প্রত্যাবর্তন মানেই ফুলেল অভ্যর্থনা নয়। প্রত্যাবর্তন মানেই লালগালিচা সংবর্ধনা নয়। প্রত্যাবর্তন মানেই হাততালিতে আকাশ-বাতাস মুখর করে তোলা নয়। প্রত্যাবর্তন মানে কখনো কখনো সাবধান বাণী মনে করিয়ে দেওয়াও-‘যে ভুল করে এত দিন বাইরে থাকলে, সেটি যেন আর কোরো না। ভুল থেকে শেখ।’
ক্রিকেট থেকে এক বছরের নির্বাসন কাটিয়ে সাকিব আল হাসানের প্রত্যাবর্তনটাও এমনই হওয়া উচিত। বাজিকরের কাছ থেকে ফিক্সিংয়ের প্রস্তাব পেয়ে গোপন করেছিলেন তিনি। আন্তর্জাতিক ক্রিকেট কাউন্সিলের (আইসিসি) নিয়মে এটি অন্যায় বলে সাকিব ভোগ করেছেন তাঁর শাস্তি। এখন যখন আবার তাঁর ক্রিকেটে ফেরার সময় হলো, সাকিবের সবকিছু আতশি কাচের তলায় ফেলে দেখাটাই হতো স্বাভাবিক। কেমন তাঁর ফিটনেস, কেমন তাঁর ব্যাটিং-বোলিং? এই এক বছরে সবকিছুতে মরচে ধরে গেল না তো! আর যে ভুলের জন্য তাঁকে নির্বাসনে পাঠানো, সেই ভুল থেকে সত্যিই শিখেছেন তো সাকিব?
বাস্তবতা হলো সাকিবের দিকে সেই চ্যালেঞ্জের দৃষ্টিতে তাকানোর অবস্থায়ই নেই বাংলাদেশের ক্রিকেট। সাধারণ ক্রিকেট সমর্থক থেকে শুরু করে এ দেশের ক্রিকেট প্রশাসন পর্যন্ত সবাই সিংহাসন পেতে অপেক্ষায়। সাকিবের জন্য জায়গা খালি রেখেই যেন অপেক্ষায় জাতীয় দল। তিনি আসবেন, দলে ঢুকবেন, তারপর শুরু হবে আসল খেলা।
দোষটা সাকিবের নয়। তিনি তো আর বলেননি যে তাঁকে বিনা চ্যালেঞ্জে ফিরতে দিতে হবে। বরং ফিরেই যেন আগের মতো ঝলমলে ক্রিকেট উপহার দিতে পারেন, সে জন্য পরিশ্রমের কমতি রাখছেন না। সমস্যাটা আসলে বাংলাদেশের ক্রিকেটের। যে সময়টা সাকিব ক্রিকেটে ছিলেন না, হতে পারে করোনাভাইরাসের কারণে বেশির ভাগ ম্যাচই হতে পারেনি। তবু যা কিছু ক্রিকেট হলো, তাতেও কি কেউ সাকিবকে চ্যালেঞ্জ জানাতে পারলেন?
