এই মুহূর্তে বাংলাদেশের ক্রিকেটে তিনি সবচেয়ে বিতর্কিত? বলা যায়।
সবচেয়ে বড় তারকা? নিঃসন্দেহে। সময় ছাপিয়ে বাংলাদেশ ক্রিকেটের সর্বকালের সেরা? একটু থামতে হয়।
সর্বকাল জুড়ে দেওয়াতেই হয়তো অবিসংবাদিত কোনো উত্তর দেওয়া যায় না। সর্বকালে সীমা টানা যায় না, সর্বকালের সেরার প্রশ্নগুলোর উত্তর তাই যুক্তি-তথ্যের চেয়ে আবেগের নিক্তিতে বেশি মেলে। কিন্তু সাকিব আল হাসান বাংলাদেশ ক্রিকেটের এখন পর্যন্ত সবচেয়ে বড় তারকা কি না, সে প্রশ্নে ‘না’-বোধক উত্তর দেওয়া মানুষের সংখ্যা সম্ভবত হাতের কর গুনে বলে দেওয়া যাবে।
গত কিছুদিনে দেশের ক্রিকেটে সবচেয়ে আলোচিত, আরও নির্দিষ্ট করে বললে বিতর্কিত নামটি সাকিব। বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ডের (বিসিবি) কাছে তাঁর ছুটি চাওয়া ঘিরে যা হচ্ছে, তা দেশের ক্রিকেটের জন্য এই মুহূর্তে হয়তো অস্বস্তিকর প্রশ্ন। গোলটেবিলে সেভাবে না হলেও তাঁর ছুটির গুরুত্ব ও প্রয়োজনীয়তা শীর্ষক আলোচনা চলছে দিগবিদিক। সাকিবের আইপিএল খেলতে চাওয়া, বাংলাদেশের জার্সিতে টেস্ট খেলতে আগ্রহ থাকা না থাকা, বিসিবির কর্মকর্তাদের সাকিবের চিঠি ঠিকমতো না পড়া, তাঁর কথার ভুল ব্যাখ্যা নিয়ে সাকিবের অভিযোগ...গত কিছুদিনে ক্রিকেটপাড়া সরগরম।
তবে সাকিবের এই ছুটি চাওয়া ঘিরে বিতর্ক হয়তো বাংলাদেশের ক্রিকেটের ভবিষ্যতের একটা দিকনির্দেশনাও। হয়তো একটা সিদ্ধান্ত নিয়ে আসবে। সেটা ভালো হবে কি খারাপ, সে উত্তর সময়ের হাতে।
এত কিছু চলছে বলেই হয়তো, সাকিবের জন্মদিনটা একটু পেছনের পাতার খবর এবার। বেশ নিভৃতেই কাটছে আজ সাকিবের ৩৪তম জন্মদিন। একাকীও। স্ত্রী-সন্তানদের যুক্তরাষ্ট্রে রেখে দেশে ফিরেছেন সাকিব, আজ বিসিবির একাডেমি মাঠে ব্যাটিং-বোলিং অনুশীলন করেছেন। ধরে নেওয়া যায়, এটা তাঁর আইপিএলের প্রস্তুতি। একটু অন্য রকম জন্মদিনই কাটছে সাকিবের।
অন্য রকম দিনটাতে তাঁকে স্মৃতির অ্যালবাম থেকে পুরোনো ছবিগুলোতে ঘুরিয়ে আনলে কেমন হয়? কল্পনাতেই না হয় সাকিব একটু ঘুরে এলেন পেছনে ফেলে আসা পথের বাঁকে বাঁকে, যেখানে মাইলফলক হয়ে থাকা রেকর্ডগুলো বলবে তাঁর এগিয়ে চলার উপাখ্যান। ৩৪তম জন্মদিনে সাকিবকে চিলতেখানিক হাসি এনে দিতে পারে তাঁর ৩৪টি কীর্তি।
১. ২০১৫ সালের জানুয়ারিতে প্রথমবার আন্তর্জাতিক ক্রিকেটের তিন সংস্করণেই অলরাউন্ডার র্যাঙ্কিংয়ের শীর্ষে ওঠেন সাকিব। ক্রিকেট ইতিহাসে সাকিব ছাড়া এই কীর্তি নেই অন্য কারও।
