সফল বাবাদের ব্যর্থ ছেলেরা

ক্রিকেটে একজন খেলোয়াড়কে তাঁর দক্ষতার পরীক্ষা নিতে হয়। প্রতিভা আর সহনশীলতার ব্যাপার তো আছেই। ক্যারিয়ারের দৌড় নির্ভর করে সাফল্যের খিদের ওপর। বিরাট কোহলি যেমন মানসিক দৃঢ়তা আর ভালো করার তীব্র আকাঙ্খা দিয়েই গ্রেটদের কাতারে চলে এসেছেন। শচীন টেন্ডুলকার তাঁর প্রতিভাকে অধ্যবসায় দিয়ে শানিত করেছেন। আবার অনেকেই আছেন, যারা প্রতিভার বিকাশ ঘটাতে পারেননি মানসিক শক্তি বা শৃঙ্খলা না থাকার কারণে।

কোহলি বা টেন্ডুলকারের সন্তানেরা যে তাদের মতোই হবেন, এটা মনে করার কোনো কারণ নেই। বাবার ক্রিকেটীয় সত্তার অনেক কিছুই তাদের মধ্যে না–ও থাকতে পারে। অনেক কিংবদন্তি ক্রিকেটারের সন্তানেরাই কিন্তু বাবার মতো সাফল্য পাননি সুযোগ থাকা সত্ত্বেও। অনেক সময় বাবার নামও চাপ হয়ে দেখা দেয় সন্তানদের সাফল্যের বিকাশে। নামের পেছনে পিতৃপ্রদত্ত উপাধি থাকলেও ক্রিকেটীয় সাফল্যে বাবার ধারেকাছেও নেই—এমন পাঁচজন সম্পর্কে জেনে নিন:

রোহান গাভাস্কার আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে কিছুই করতে পারেননি। ছবি: এএফপি

রোহান গাভাস্কার; বাবা সুনীল গাভাস্কার
ভারতের ক্রিকেট ইতিহাসের অন্যতম কিংবদন্তি ক্রিকেটারে সন্তান তিনি। রোহান গাভাস্কার বাবার দেখানো পথেই পা বাড়িয়েছিলেন। কিন্তু সুনীল গাভাস্কারের খ্যাতি রোহানের জন্য হিতে–বিপরীত হয়েছে। তিনি কখনোই বাবার ধারে কাছে যেতে পারেননি ক্রিকেটীয় অর্জনে। রঞ্জি ট্রফিতে বাংলার হয়ে প্রচুর রান করলেও আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে কখনোই নিজেকে মেলে ধরতে পারেননি। মাত্র ১১টি ওয়ানডে খেলেই শেষ হয়ে গেছে তাঁর আন্তর্জাতিক ক্যারিয়ার। আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে সাফল্যের সঙ্গে টিকে থাকার জন্য যে মানসিক দৃঢ়তার প্রয়োজন, সেটারই অভাব চোখে পড়েছে রোহানের মধ্যে। ২০০৪ সালে ব্রিসবেন অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে আন্তর্জাতিক ক্রিকেট অভিষিক্ত রোহানের সাফল্য একটি মাত্র হাফ সেঞ্চুরি।

ভিভ রিচার্ডসের ছেলে মালি সুযোগই পাননি ওয়েস্ট ইন্ডিজ দলে। ছবি: এএফপি

মালি রিচার্ডস; বাবা ভিভ রিচার্ডস
চুইংগাম চিবোতে চিবোতে প্রতিপক্ষের বোলারদের খুন করতেন তিনি। ক্যারিবীয় গ্রেট স্যার ভিভিয়ান রিচার্ডসকে অনেকেই ক্রিকেট ইতিহাসেরই সেরা ব্যাটসম্যানদের তালিকার শীর্ষে রাখতে পছন্দ করেন। ওয়েস্ট ইন্ডিজের হয়ে দুবার বিশ্বকাপ জিতেছেন। উইন্ডিজকে নেতৃত্ব দিয়েছেন। ক্যারিশম্যাটিক এক চরিত্র হয়ে উঠেছিলেন ক্রিকেট দুনিয়ায়। ১৯৯১ সালে তাঁর অবসরের পর ছেলে মালি রিচার্ডসকে নিয়ে অনেকেই আশাবাদী হয়েছিলেন। সে প্রতিভা মালির ছিল। অ্যান্টিগার হয়ে অনূর্ধ্ব–১৯ ক্রিকেটে ট্রিপল সেঞ্চুরিও করেছিলেন মালি। এরপর লিওয়ার্ড আইল্যান্ডসের হয়ে ঘরোয়া প্রথম শ্রেণির ক্রিকেটে নিয়মিত খেলে গেছেন। খেলেছেন মিডলসেক্সের হয়ে কাউন্টি ক্রিকেটও। কিন্তু কেন যেন ওয়েস্ট ইন্ডিজ দলে কখনোই ডাক পাননি।

