মিরপুর শেরেবাংলা স্টেডিয়ামের সামনে কাল বিকেলেও ছোটখাটো একটা জটলা দেখা গেল। জটলার মানুষেরা কিশোর-তরুণ বয়সী। তাঁরা আইসিসির সিদ্ধান্ত মানেন না। সাকিব আল হাসানের শাস্তি প্রত্যাহার চান।
স্টেডিয়াম প্রাঙ্গণ, বিসিবি কার্যালয় কোথাও গত কয়েক দিনের ব্যস্ততা দেখা গেল না। ক্রিকেটারদের আন্দোলন, জাতীয় দলের অনুশীলন, ভারত সফরে সাকিবকে নিয়ে অনিশ্চয়তা এবং সবশেষ আন্তর্জাতিক ক্রিকেট থেকে সাকিবকে ২ বছরের জন্য বহিষ্কারের সিদ্ধান্তকে ঘিরে গত আট–নয় দিন মিরপুর শেরেবাংলা স্টেডিয়ামে উত্তেজনার অভাব ছিল না। কাল সেই স্টেডিয়ামই কেমন নিস্তরঙ্গ, প্রাণহীন। বাংলাদেশ দল চলে গেছে ভারতে। আইসিসির সিদ্ধান্তের পর সাকিবকে নিয়ে নানামুখী আলোচনাও হঠাৎই স্তব্ধ।
তবে ক্রিকেটাঙ্গনের গুমোট ভাব কিছুটা হলেও কাটতে পারে একটি ‘শুভ’ সম্ভাবনায়। সাকিব আল হাসানের নিষেধাজ্ঞার মেয়াদ কমতেও পারে। এমন নয় যে আইসিসি এই সম্ভাবনার কথা বিসিবিকে জানিয়েছে। এমনও নয় যে আইসিসিতে বিসিবি এখনই কোনো তদবির করতে পারবে সাকিবের শাস্তি কমাতে। শাস্তিটা যেহেতু আইসিসি ও সাকিবের মধ্যে দ্বিপক্ষীয় আলোচনার ভিত্তিতে হয়েছে, আইসিসির দুর্নীতি দমন নীতি অনুযায়ী এর বিরুদ্ধে সাকিব বা বিসিবি কেউই আপিল করতে পারবে না।
তবে আইসিসির শর্ত অনুযায়ী দুর্নীতি দমন কার্যক্রমগুলোতে নিয়মিত অংশ নিয়ে সাকিব আইসিসিকে সন্তুষ্ট করতে পারলে শাস্তির মেয়াদ কিছুটা কমে এলেও আসতে পারে। এমন উদাহরণ অতীতেও আছে। পাকিস্তানের ফাস্ট বোলার মোহাম্মদ আমিরের ক্ষেত্রেই সেটি হয়েছে। ২০১০ সালে ইংল্যান্ড সফরে স্পট ফিক্সিংয়ের অভিযোগে পাঁচ বছরের জন্য নিষিদ্ধ হন আমির, সালমান বাট ও মোহাম্মদ আসিফ। তবে শাস্তির মেয়াদ কমায় নির্ধারিত সময়ের ছয় মাস আগেই আমির ঘরোয়া ক্রিকেটে ফিরতে পেরেছিলেন।
সাকিবের ক্ষেত্রেও সে রকম কিছুর আশা করাই যায়। বিশেষ করে তিনি যেহেতু শুরুতেই ভুল স্বীকার করে নিয়েছেন এবং তদন্তেও আইসিসির দুর্নীতি দমন বিভাগকে যথেষ্ট সহযোগিতা করেছেন। সাকিবের ভুলের মাত্রাও আমির-বাটদের তুলনায় অনেক গৌণ। এখন আইসিসির শর্ত অনুযায়ী দুর্নীতিবিরোধী কার্যক্রমগুলো ঠিকঠাকভাবে করলে বিসিবির জন্য সুযোগ তৈরি হতে পারে বিষয়টি নিয়ে আইসিসিতে দেনদরবার করার।
বিসিবির প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা নিজাম উদ্দিন চৌধুরীও কাল সে রকম আভাস দিলেন, ‘এ রকম উদাহরণ আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে আছে। আমরাও দেখব সাকিবের জন্য কী করা যায়। বিসিবির পক্ষ থেকে যা যা সম্ভব, সবই করা হবে। এ রকম কোনো সুযোগ থাকলে অবশ্যই আমরা সেভাবে কাজ করব।’ সাকিব যেমন আইসিসির হয়ে দুর্নীতিবিরোধী প্রচারণায় অংশ নেবেন, একইভাবে বিসিবিও তাঁকে বিভিন্নভাবে এসব কাজের সুযোগ তৈরি করে দেবে।
দুই বছরের নিষেধাজ্ঞা দেওয়া হলেও সাকিবের খেলা বন্ধ থাকবে এক বছর। অর্থাৎ, ২০২০ সালের ৩০ অক্টোবর থেকে তাঁকে খেলার মাঠে পাওয়া যাবে। এই এক বছরে দুর্নীতিবিরোধী প্রচারণা ঠিকমতো চালিয়ে গেলে পরের বছর তাঁকে শাস্তি ভোগ করতে হবে না।
বহিষ্কৃত অবস্থায় সাকিব বিসিবির অনুশীলন–সুবিধাদি ভোগ করতে পারবেন কি না, সে প্রশ্নও আছে আলোচনায়। বিসিবি এ ব্যাপারেও বেশ ইতিবাচক। তবে আগে তারা এর আইনগত দিকটি বিশ্লেষণ করে দেখতে চায় যে শাস্তির শর্ত অনুযায়ী সাকিবের এসব সুবিধা পেতে কোনো বাধা আছে কি না।
