাবারই প্রশংসাটা বুঝি ঠিকভাবে পেলেন না সুন্দর!

সেখানে একটু পিতৃসুলভ শাসন আছে, সুন্দরের ইনিংসের অসুন্দর একটা দিক খুঁজে বের করেছেন তাঁর বাবা এম সুন্দর। সেটি এই—ছেলের এত দারুণ ইনিংসের সমাপ্তি কেন সেঞ্চুরিতে হলো না!

‘ও ১০০ করতে না পারায় আমি হতাশ। সিরাজ (ভারতের দশম ব্যাটসম্যান মোহাম্মদ সিরাজ) যখন ক্রিজে এল, ও চাইলে তখন চার-ছক্কা মেরে খেলতে পারত। সেটা করার সামর্থ্য ওর আছে। ছক্কা মারার চেষ্টা করা উচিত ছিল ওর। পুল, বড় শট খেলার চেষ্টা করা উচিত ছিল’, চেন্নাই থেকে ভারতীয় সংবাদ সংস্থা আইএএনএসকে বলেছেন এম সুন্দর।

বাবার সঙ্গে ওয়াশিংটন সুন্দর।

আর এক উইকেট পড়লে দলের শেষ ব্যাটসম্যান টি নটরাজন আসবেন ক্রিজে, ওই অবস্থায়ও ছেলে কেন হাত খুলে মারেননি, সেটার একটা ব্যাখ্যাও অবশ্য বের করেছেন সুন্দরের বাবা, ‘হয়তো ও তখন অস্ট্রেলিয়ার স্কোরের আরও কাছে যাওয়ার কথা ভাবছিল। কারণ, (অস্ট্রেলিয়ার) লিড তখন অনেক কমে এসেছিল।’

সেঞ্চুরি না পাওয়ায় ছেলের ওপর একটু নাখোশ। ছেলে সেঞ্চুরি পেলে যে গর্বটা সবচেয়ে বেশি তাঁরই হতো! তবে সুন্দরের এত দারুণ ব্যাটিংয়ে খুশিও কম নন সুন্দর সিনিয়র। খুশি ছেলে নিজের কথা রাখায়ও, ‘অস্ট্রেলিয়ায় ওর সঙ্গে প্রতিদিন আমার কথা হয়। গতকাল সন্ধ্যায়ই ওকে বলছিলাম, যখনই ব্যাটিংয়ের সুযোগ পাবে, বড় স্কোর করে আসবে। ও বলেছিল, “অবশ্যই করব।”’


অবশ্য সুন্দর সেঞ্চুরি না পাওয়ায় তাঁর বাবার হতাশ হওয়ার কারণও আছে। এই টেস্টে ভারত দলে লোয়ার অর্ডার ব্যাটসম্যান হিসেবে সুযোগ পেলেও সুন্দরের যে টপ অর্ডারেও ব্যাটিং করার অভিজ্ঞতা আছে!

২০১৬-১৭ রঞ্জি ট্রফিতে তামিলনাড়ুর হয়ে অভিষেক ম্যাচে লাহলিতে মুম্বাইয়ের বিপক্ষে ওপেনার হিসেবে খেলেছিলেন সুন্দর। লাহলির পিচ সবুজ, ফাস্ট বোলারদের জন্য সহায়ক। সেই পিচেই অভিনব মুকুন্দের সঙ্গে মিলে ওপেনিং জুটিতে ১০৭ রান এনে দিয়েছিলেন সুন্দর। ত্রিপুরার বিপক্ষে ওপেনিংয়ে নেমে ১৫৬ রানের ইনিংসও খেলেছিলেন। সুন্দর যে গত তিন বছরে তামিলনাড়ুর রঞ্জি দলে সুযোগ পাননি, এটাই বিস্ময়ের বলে লিখছে ভারতীয় সংবাদমাধ্যম।

গ্যাবাতে আজ ২১ বছর বয়সী সুন্দর দারুণ আরেকটা কীর্তিও গড়েছেন। অভিষেকে ইনিংসে ফিফটি ও তিন উইকেট নেওয়া তৃতীয় ভারতীয় ক্রিকেটার হয়েছেন এই অফ স্পিনার ও বাঁহাতি ব্যাটসম্যান। তবে তাঁর এমন অলরাউন্ড ক্ষমতার কথা আগেই জানা গিয়েছিল।