২. ২০১৪ সালে জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে একই ম্যাচে সেঞ্চুরি ও ১০ উইকেটের কীর্তি গড়েন সাকিব, যে কীর্তি এর আগে ছিল দুই কিংবদন্তির—পাকিস্তানের ইমরান খান ও ইংল্যান্ডের ইয়ান বোথাম। এখনো তালিকায় শুধু এ তিনজনেরই সদম্ভ উপস্থিতি।
৩. জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে সেই সিরিজেই ২৫১ রান করার পাশাপাশি ১৮ উইকেট নেন সাকিব। তিন টেস্টের সিরিজে ২৫০ রান ও ১৫ উইকেটের কীর্তিতে সাকিবের পাশে আছেন শুধু অস্ট্রেলিয়ার মিচেল জনসন।
৪. ২০১৭ চ্যাম্পিয়নস ট্রফিতে নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে পঞ্চম উইকেটে মাহমুদউল্লাহর সঙ্গে সাকিবের ২২৪ রানের জুটিটি সে সময়ে ছিল ওয়ানডেতে বাংলাদেশের যেকোনো জুটিতে সর্বোচ্চ। গত বছর সিলেটে জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে তামিম-লিটনের ২৯২ রানের জুটি সে রেকর্ড ভেঙে দিয়েছে।
৫. টি-টোয়েন্টিতে কোনো এক মাঠে সবচেয়ে বেশি উইকেটের রেকর্ড সাকিবের। মিরপুর শেরেবাংলা স্টেডিয়ামে আন্তর্জাতিক ও ঘরোয়া টি-টোয়েন্টি মিলিয়ে মোট ১২৯ উইকেট নিয়েছেন বাঁহাতি স্পিনার। এ তালিকার ২ নম্বরেও বাংলাদেশের একজন—রুবেল হোসেন, মিরপুর স্টেডিয়ামে ৯৬ উইকেট নিয়ে যৌথভাবে দ্বিতীয়।
৬. ২০১৫ বিশ্বকাপে আফগানিস্তানের বিপক্ষে ম্যাচে প্রথম বাংলাদেশি হিসেবে ওয়ানডেতে ৪ হাজার রানের মাইলফলক ছুঁয়ে ফেলেন সাকিব।
৭. ২০১৭ সালের ১৩ জানুয়ারি টেস্টে বাংলাদেশের ব্যাটসম্যানদের মধ্যে সর্বোচ্চ স্কোরের রেকর্ড গড়েন সাকিব। তবে তাঁর ২১৭ রানের রেকর্ডটা পরের বছর পেরিয়ে যান মুশফিকুর রহিম (২১৯*)।
৮. কোনো এক মাঠে ওয়ানডেতে ১০০ উইকেট পাওয়া প্রথম স্পিনার সাকিব, সব মিলিয়ে বোলারদের মধ্যে দুই পাকিস্তানি ওয়াসিম আকরাম ও ওয়াকার ইউনিসের পর তৃতীয়। তবে উইকেটের সংখ্যায় এখন ওয়াকারকেও ছাড়িয়ে গেছেন সাকিব। মিরপুরে সাকিবের ১১৯ উইকেটের চেয়ে এক মাঠে ওয়ানডেতে বেশি উইকেট শুধু শারজায় ওয়াসিমের ১২২।
৯. টেস্টে দ্রুততম ৩০০০ রান ও ২০০ উইকেট পাওয়ার রেকর্ড সাকিবের। এ কীর্তিতে ইংলিশ কিংবদন্তি ইয়ান বোথামের লেগেছিল ৫৫ টেস্ট, সাকিবের লেগেছে এক টেস্ট কম।
১০. টেস্টে কমপক্ষে ২০০০ রান ও ১০০ উইকেট আছে, এমন অলরাউন্ডারদের মধ্যে ব্যাটিং ও বোলিং গড়ের পার্থক্যে এই শতকে সাকিবের চেয়ে ওপরে ছিলেন শুধু জ্যাক ক্যালিস। সাকিবের ব্যাটিং গড়ের (৩৯.৬৯) সঙ্গে বোলিং গড়ের (৩১.২০) পার্থক্য ৮.৪৯। ক্যালিসের এই পার্থক্য ২২.৭১।
