অধিনায়ক সাকিবের বাংলাদেশের ক্রিকেটকে বদলে দেওয়ার সামর্থ্য ছিল বলে আমার যে বিশ্বাস, এমন বিশ্বাস আরও অনেকের মধ্যেই দেখেছি। মাশরাফি অনেক দিন আগে থেকেই এমন বলে আসছেন। ২০১৬ সালে খুলনার এক হোটেলে মাশরাফি ও সাকিবকে একসঙ্গে বসিয়ে ইন্টারভিউ করছি। একজন সম্পর্কে আরেকজন বলবেন—থিমটা মোটামুটি এ রকম। সেখানেই মাশরাফি বলেছিলেন, ‘সাকিব যদি লম্বা সময়ের জন্য বাংলাদেশ টিমের ক্যাপ্টেনসি না করে, বাংলাদেশের ক্রিকেটের জন্য সেটি বড় ক্ষতি হবে।’
নায়ক ক্রিকেটার। হঠাৎ টেস্ট অধিনায়কত্ব পেয়ে বোলিংয়ে ৮ উইকেট, ব্যাটিংয়ে অপরাজিত ৯৬। ছক্কা মেরে ম্যাচ শেষ। একদা পরাক্রান্ত এক ক্রিকেট-শক্তির বিপক্ষে টেস্ট জয়। সিরিজে হোয়াইটওয়াশ। নায়ক ম্যান অব দ্য ম্যাচ। ম্যান অব দ্য সিরিজও।
ঔপন্যাসিক লিখবেন এবং ভাববেন, একটু বাড়াবাড়ি হয়ে গেল না তো! যতই কল্পকাহিনি হোক, পাঠকের পাতে দিতে গল্পটা তো বাস্তবোচিত হতে হবে। কল্পনা আর বাস্তবের ব্যবধান ঘুচিয়ে দিয়ে সাকিব আল হাসান জানালেন, স্বপ্ন দেখতে জানলে আকাশই তার ঠিকানা।
প্রায় ১৩ বছর আগের লেখা থেকে প্রথম দুই অনুচ্ছেদ তুলে দেওয়ার কারণটা হয়তো অনুমান করতে পারছেন। অধিনায়ক সাকিবের শুরুটা মনে করিয়ে দেওয়া। ২০০৯ সালে গ্রেনাডায় ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিপক্ষে সিরিজের দ্বিতীয় টেস্টে বাংলাদেশের জয়ের লক্ষ্য ২১৫ রান। চতুর্থ ইনিংস ও ইতিহাস গড়ার চাপ মিলিয়ে যেটির সঙ্গে অদৃশ্য আরও শ খানেক রান যোগ হয়ে গেছে। ৬৭ রানে ৪ উইকেট পড়ে যাওয়ার পর হয়তো আরও বেশি। সেখান থেকে সাকিবের অপরাজিত ৯৬ রানে বাংলাদেশের ঐতিহাসিক জয়। সেটিও জয় থেকে ৪ রান দূরে থাকতে বিশাল এক ছক্কায়। সেই সিরিজের আগেই অধিনায়কত্ব হারানো মোহাম্মদ আশরাফুলের সেই মুগ্ধ প্রতিক্রিয়া এখনো মনে পড়ে, ‘এমন বোলিং, এমন ব্যাটিং—ক্যাপ্টেনকে এমনই হতে হয়।’
রেকর্ড বইয়ে লেখা, গ্রেনাডাতেই সাকিবের অধিনায়কত্বে অভিষেক। আসলে তো তা হয়ে গেছে সেন্ট ভিনসেন্টে সিরিজের প্রথম টেস্টেই। ওয়েস্ট ইন্ডিজের প্রথম ইনিংসের ১৪তম ওভারেই অধিনায়ক মাশরাফি বিন মুর্তজার হাঁটু আবারও বিদ্রোহ করে বসায় ৬০তম টেস্টে দ্বিতীয় আর দেশের বাইরে প্রথম জয়েও তো আসলে নেতৃত্ব দিয়েছেন সাকিবই। টাকাপয়সা নিয়ে বোর্ডের সঙ্গে ঝামেলায় মূল খেলোয়াড়দের ধর্মঘটের কারণে সেই সিরিজে বাংলাদেশের প্রতিপক্ষ কার্যত ওয়েস্ট ইন্ডিজের ‘বি’ টিম। অনেকের হয়তো মনে নেই, সেই ‘বি’ টিমই কিন্তু প্রথম ইনিংসে ৬৯ রানের লিড নিয়ে ফেলেছিল। সেখান থেকে বাংলাদেশের জয়ে সাকিবের অধিনায়কত্বের বড় ভূমিকা।
সেই ওয়েস্ট ইন্ডিজ সফরে যাওয়ার মাস কয়েক আগেই প্রথমবারের মতো আইসিসির ওয়ানডে অলরাউন্ডার র্যাঙ্কিংয়ের শীর্ষে উঠেছেন। বাংলাদেশের ক্রিকেট ইতিহাসে সেরা খেলোয়াড় হিসেবে সাকিব আল হাসানের অভিযাত্রার সূচনা বলতে পারেন যেটিকে। ওয়েস্ট ইন্ডিজে হঠাৎ পাওয়া অধিনায়কত্বের চাপ বিন্দুমাত্র বুঝতে না দিয়ে অমন পারফরম্যান্স (মনে করিয়ে দিই, টেস্টের পর ওয়ানডেতেও ওয়েস্ট ইন্ডিজকে হোয়াইটওয়াশ করেছিল বাংলাদেশ), সঙ্গে সেন্ট ভিনসেন্টের ওই চোট মাশরাফির টেস্ট ক্যারিয়ার শেষ করে দেওয়ার পর বাংলাদেশের ক্রিকেটে দীর্ঘ সাকিব-রাজ শুরু হওয়ার কথা ছিল। তা শুরু হয়েওছিল। কিন্তু সেটি দীর্ঘ হয়নি। যে কারণে ক্যারিয়ারের পড়ন্ত বেলায় আবারও টেস্ট অধিনায়কত্ব পাওয়ার পর দেখা যাচ্ছে, মাত্র ১৪টি টেস্টেই নেতৃত্ব দিয়েছেন সাকিব। ২০১৯ সালে সর্বশেষবার অধিনায়কত্ব হারিয়েছেন নিজের দোষে। অধিনায়ক সাকিবের পূর্ণতার সম্ভাবনা অবশ্য এর অনেক আগেই শেষ হয়ে গেছে। ২০১১ সালে জিম্বাবুয়ে সফরের পর সে সময়কার ক্রিকেট বোর্ডের একটা অংশের বিরাগভাজন হয়ে সাকিবের অধিনায়কত্ব হারানোতে সাকিবের যতটুকু ক্ষতি হয়েছে, তার চেয়ে অনেক বেশি হয়েছে বাংলাদেশের ক্রিকেটের। না হলে দীর্ঘ পরিসরের ক্রিকেট নিয়ে বোর্ডের অনাগ্রহ বা পরিকল্পনাহীনতার পরও কেন যেন মনে হয়, বাংলাদেশ হয়তো টেস্ট দল হিসেবে এত দিনে মোটামুটি দাঁড়িয়ে যেত।
এমন মনে হওয়ার বড় কারণ, ২০১১ বিশ্বকাপের কিছুদিন আগে নেওয়া সাকিবের একটা সাক্ষাৎকার। এর আগে মাশরাফির ‘বদলি’ হিসেবে অধিনায়কত্ব করেছেন, সেবারই প্রথম দীর্ঘ মেয়াদের প্রতিশ্রুতি দিয়ে আনুষ্ঠানিকভাবে অধিনায়ক করা হয়েছে সাকিবকে। শুধুই অধিনায়কত্ব নিয়ে নেওয়া দীর্ঘ সেই সাক্ষাৎকারের শিরোনামও ছিল: অধিনায়ক সাকিব। যাতে তাঁর অধিনায়কত্ব দর্শন ও বাংলাদেশ দল নিয়ে চিন্তাভাবনা শুনে রীতিমতো মুগ্ধ হয়েছিলাম। সেই সাক্ষাৎকারের পুরোটাই তুলে দিতে পারলে ভালো হতো। তা যখন সম্ভব নয়, একটা অংশ শুধু তুলে দিই। অধিনায়ক হিসেবে কী ছাপ রাখতে চান—প্রশ্নের জবাবে বলেছিলেন, ‘রেজাল্ট দিয়ে যদি ছাপ রাখতে না-ও পারি, আমি চাই বাংলাদেশ একটা অন্য রকম টিম হিসেবে তৈরি হবে। এখানে সৌরভ গাঙ্গুলীর কথা বলতে পারি। ও আসার পর থেকে যেমন “টিম ইন্ডিয়া” কথাটা এসেছে। গাঙ্গুলীর উদাহরণটা দিলাম এ কারণে যে সবাই যেমন বলে, সৌরভ আসার পর ভারত বদলে গেছে, টিম হিসেবে খেলতে শুরু করেছে, পারফর্ম করতে শুরু করেছে। “নো ফিয়ার” একটা মনোভাব পুরো দলে ছড়িয়ে পড়েছে। আমিও এমন একটা চেঞ্জ আনতে চাই।’