নির্বাসনে যাওয়ার সময় সাকিব একই সঙ্গে একজন বোলার, একজন ব্যাটসম্যান এবং দুজন অধিনায়কের (টেস্ট ও টি-টোয়েন্টি) জায়গা ছেড়ে দিয়ে গিয়েছিলেন। শক্তপোক্ত অধিকার ছেড়ে এমন লম্বা সময়ের জন্য কারও বাইরে চলে যাওয়া মানেই হলো অন্যদের হাতে দারুণ সুযোগ এসে যাওয়া। অভিজ্ঞরা চেষ্টা করবেন তাঁর ছেড়ে যাওয়া নেতৃত্বের আসনে জেঁকে বসতে। নতুনেরা চাইবেন ফাঁকা জায়গাটা পারফরম্যান্স দিয়ে ভরাট করে দলে জায়গা পাকা করতে। অথচ সাকিবকে ছাড়া বাংলাদেশ দল যে ম্যাচগুলো খেলল, সেগুলোতে সে রকম আলো ছড়াতে পারেননি কেউই।
সাকিবের জায়গায় টেস্ট অধিনায়ক হয়ে মুমিনুল হক পারেননি সম্ভাবনার ইঙ্গিত দিতে। এই সময়ের মধ্যে চারটি টেস্ট খেলে একটিতে জিতলেও সেটি জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে। ইনিংস ও ১০৬ রানের ব্যবধানে পাওয়া সেই জয় আগের তিন টেস্টে ভারত, পাকিস্তানের কাছে বাজেভাবে হারার উপশম হতে পারেনি। টি-টোয়েন্টি দলের নেতৃত্ব পেয়ে দিল্লিতে ভারতের বিপক্ষে জয় দিয়ে শুরু হয়েছিল মাহমুদউল্লাহর। বাকি ছয় ম্যাচের চারটিতেই হার, জয় শুধু জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে শেষ দুটিতে।
অলরাউন্ডার সাকিবের জায়গা নেওয়া কঠিন হবে জানাই ছিল। কিন্তু শুধু বোলিং বা শুধু ব্যাটিং দিয়েও তো কেউ পারতেন তাঁর অভাব বুঝতে না দিতে। এটাও তো হতে পারত, পুরো দল মিলেই এমনভাবে খেলল যে সাকিবের অনুপস্থিতি ধরা পড়ল না। দুর্ভাগ্য, সাকিবের শূন্যতা সেভাবেও পূরণ করতে পারেনি বাংলাদেশ দল। বরং প্রতিটি ম্যাচে, প্রতিটি সিরিজেই উচ্চারিত হয়েছে সাকিবের অনুপস্থিতির কথা। দলও বারবারই স্বীকার করে নিয়েছে যে এ অভাব ঘোচার নয়। করোনায় আন্তর্জাতিক ক্রিকেট হতে পারছে না বলেও যেন ভেতরে ভেতরে একটা স্বস্তি। সাকিবকে ছাড়া খেলতে হচ্ছে না, এটাই তো ভালো!
ভুলের দণ্ডে নির্বাসনে যাওয়া সাকিবের ফেরায় তাই আবহসংগীতের মতোই শোনা যাচ্ছে হাততালির শব্দ। আছে অদৃশ্য পুষ্পমাল্য আর লালগালিচাও। গায়েবি সংবর্ধনা নিয়েই যেন সাকিব ফিরছেন তাঁর জায়গায়। রাজার শূন্য সিংহাসনটাও যে নিতে পারেনি কেউ!
সাকিবের সেই ভুল
২০১৮ সালের জানুয়ারিতে ত্রিদেশীয় ওয়ানডে সিরিজে দুবার (১৯ জানুয়ারি, ২৩ জানুয়ারি) ভারতীয় জুয়াড়ি দীপক আগারওয়াল সাকিবের সঙ্গে যোগাযোগ করেন। সেবারই আইপিএলে আরও একবার সাকিবকে ফিক্সিংয়ের প্রস্তাব দেন আগারওয়াল। সাকিব একবারও আইসিসির বা বিসিবির দুর্নীতি দমন বিভাগকে জানাননি।
শাস্তি
ফিক্সিংয়ের প্রস্তাব পেয়েও সেটি না জানিয়ে সাকিব আইসিসি দুর্নীতি দমন আইনের ২.৪. ৪ ধারা ভাঙেন। ২০১৯ সালের ২৩ জানুয়ারি ও ২৭ আগস্ট তিনি আইসিসির দুর্নীতি দমন বিভাগের জিজ্ঞাসাবাদে ভুল শিকার করেন। শাস্তি হিসেবে সাকিবকে দুই বছরের জন্য নিষিদ্ধ করে আইসিসি, যার মধ্যে এক বছর স্থগিত নিষেধাজ্ঞা।
সাকিব ছাড়া বাংলাদেশ
এই এক বছরে বাংলাদেশ দলের হয়ে টেস্ট, ওয়ানডে ও টি-টোয়েন্টি মিলিয়ে মোট ৩৬টি ম্যাচ মিস করার কথা ছিল সাকিবের। পরে সম্ভাব্য ম্যাচের সংখ্যাটা আরও বাড়ে। কিন্তু করোনাভাইরাসের কারণে এরপর খেলাই বন্ধ হয়ে যায়। সাকিব মিস করেছেন মাত্র চারটি টেস্ট, তিনটি ওয়ানডে ও সাতটি টি-টোয়েন্টি ম্যাচ।