১১. এই শতক ছাপিয়ে ক্রিকেটের জন্মলগ্ন থেকে ব্যাটিং গড় ও বোলিং গড়ের ব্যবধানের হিসাব করলে অলরাউন্ডারদের কার্যকারিতা পরিমাপের এই পরিসংখ্যানে সাকিবের ওপরে আছেন শুধু পাঁচজন—গ্যারি সোবার্স (২৩.৭৪), জ্যাক ক্যালিস (২৫.০৮), ইমরান খান (১৪.৮৮), কিথ মিলার (১৩.৯৯) ও শন পোলক (৯.১৯)।
১২. ওয়ানডেতে ব্যাটিং ও বোলিং গড়ের ব্যবধানের তালিকায় সাকিবের (ব্যাটিং গড় ৩৮.০৮, বোলিং গড় ২৯.৭২, ব্যবধান ৮.৩৫) ওপরে আছেন চারজন—ক্যালিস (১২.৫৬), ভিভ রিচার্ডস (১১.১৬), ল্যান্স ক্লুজনার (১১.১৫) ও শেন ওয়াটসন (৮.৭৪)।
১৩. ২০০৬ সালের ৬ আগস্ট সাকিবের ওয়ানডে অভিষেকের পর থেকে এ নিয়ে ২২ বার ম্যাচসেরা হয়েছেন সাকিব। এ সময়ে তাঁর চেয়ে বেশি ম্যাচসেরা হওয়ার গর্ব শুধু তিনজনের—বিরাট কোহলি (৩৬), এবি ডি ভিলিয়ার্স (২৭) ও তিলকরত্নে দিলশান (২৪)।
১৪. ওয়ানডেতে কমপক্ষে ৫ হাজার রান ও ২৫০ উইকেট আছে, এমন অলরাউন্ডারদের তালিকায় সেরা পাঁচে সাকিব (৬৪৩৬ রান ও ২৬৬ উইকেট)। অন্য চারজন—জ্যাক ক্যালিস, আবদুল রাজ্জাক, সনাৎ জয়াসুরিয়া ও শহীদ আফ্রিদি। তাঁদের মধ্যে ব্যাটিং ও বোলিং গড়ের মধ্যে ধনাত্মক ব্যবধান আছে শুধু সাকিব (৮.৩৫) ও ক্যালিসের (১২.৫৬)।
১৫. ২০১৮ সালের নভেম্বরে প্রথম বাংলাদেশি বোলার হিসেবে টেস্টে ২০০ উইকেটের মাইলফলকে পৌঁছান সাকিব।
১৬. আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে সব সংস্করণ মিলিয়ে প্রথম বাংলাদেশি হিসেবে ৫০০ উইকেট পাওয়ার কীর্তি সাকিবের।
১৭. বোলিংয়ে ৫০০ উইকেটে প্রথম, ব্যাটিংয়েও খুব একটা পিছিয়ে কি? তিন সংস্করণ মিলিয়ে ১০ হাজার রানের তালিকায় দ্বিতীয় বাংলাদেশি সাকিব।
১৮. টি-টোয়েন্টিতে সব মিলিয়ে ৪ হাজার রান ও ৩০০ উইকেট পাওয়া তৃতীয় ক্রিকেটার সাকিব। তবে সে কীর্তি সাকিব ছুঁয়েছেন অন্য দুজনের চেয়ে কম ম্যাচে (২৬০)। শহীদ আফ্রিদির লেগেছিল ২৮৩ ম্যাচ, ডোয়াইন ব্রাভোর ২৯২ ম্যাচ।
১৯. টেস্টে তাঁর ৩৯৩০ রানের চেয়ে বেশি রান শুধু তামিম ইকবাল (৪৫০৮) ও মুশফিকুর রহিমের (৪৫৩৭)। কিন্তু টেস্টে উইকেটের হিসাবে আবার সবার ওপরে সাকিব (২১০)।
২০. ওয়ানডেতে সাকিবের ৬৪৩৬ রানের চেয়ে বেশি আছে শুধু তামিম ইকবালের (৭৪৫১)। এখানে উইকেটের হিসাবেও সাকিব দ্বিতীয়, তাঁর ২৬৬ উইকেটের চেয়ে বেশি আছে শুধু মাশরাফি বিন মুর্তজার (২৬৯)।
২১. টি-টোয়েন্টিতে রানের হিসাবে সাকিবের (১৫৬৭) ওপরে শুধু তামিম (১৭০১)। এখানেও উইকেটের হিসাবে সাকিব সেরা (৯২)।
২২. ২০১৯ সালের জুনে সবচেয়ে কম ম্যাচে (১৯৯) ওয়ানডেতে ৬ হাজার রান ও ২৫০ উইকেট পাওয়ার কীর্তি গড়েন সাকিব।