তা আর করা হয়নি সাকিবের। এ নিয়ে তাঁর মনে একটা দুঃখবোধ আছে বলেই অনুমান করি। গত ডিসেম্বরে জীবন-ক্যারিয়ার-অধিনায়কত্ব-বিতর্ক—এসব নিয়ে নেওয়া দীর্ঘ এক সাক্ষাৎকারে একটু অনুযোগের সুরে যখন বলেছিলাম, অর্জুনা রানাতুঙ্গা যেমন শ্রীলঙ্কান ক্রিকেটকে অন্য একটা পর্যায়ে তুলে দিয়েছিলেন, আপনারও সুযোগ ছিল তা করার; সাকিব উত্তর দিয়েছিলেন, ‘এটা তো আমি চাইলেই হবে না, বোর্ডকেও বিশ্বাস করতে হবে।’ কথায়–কথায় এটাও বলেছিলেন, ২০১৮ সালে আবার যখন অধিনায়কত্ব পেয়েছিলেন, তত দিনে বাংলাদেশের ক্রিকেটকে বদলে দেওয়ার স্বপ্ন হারিয়ে গেছে।
অধিনায়ক সাকিবের বাংলাদেশের ক্রিকেটকে বদলে দেওয়ার সামর্থ্য ছিল বলে আমার যে বিশ্বাস, এমন বিশ্বাস আরও অনেকের মধ্যেই দেখেছি। মাশরাফি অনেক দিন আগে থেকেই এমন বলে আসছেন। ২০১৬ সালে খুলনার এক হোটেলে মাশরাফি ও সাকিবকে একসঙ্গে বসিয়ে ইন্টারভিউ করছি। একজন সম্পর্কে আরেকজন বলবেন—থিমটা মোটামুটি এ রকম। সেখানেই মাশরাফি বলেছিলেন, ‘সাকিব যদি লম্বা সময়ের জন্য বাংলাদেশ টিমের ক্যাপ্টেনসি না করে, বাংলাদেশের ক্রিকেটের জন্য সেটি বড় ক্ষতি হবে।’ মনে রাখতে হবে, মাশরাফি নিজে তখন ওয়ানডে ও টি-টোয়েন্টি অধিনায়ক। টেস্ট অধিনায়ক মুশফিক। সেই সময়ে এই কথাটায় বিতর্কের যথেষ্ট উপাদান আছে জেনেও মাশরাফি তা না বলে পারেননি। সাকিবের ক্ষুরধার ক্রিকেট মস্তিষ্কের এমন ভক্ত বাংলাদেশ দলে আরও আছেন। তামিম ইকবাল যেমন নির্দ্বিধায় বলে দেন, ‘ট্যাকটিক্যালি সাকিবই সম্ভবত বাংলাদেশের সেরা অধিনায়ক।’
অধিনায়ক হিসেবে যা করতে চেয়েছিলেন, তার সবটা করার সময় হয়তো নেই। যত দূর জানি, আবার অধিনায়কত্ব করাটাও সাকিবের অগ্রাধিকার তালিকায় ছিল না। তবে সুযোগ যখন পেয়েছেন, নিজের একটা ছাপ কিন্তু চাইলেই রেখে যেতে পারেন সাকিব। অধিনায়ক হিসেবে সাফল্যের মোটামুটি একটা রেসিপি যদি তৈরি করা যায়, দেখা যাবে, তার সবই সাকিবের মধ্যে আছে। ক্ষুরধার ক্রিকেট–মস্তিষ্কের কথা তো আগেই বলেছি, ব্যাটে-বলে সামনে থেকে নেতৃত্ব দেওয়ার ক্ষমতাও, এর সঙ্গে সাকিবের সবচেয়ে সুবিধা, দলের খেলোয়াড়দের প্রশ্নাতীত আনুগত্য। তামিম-মুশফিকের মতো সমসাময়িক দুজনকে বাদ দিলে বাংলাদেশের টেস্ট দলের বাকি সব খেলোয়াড়ের বেড়ে ওঠাই তো সাকিবকে ‘হিরো’ জ্ঞান করে।
তামিম ইকবাল একবার আমাকে বলেছিলেন, সাকিব মনেপ্রাণে কিছু চাইলেই তা করতে পারেন। মনেপ্রাণে চাওয়াটাই আসল কথা। আবার অধিনায়কত্ব পাওয়াটাকে বড় সুযোগ মনে করে সাকিব যদি শেষটা রাঙিয়ে দিতে চান, হয়তো পারতেও পারেন।