টেস্ট, ওয়ানডে ও টি-টোয়েন্টির জন্য আলাদা শ্রেণিভিত্তিক মনোনয়ন হয়ে গেছে। বাকি ছিল সব মিলিয়ে আইসিসির বর্ষসেরা ক্রিকেটারের পুরস্কার স্যার গারফিল্ড সোবার্সের মনোনয়ন, সেখানে চারজনের সংক্ষিপ্ত তালিকাও এসে গেছে আজ।
ম্যাচ জেতানো ইনিংস, বল হাতে চোখধাঁধানো স্পেল, অতিমানবীয় কোনো প্রচেষ্টা আর অসাধারণ নেতৃত্ব—এই চারটি দিকই বেশি গুরুত্ব পেয়েছে খেলোয়াড়দের নির্বাচনে।
টি-টোয়েন্টির বর্ষসেরা শ্রেণিতে মনোনয়ন পাওয়া পাকিস্তানের উইকেটকিপার-ব্যাটসম্যান মোহাম্মদ রিজওয়ান মনোনয়ন পেয়েছেন এখানেও। টেস্টের বর্ষসেরার শ্রেণিতে মনোনীত ইংল্যান্ড অধিনায়ক ও ব্যাটসম্যান জো রুটও আছেন বর্ষসেরা ক্রিকেটারের মনোনয়নে। অন্য দুজন পাকিস্তানের বাঁহাতি ফাস্ট বোলার শাহিন শাহ আফ্রিদি এবং নিউজিল্যান্ডের অধিনায়ক ও ব্যাটসম্যান কেইন উইলিয়ামসন।
দেখে নেওয়া যাক কার বছর কেমন গেল
এ বছর টেস্টে ১৭০০-এর বেশি রান করা রুট সব মিলিয়ে ১৮টি আন্তর্জাতিক ম্যাচে করেছেন ১৮৫৫ রান।
বছরটি যেমন কেটেছে
শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে গলে ২২৮ রানের ইনিংসে শুরু রুটের। শ্রীলঙ্কার মাটিতে আলো ছড়ানোর পর ভারতে গিয়েও চেন্নাইয়ে খেলেছেন ২১৮ রানের দুর্দান্ত ইনিংস। এরপর নিজ দেশে ভারতের বিপক্ষেই চার ম্যাচে তিন শতকসহ ৫৬৪ রান।
চলমান অ্যাশেজে ভালো শুরু করেও সেগুলোকে শতকে রূপ দিতে পারেননি, তবে বছরজুড়ে ইংল্যান্ডের ব্যাটিংয়ের সবচেয়ে বড় ভরসা হয়ে যেভাবে তিনি ছিলেন, অ্যাশেজেও রুট তা-ই আছেন। বলতে গেলে, রুট ছাড়া বাকিরা কিছু করতে পারছেন না বলেই হয়তো অ্যাশেজে এমন ভগ্নদশা ইংল্যান্ডের।
স্মরণীয় ইনিংস
আইসিসির বিচারে এ বছরে রুটের সবচেয়ে স্মরণীয় ইনিংস হয়ে থাকছে চেন্নাইয়ের ভ্যাপসা গরমে, চেন্নাইয়ের মাটিতে ভয়ংকর হয়ে ওঠা ভারতীয় স্পিনের বিপক্ষে ২১৮ রানের ইনিংসটি। ৩৭৭ বলের ম্যারাথন ইনিংসে রুটের ব্যাট থেকে এসেছে ১৯টি চার ও ২টি ছক্কা। রবিচন্দ্রন অশ্বিন ও ভারতের অন্য স্পিনারদের বলকে বিষ ছড়াতেই দেননি। তাঁর দ্বিশতকে ভর করে ইনিংসে ৫৭৮ রান করে ইংল্যান্ড, ম্যাচটা জেতে ২২৭ রানে।
বছরে ৩৬টি আন্তর্জাতিক ম্যাচে উইকেট পেয়েছেন ৭৮টি। পাকিস্তানের বাঁহাতি পেসারের প্রতি উইকেটের পেছনে খরচ গড়ে ২২.২০ রান। বছরে এক ইনিংসে সবচেয়ে বেশি উইকেট নেওয়ার রেকর্ডটি গত আগস্টে কিংস্টনে, ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিপক্ষে ৫১ রানে নিয়েছেন ৬ উইকেট। টেস্ট ক্যারিয়ারে এই একবারই ইনিংসে ৬ উইকেট পেয়েছেন তিনি।
বছরটি যেমন কেটেছে
বছরজুড়েই বল হাতে যেন আগুন ঝরিয়েছেন শাহিন আফ্রিদি। বলটা সাদা হোক আর লাল, সামনে ব্যাটসম্যান যিনিই হোন, শাহিনের গতি আর সুইংয়ের ঝড় থামেনি। টেস্ট আর টি-টোয়েন্টিতেই বেশি ঝলক দেখিয়েছেন শাহিন।
গত অক্টোবর-নভেম্বরে টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপে পাকিস্তানের চোখধাঁধানো পারফরম্যান্সের পেছনে বড় অবদান শাহিনের বোলিংয়েরই। পাকিস্তানকে সেমিফাইনালে নেওয়ার পথে ৬ ম্যাচে ৭ উইকেট নিয়েছেন শাহিন। সব মিলিয়ে টি-টোয়েন্টিতে ২১ ম্যাচে তাঁর উইকেট ২৩টি।
নিউজিল্যান্ডে টেস্টে শুরুটা মনের মতো না হলেও ঘরের মাঠে দক্ষিণ আফ্রিকার বিপক্ষে ছন্দে ফিরেছিলেন শাহিন। তবে এরপর জিম্বাবুয়ে, ওয়েস্ট ইন্ডিজ ও বাংলাদেশে তিন সফরে আসল ঝলক দেখিয়েছেন! এ সময়ে ৯ ম্যাচে ১৭.০৬ গড়ে নিয়েছেন ৪৭ উইকেট! সুইং, সিম মুভমেন্ট, প্রচণ্ড গতি বা চোখধাঁধানো ইয়র্কার—২০২১ সালে শাহিন সবই দেখিয়েছেন।
স্মরণীয় স্পেল
আইসিসির চোখে টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপে নিজেদের প্রথম ম্যাচে ভারতের বিপক্ষে শাহিনের স্পেলই বছরে তাঁর সেরা। ওয়ানডে ও টি-টোয়েন্টি মিলিয়ে বিশ্বকাপে ১৩ ম্যাচে প্রথমবার ভারতকে হারানোর পথে সেদিন দুবাইয়ে বল হাতে ম্যাচের উদ্বোধনেই চমক দেখিয়েছেন শাহিন। লোকেশ রাহুল, রোহিত শর্মার পর বিরাট কোহলি—ভারতের তিন সেরা ব্যাটসম্যানকে ফিরিয়েছেন। ৩১ রানে নিয়েছেন ৩ উইকেট।
বছরে ১৬টি আন্তর্জাতিক ম্যাচে করেছেন ৬৯৩ রান। শতক মাত্র একটি, তবে রানের গড় ৪৩.৩১।
বছরটি যেমন কেটেছে
উইলিয়ামসনের ২০২১ সালকে শুধু রানের হিসাবে বিচার করলে ভুল হবে। এর পাশাপাশি তাঁর অধিনায়কত্বও নিউজিল্যান্ডকে এবার অন্য উচ্চতায় নিয়ে গেছে। টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপে অস্ট্রেলিয়ার শেষ বাধা পেরোতে পারেনি, তবে তার আগেই প্রথম বিশ্ব টেস্ট চ্যাম্পিয়নশিপের শিরোপায় বছরটাকে রাঙিয়ে রেখেছে নিউজিল্যান্ড।
জুনে সাউদাম্পটনে ভারতের বিপক্ষে টেস্ট চ্যাম্পিয়নশিপের ‘ফাইনাল’ সেই টেস্টে ব্যাট হাতেও দারুণ করেছিলেন উইলিয়ামসন। পেসারদের সাহায্য করে, এমন পরিস্থিতিতে বুমরা-শামিদের সামলে নিজেদের প্রথম ইনিংসে করেছিলেন ৪৯ রান। এরপর রান তাড়ায় ১৩৯ রানের লক্ষ্যে তাঁর অপরাজিত ৫২ রানের ইনিংসই শিরোপামঞ্চে নিয়ে গেছে ব্ল্যাক ক্যাপদের।
টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপে ব্যাট হাতে শুরু থেকে আলো ছড়াতে পারেননি, তবে ফাইনালে অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষেই নিজের মান বুঝিয়ে দিয়েছেন উইলিয়ামসন। ৪৩ বলে ৮৫ রানের ইনিংসটি যেমন ঝোড়ো ছিল, তেমনি মুগ্ধতাও ছড়িয়েছে। টি-টোয়েন্টিতেও যে ব্যাটিং এত শৈল্পিক হতে পারে, ঝড়ও যে এত সুন্দর হতে পারে, সেটিই ক্রিকেটপ্রেমীদের মনে করিয়ে দিয়েছে উইলিয়ামসনের ইনিংসটি।
টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপের ফাইনালের ইনিংসের চেয়ে বেশি দূরে যাওয়ার দরকারই নেই! শেষ পর্যন্ত ইনিংসটি নিউজিল্যান্ডকে জেতাতে পারেনি, এ-ই যা ক্রিকেটের আক্ষেপ। আগে ব্যাটিংয়ে নেমে শুরুতেই ড্যারিল মিচেলকে হারানো নিউজিল্যান্ডকে বড় সংগ্রহ এনে দেওয়ার চ্যালেঞ্জ ছিল, উইলিয়ামসন সে দায়িত্ব পালন করেছেন প্রায় ২০০ স্ট্রাইকরেটের ইনিংসে। ১০টি চার, ৩টি ছক্কা ছিল ইনিংসে।
তবে যে বাউন্ডারিগুলো এত দারুণ সব শটে এসেছে, দেখে মুগ্ধ হননি এমন লোক খুঁজে পাওয়া দুষ্কর। চার-ছক্কার পাশাপাশি উইলিয়ামসনের এক-দুই নিয়ে প্রান্ত বদলের খেলাও নজর কেড়েছে।
বছরে ৪৪টি আন্তর্জাতিক ম্যাচে ১৯১৫ রান, গড় ৫৬.৩২। শতক হাঁকিয়েছেন ২টি। উইকেটকিপিং গ্লাভস হাতে তাঁর ডিসমিসাল ৫৬টি।
বছরটা যেমন কেটেছে
টি-টোয়েন্টিতে বছরটা রিজওয়ানের কেমন কেটেছে, সেটি আইসিসির টি-টোয়েন্টির বর্ষসেরার শ্রেণিতেও তাঁর মনোনয়ন পাওয়াই বলে। ২৯ ম্যাচে ১৩২৬ রান করেছেন, সংক্ষিপ্ত সংস্করণের আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে বছরে হাজার রান করা একমাত্র ব্যাটসম্যানও তিনি।
এত রান তিনি করেছেন ৭৩.৬৬ গড় আর ১৩৪.৮৯ স্ট্রাইক রেটে! টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপে তাঁর ব্যাট আর তাঁর উইকেটকিপিং গ্লাভস পাকিস্তানের এগিয়ে চলায় বড় অবদান রেখেছে।
টেস্টেও ৯ ম্যাচে ৪৫৫ রান করেছেন, গড় ৪৫.৫০। তবে এখানে বিবেচ্য এটি যে টি-টোয়েন্টিতে যেখানে ইনিংস উদ্বোধনে নেমে উড়ন্ত শুরু এনে দিয়েছেন তিনি, টেস্টে তাঁর দায়িত্ব ছিল লোয়ার অর্ডারে নেমে ইনিংসে স্থিতি এনে দেওয়া।
স্মরণীয় ইনিংস
শাহিন আফ্রিদির মতো রিজওয়ানের স্মরণীয় ইনিংসের খোঁজেও আইসিসির বিশ্লেষণে উঠে এসেছে টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপে ভারতের বিপক্ষে ম্যাচ। ১৫২ রানের লক্ষ্যটা কাগজে-কলমে সহজই ছিল, তবে প্রতিপক্ষে যশপ্রীত বুমরা, মোহাম্মদ শামির মতো বোলারও তো ছিলেন।
কিন্তু বাবর আজমের সঙ্গে মিলে পাকিস্তানকে কোনো আঘাত সইতে না দিয়েই জয়ের বন্দরে নিয়ে গেলেন রিজওয়ান। বাবরও অর্ধশতক পেয়েছেন, তবে রিজওয়ানের ৫৫ বলে ৬ চার ৩ ছক্কায় অপরাজিত ৭৯ রানই নজর কেড়েছে বেশি।