২০১৭ সালে দুলীপ ট্রফির ফাইনালে তাঁকে ডাকা হয়েছিল। সেই ম্যাচে ১১ উইকেটের (৫/৯৪ ও ৬/৮৭) পাশাপাশি ১৩০ রানও করেছিলেন সুন্দর। প্রথম ইনিংসে করেছিলেন ৮৮ রান, দ্বিতীয় ইনিংসে ৪২। তাঁর অলরাউন্ড পারফরম্যান্সেই সেই ম্যাচে ভারতের নীল দলকে হারিয়েছিল ভারত লাল দল। নীল দলে সে সময় ছিলেন সুরেশ রায়না, ইশান্ত শর্মা, জয়দেব উনাদকটের মতো ক্রিকেটাররা।

‘দুলীপ ট্রফিতে ওই পারফরম্যান্সের পর আমরা সবাই ভেবেছিলাম, ও টেস্ট দলে জায়গা পাবে। কিন্তু ওকে ডাকা হয়নি। আমরা সবাই তখন হতাশ হয়েছিলাম’, বলছিলেন সুন্দরের বাবা এম সুন্দর।

সুন্দর-শার্দুলের জুটিতে লড়াই করেছে ভারত।

১৫ বছর বয়স থেকেই অবশ্য আলোচনায় ছিলেন সুন্দর। সে সময়ই ভারতের জাতীয় ক্রিকেট একাডেমিতে (এনসিএ) অনূর্ধ্ব-১৯ দলে ছিলেন তিনি, ডাক পেয়েছিলেন কর্নাটক রাজ্য ক্রিকেট অ্যাসোসিয়েশনের (কেএসসিএ) টুর্নামেন্টে এনসিএর সিনিয়রদের দলেও। প্রথম দুই ম্যাচে সুযোগ পাননি, তবে পরের তিন ম্যাচেই চমক দেখিয়েছেন সুন্দর। মুম্বাইয়ের বিপক্ষে ১০০ রান, পরের ম্যাচে ৮৬, এরপর ফাইনালে হরিয়ানার বিপক্ষে ১৫৯! এই তিনটি স্কোরই এসেছে ওপেনিংয়ে নেমে।

‘ও সহজাত ওপেনিং ব্যাটসম্যান। নতুন বলে অনেক রানও করেছে। চেন্নাইয়ের প্রথম বিভাগে সেঞ্চুরি করা সবচেয়ে কনিষ্ঠ ব্যাটসম্যান ও। ১৪ বছর বয়সে ও ওপেনিংয়ে নেমে সেঞ্চুরি করেছে’, ছেলের কীর্তির কথা গর্ব নিয়ে বলছিলেন বাবা এম সুন্দর।

ওয়াশিংটনের বাবা এম সুন্দরও অবশ্য ক্রিকেটার ছিলেন। তামিলনাড়ুর রঞ্জি ট্রফির রিজার্ভ দলে জায়গা পেয়েছিলেন। ছেলের নাম ‘ওয়াশিংটন’ রাখার পেছনেও জড়িয়ে বাবার ক্রিকেট ক্যারিয়ার। গল্পটা বলছিলেন সুন্দর সিনিয়র, ‘আমার ক্রিকেট কোচের নাম ছিল পি ডি ওয়াশিংটন। ক্যারিয়ারে অনেক সাহায্য করেছেন তিনি আমাকে। সেটার কৃতজ্ঞতাবশতই আমি আমার ছেলের নাম তাঁর নামে রেখেছি।’

এম সুন্দর নিজে ক্রিকেটে নাম করতে পারেননি, তবে ছেলের মধ্যে স্বপ্নটা ঠিকই বুনে দিতে পেরেছিলেন। মেয়ের মধ্যেও। তাঁর মেয়েও তামিলনাড়ুর হয়ে ৪২টি প্রথম শ্রেণির ম্যাচ খেলে ফেলেছেন।