২৩. এ বছরের জানুয়ারিতে ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিপক্ষে সিরিজের তৃতীয় ওয়ানডেতে প্রথম ক্রিকেটার হিসেবে ওয়ানডেতে এক দেশে ৬ হাজার রান ও ৩০০ উইকেটের ‘ডাবল’ পেয়েছেন সাকিব।
২৪. ২০০৭ সালের ফেব্রুয়ারিতে কানাডার বিপক্ষে যখন অপরাজিত ১৩৪ রানের ইনিংস খেলেন সাকিব, সেটি ছিল সে সময়ে ওয়ানডেতে বাংলাদেশের সর্বোচ্চ স্কোর। এখন অবশ্য সেটি তালিকায় ষষ্ঠ। সর্বোচ্চ লিটন দাসের ১৭৬, গত বছরের মার্চে জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে।
২৫. টেস্ট, ওয়ানডের মতো টি-টোয়েন্টিতেও একসময় বাংলাদেশের সর্বোচ্চ ইনিংসের রেকর্ডটা এক সময় সাকিবের ছিল। ২০১২ সালের সেপ্টেম্বরে পাকিস্তানের বিপক্ষে সাকিবের ৮৪ রানের ইনিংসটি পরে দুবার পেরিয়েছেন তামিম (২০১২ সালের ডিসেম্বরে ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিপক্ষে অপরাজিত ৮৮ ও ২০১৬ বিশ্বকাপে ওমানের বিপক্ষে অপরাজিত ১০৩)।
২৬. ওয়ানডেতে এখন পর্যন্ত বাংলাদেশের যত ব্যাটসম্যান এসেছেন, তার মধ্যে সবচেয়ে বেশি গড় সাকিবের (৩৮.০৮)।
২৭. টেস্টে সাকিবের ৩৯.৬৯-এর চেয়ে বেশি ব্যাটিং গড় এখন পর্যন্ত বাংলাদেশের ক্রিকেট ইতিহাসে আছে শুধু মুমিনুল হকের (৪১.১৮)।
২৮. ওয়ানডেতে সাকিবের ৯টি সেঞ্চুরির চেয়ে বেশি সেঞ্চুরি আছে শুধু তামিম ইকবালের (১৩টি)।
২৯. বাংলাদেশের টি-টোয়েন্টি ইতিহাসে সবচেয়ে বেশি ফিফটি সাকিবের (৯টি)। ওয়ানডে ও টেস্টে এই তালিকায় সাকিব দ্বিতীয়। দুই জায়গাতেই তাঁর ওপরে আছেন তামিম। ওয়ানডেতে সাকিবের ৫৭টির চেয়ে ৬টি ফিফটি বেশি তামিমের, টেস্টে সাকিবের ৩০টির চেয়ে তামিমের ফিফটি বেশি ৭টি।
৩০. বিদেশের মাটিতে এক টেস্ট সিরিজে বাংলাদেশের ব্যাটসম্যানদের মধ্যে সবচেয়ে বেশি রানের তালিকায় ২ নম্বরে আছেন সাকিব। ২০১৭ সালে নিউজিল্যান্ডে ২ ম্যাচে তাঁর ২৮৪ রানের চেয়ে বেশি রান আছে শুধু হাবিবুল বাশারের। তবে ২০০৩ সালে পাকিস্তানে হাবিবুলের ৩৭৯ রান এসেছে ৩ টেস্টে।
৩১. দেশে বা বিদেশে, ওয়ানডেতে এক সিরিজে সবচেয়ে বেশি রান সাকিবের। ২০১৯ বিশ্বকাপে ৮ ম্যাচে ৬০৬!
৩২. টেস্টে বাংলাদেশের হয়ে সবচেয়ে বেশি বার ইনিংসে পাঁচ উইকেট পাওয়ার কীর্তি সাকিবের (১৮ বার)। দুইয়ে থাকা মেহেদী হাসান মিরাজ এখন পর্যন্ত ইনিংসে পাঁচ উইকেট পেয়েছেন ৭ বার।
৩৩. টি-টোয়েন্টিতে এখন পর্যন্ত ইনিংসে ৫ উইকেট পাওয়া তিন বাংলাদেশি বোলারের একজন সাকিব। অন্য দুজন—ইলিয়াস সানি ও মোস্তাফিজুর রহমান।
৩৪. টেস্টে একাধিকবার এক ম্যাচে ১০ উইকেট পেয়েছেন বাংলাদেশের দুই বোলার, তাঁদের একজন সাকিব। অন্যজন মিরাজ। দুজনই ম্যাচে ১০ উইকেট পেয়েছেন দুবার করে।