শুধু বিসিবি নয়, বিশ্বসেরা সাকিবের প্রতি সহানুভূতি গোটা বাংলাদেশের মানুষেরই। আইসিসি যথাযথ প্রক্রিয়া অনুসরণ করেই তাঁকে শাস্তি দিলেও ভক্ত-সমর্থকদের মন যেন কিছুতেই মানতে চায় না। মিরপুর শেরেবাংলা স্টেডিয়ামের মতো দেশের অনেক জায়গাতেই সাকিবের শাস্তির প্রতিবাদ চলছে, মানববন্ধন হচ্ছে। আবার বাস্তবতাও বুঝতে পারছেন অনেকে। কাল নিজের কার্যালয়ে অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল বলছিলেন, ‘আইসিসি শৃঙ্খলার ব্যাপারে অনেক কঠোর। সাকিব অন্তত বিসিবিকে কথাটা জানাতে পারত। মাননীয় প্রধানমন্ত্রীকে বলতে পারত।’ সঙ্গে সাকিবের সততারও প্রশংসা করেছেন বিসিবির সাবেক সভাপতি মুস্তফা কামাল, ‘সাকিব ভালো কাজ করেছে। ভুল করলেও সে সততার পরিচয় দিয়েছে।’
>আইসিসির নিষেধাজ্ঞা
দুর্নীতিবিরোধী কার্যক্রম ঠিকঠাকভাবে করলে এক বছরের আগেই মাঠে ফিরতে পারেন সাকিব
ভারতীয় বাজিকর দীপক আগারওয়ালের সঙ্গে সাকিবের যে বার্তা আদান–প্রদান আইসিসি প্রকাশ করেছে, তাতে এগুলোকে আংশিক মনে হতেই পারে। সাকিবও বলেছেন আগারওয়ালের পাঠানো কিছু বার্তা তিনি আগেই মুছে ফেলেছেন। তবে আইসিসির তদন্ত কর্মকর্তারা এ ব্যাপারে পুরোপুরিই নিশ্চিত হয়েছেন যে আগারওয়ালের সঙ্গে ওইটুকু বার্তা আদান-প্রদান ছাড়া আর কোনো অন্যায়ের সঙ্গে জড়িত নন সাকিব। তাঁর ব্যাংক হিসাবে তাঁরা কোনো অস্বাভাবিক লেনদেনের তথ্য পাননি।
ফিক্সিং বা বাজিকরদের সঙ্গে ক্রিকেটারদের সংশ্লিষ্টতা তদন্তের জন্য আইসিসির ১০ থেকে ১২ জনের একটি অভিজ্ঞ দল আছে, যাদের বেশির ভাগই ইংল্যান্ডের পুলিশ বিভাগের সাবেক কর্মকর্তা। যেকোনো দেশের যেকোনো খেলোয়াড়ের বিরুদ্ধে সম্পূর্ণ স্বাধীনভাবে তদন্ত করতে পারেন তাঁরা। এমনকি কোনো দেশের ঘরোয়া ক্রিকেটের ঘটনা তদন্তেও তাঁদের সংশ্লিষ্ট বোর্ডকে জানাতে হয় না। সাকিবের ব্যাপারটিও সেভাবেই তদন্ত হয়েছে, বিসিবিকে সবকিছুর বাইরে রেখে। এ বছরের জানুয়ারি ও আগস্টে যে তাঁরা দুবার বাংলাদেশে এসে সাকিবের সঙ্গে কথা বলে গেছেন, সেসবও বিসিবির অজান্তে।
শাস্তি একটা হতে পারে এবং সেটির ঘোষণা আসতে পারে বাংলাদেশ দলের ভারত সফরের সময়, তা আইসিসির কাছ থেকেই জানতে পারেন সাকিব। বিসিবির নির্ভরযোগ্য সূত্র জানিয়েছে, আইসিসি তাঁকে পরামর্শ দেয় আপাতত খেলা থেকে দূরে থাকতে। অন্যদিকে সাকিবের অনুরোধ ছিল, তাঁর শাস্তির সিদ্ধান্ত যেন বাংলাদেশ দলের ভারত সফরের আগেই জানানো হয়। তিনি চাননি সফরের মাঝপথে এটা হোক। কারণ, সেটি হতো তাঁর এবং দেশের ক্রিকেটের জন্য বেশি বিব্রতকর। সে জন্যই সফরের আগে শেষ দুই দিনের অনুশীলন থেকে নিজেকে সরিয়ে রাখেন সাকিব, বিসিবি সভাপতিকে জানান ভারত সফরে না যাওয়ার কথা।
সাকিব আইসিসির শাস্তির মুখে পড়তে যাচ্ছেন, এটি তাঁর কাছেই প্রথম জানতে পারেন বোর্ড সভাপতি নাজমুল হাসান। তবে এ মাসের দ্বিতীয় সপ্তাহে দুবাইয়ে অনুষ্ঠিত আইসিসির সভায় এ রকম কিছুর আঁচ পেয়েছিলেন তিনি। কে শাস্তি পাচ্ছেন, কী শাস্তি হচ্ছে, সেসব না বললেও বাংলাদেশ দলের কারও দিকে যে এ রকম একটা অভিযোগের তির ছুটে আসছে, সে রকম আভাস নাকি দেওয়া হয় সভায়।
জানা গেছে, দীপক আগারওয়ালকে ঘিরে আইসিসির তদন্তের ডালপালা ছড়িয়ে আছে আরও নানা দিকে। অদূর ভবিষ্যতে তাতে ফেঁসে যেতে পারেন আরও ক্রিকেটার। তবে সে তালিকায় বাংলাদেশের আর কারও থাকার আশঙ্কা নেই বলে জানিয়েছে সূত্র।
আরও পড়ুন: