মুশফিকের ব্যাটসম্যানশিপের প্রতিদ্বন্দ্বী এদিন তামিম ইকবালের দুর্জয় সাহস। হাতে চোট পেয়ে বেরিয়ে যাওয়ার আগে ৩ বলে ২ রান। ইনিংসের শেষ দিকে আবার নামার পর একটি বলই খেললেন। নিষ্ফলা একটি বল। ওই একটা বলেই তামিম ইকবাল উদ্ভাসিত অন্য রকম এক আলোয়। সাহসের আলো।
প্রশ্নটা নির্ঘাত অদ্ভুত শোনাবে। তারপরও সেটি করার লোভ যে সামলানো যাচ্ছে না!
১৫০ বলে ১৪৪ রান, না ৪ বলে অপরাজিত ২ রান—কোনটি সেরা?
কাল এশিয়া কাপের উদ্বোধনী ম্যাচটি দেখেননি, এমন কারও জন্য প্রশ্নটা বিষম এক ধাঁধা হতে বাধ্য। ১৪২ রানের পার্থক্য এমন দুটি ইনিংসের মধ্যে তুলনার প্রশ্নই-বা আসে কীভাবে!
কিন্তু যাঁরা দেখেছেন? দুবাইয়ে মাঠে বসেই হোক বা হোক টেলিভিশনের পর্দায়, শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে বাংলাদেশের ম্যাচটি যাঁরা দেখেছেন, তাঁরা এই তুলনার অন্তর্নিহিত অর্থটা বুঝবেন। কখনো কখনো বল আর রানের হিসাব ছাপিয়ে ব্যাটিং কেমন বৃহত্তর অর্থ নিয়ে দেখা দেয়, তাঁদের যে এটাও বোঝা হয়ে গেছে।
ওই বৃহত্তর অর্থের কারণেই মুশফিকুর রহিমের মহাকাব্যিক ব্যাটিংয়ের প্রতিদ্বন্দ্বী হয়ে যাচ্ছে তামিম ইকবালের ক্যারিয়ারের সবচেয়ে সংক্ষিপ্ত ইনিংসগুলোর একটি। না, তাঁর ব্যাটিং নয়। ব্যাটিং আর কোথায় করলেন তামিম! ব্যাটিং নয়, মুশফিকের ব্যাটসম্যানশিপের প্রতিদ্বন্দ্বী এদিন তামিম ইকবালের দুর্জয় সাহস। হাতে চোট পেয়ে বেরিয়ে যাওয়ার আগে ৩ বলে ২ রান। ইনিংসের শেষ দিকে আবার নামার পর একটি বলই খেললেন। নিষ্ফলা একটি বল।
ওই একটা বলেই তামিম ইকবাল উদ্ভাসিত অন্য রকম এক আলোয়। সাহসের আলো। দলের জন্য আত্মনিবেদনের আলো। সেই আলো নিজের ব্যক্তিগত দুঃখ ভুলে গিয়ে বাকিদের জন্য প্রেরণা হয়ে ওঠার। ঘণ্টা দুয়েক আগে জেনেছেন, শুরু হতে না হতেই শেষ হয়ে গেছে তাঁর এশিয়া কাপ। দেড় মাস মাঠের বাইরে থাকতে হবে। কে জানে, হয়তো তার চেয়েও বেশি! এসব হাড়ের চিড় কখনো কখনো ধারণার চেয়ে বেশি ভোগায়।
সেই হতাশা বুকে চেপে রেখে তামিম আবার ব্যাটিং করতে নামলেন। মুশফিকের ব্যাটে যেন ইচ্ছাদেবী ভর করেছে এদিন আর সঙ্গীর অভাবে থেমে যেতে হবে তাঁকে! তামিম না নেমে পারলেন না। আহত বাঁ হাতের গ্লাভস থেকে আঙুল বেরিয়ে আছে। সেই হাতটা এমনভাবে রাখতে হচ্ছে, যেন সেটি অদৃশ্য স্লিংয়ে ঝোলানো। শুধু ডান হাতটাই ভরসা। যেটিতে চোট আর সেই চোটের কারণে খেলা নিয়ে সংশয় সঙ্গী করেই গিয়েছিলেন সংযুক্ত আরব আমিরাতে। একটা বলই খেললেন। কিন্তু তাঁর কারণেই যোগ হলো আরও ৩২ রান। মুশফিকের ব্যাটে চমকাল বিদ্যুৎ।
শেষ পর্যন্ত ম্যাচটা এমন একপেশে হয়েছে বলে তামিমের কারণে যোগ হওয়া ওই ৩২ রান খুব বেশি তাৎপর্যপূর্ণ মনে না-ও হতে পারে। তবে ম্যাচে বাংলাদেশের জন্য উজ্জ্বলতম ওই অধ্যায়টুকুর মূল্য কি আর শুধু রান দিয়ে বোঝা যায়! তামিমের ওই বীরত্ব তাঁর সতীর্থদের রক্তে যদি টগবগে ঘোড়া না ছুটিয়ে থাকে, তাহলে বুঝতে হবে, তাঁরা সবাই শীতল রক্তবিশিষ্ট প্রাণী!
তামিমের এই বীরত্বের তুলনা? বাংলাদেশের ক্রিকেট ইতিহাসে এক এবং অদ্বিতীয়ই তো! তুলনা খুঁজতে গেলে অন্যদিকে হাত বাড়াতে হবে। ভাঙা হাত এবং ব্যাটিং—এই দুটি একসঙ্গে বললে ক্রিকেট অনুসারীদের সবার আগে মনে পড়ে দুটি নাম—ম্যালকম মার্শাল ও গ্রায়েম স্মিথ। ১৯৮৪ সালে ইংল্যান্ডের বিপক্ষে হেডিংলি টেস্টে ৯৬ রানে অপরাজিত ল্যারি গোমসকে সেঞ্চুরি করাতে প্লাস্টার করা বাঁ হাত নিয়ে নেমে পড়েছিলেন ক্যারিবীয় ফাস্ট বোলার মার্শাল। ২০০৯ সালে সিডনিতে ৮.২ ওভার বাকি থাকতে দক্ষিণ আফ্রিকার দ্বিতীয় ইনিংসে নবম উইকেট পড়ার পর ম্যাচ বাঁচাতে ১১ নম্বরে নেমে পড়েছিলেন গ্রায়েম স্মিথ। মার্শাল যা চেয়েছিলেন, তা করতে পেরেছিলেন। গোমসের সেঞ্চুরি তো হয়েছিলই, পরে ওই ভাঙা বাঁ হাত নিয়েই ৭ উইকেট নিয়েছিলেন মার্শাল। স্মিথ অবশ্য দলের পরাজয় ঠেকাতে পারেননি। তাঁর সাহসের মূল্য যদিও তাতে কমে না।
টেস্টের কীর্তি বেশি মনে থাকে। মার্শাল-স্মিথের বীরত্বও তাই অক্ষয় হয়ে আছে ইতিহাসে। তামিম ইকবাল হয়তো তাঁদের মতো সর্বজনীন প্রশস্তি পাবেন না। তবে বাংলাদেশের ক্রিকেট ইতিহাসে আলাদা একটা আসন তো তাঁর জন্য বরাদ্দ হয়েই গেল।
আরও পড়ুন...