স্যার লেন হাটনের ছেলে রিচার্ড হাটন ইংল্যান্ডের হয়ে খেলেছেন মাত্র ৫ টেস্ট। ছবি: সংগৃহীত

রিচার্ড হাটন; বাবা লেন হাটন
স্যার লেন হাটনের নাম ক্রিকেট ইতিহাসে বিশেষ জায়গাজুড়ে আছে। ইংলিশ ক্রিকেটে তো বটেই। তিনি বিংশ শতকের প্রথম পেশাদার ক্রিকেটার যিনি টেস্টে ইংল্যান্ডের অধিনায়কত্ব করেছেন। পঞ্চাশের দশকে ইংল্যান্ড ক্রিকেট দলের ব্যাটিং স্তম্ভ লেন হাটনের ব্যাটিং গড় ৭৯ ম্যাচে ৫৭—দুর্দান্তই। স্যার ডন ব্র্যাডম্যানের ৩৩৪ রানের ইনিংস ছাড়িয়ে অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে তাঁর ৩৬৪ রানের ইনিংস এক বড় ইতিহাস। ১৯৫৬ সালে নাইটহুড পাওয়া লেন হাটনের ছেলে রিচার্ড হাটন ১৯৭১ সালে আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে অভিষিক্ত হয়েছিলেন আশা দেখিয়ে। ক্যারিয়ারের প্রথম ম্যাচেই ফিফটি পেয়েছিলেন। কিন্তু শুরুরটা ধরে রাখতে পারেননি। মাত্র ৫ টেস্ট খেলেই শেষ হয়ে যায় স্যার লেন হাটনের ছেলে রিচার্ড হাটনের আন্তর্জাতিক ক্যারিয়ার। তবে কাউন্টি ক্রিকেটে তিনি ভালোই করেছেন, ২৭০টি ম্যাচে ৭ হাজার রান আর ৬২৫ উইকেট বলে প্রতিভায় মন্দ ছিলেন না। কিন্তু আন্তর্জাতিক ক্রিকেট খেলতে মানসিক দৃঢ়তার অভাব ছিল।

রজার বিনির ছেলে স্টুয়ার্ট বিনি এখন ব্রাত্য ভারতীয় দলে। ছবি: এএফপি

স্টুয়ার্ট বিনি; বাবা রজার বিনি
রজার বিনি ভারতের ১৯৮৩ বিশ্বকাপজয়ী দলের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ সদস্য ছিলেন। ভারতীয় ক্রিকেট দলেও দীর্ঘদিন খেলেছেন সাফল্যের সঙ্গেই। ফাস্ট বোলিং অলরাউন্ডার হিসেবে তিনি খ্যাতি কুড়োন। '৮৩ বিশ্বকাপ ফাইনালে রজার বিনির বোলিং (১/২৩) ভূমিকা রেখেছিল দোর্দন্ড প্রতাপের ওয়েস্ট ইন্ডিজ দলকে মাত্র ১৮৩ রানে বেঁধে রাখতে। তাঁর ছেলে স্টুয়ার্ট বিনিও বাবার পদাঙ্ক অনুসরণ করেছেন। ক্রিকেটার হিসেবে নিজেকে তৈরি করেছিলেন। ২০১৪ সালে বাংলাদেশের বিপক্ষে ঢাকায় ৪ রানে ৬ উইকেট নিয়ে ভারতের এক অবিশ্বাস্য জয়ের নায়ক হয়েছিলেন। এই সাফল্য তাঁকে ২০১৫ বিশ্বকাপে ভারতের হয়ে খেলার সুযোগ করে দিয়েছিল। কিন্তু বাবার মতো তিনি নিজেকে প্রয়োজনীয় প্রমাণ করতে পারেননি কখনোই।

কেন রাদারফোর্ডের ছেলে হামিশের সম্বল ইংল্যান্ডের বিপক্ষে টেস্ট ১৭১ রানের এক ইনিংস। ছবি: এএফপি

হামিশ রাদারফোর্ড; বাবা কেন রাদারফোর্ড
মিডল অর্ডারে এক সময় নিউজিল্যান্ডের নির্ভরতা ছিলেন কেন রাদারফোর্ড। ১৯৯২ বিশ্বকাপে সেমিফাইনালে খেলা যদি বিংশ শতকে নিউজিল্যান্ড ক্রিকেটের সবচেয়ে বড় সাফল্য হয়, তাহলে কেন রাদারফোর্ড তাতে রেখেছিলেন গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা। স্যার রিচার্ড হ্যাডলি ও মার্টিন ক্রোর অবসরের পর কিউইদের অধিনায়কত্বের ভার ছিল কেনের ওপর। আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে তাঁর ৬ হাজার রানের অর্জনও কম না।

কেনের ছেলে হামিশও বাবার মতোই সফল হবেন—এমনটাই ইঙ্গিত ছিল। ইংল্যান্ডের বিপক্ষে তাঁর ১৭১ রানের সেই টেস্ট ইনিংস কেউই ভুলতে পারেন না। কিন্তু এর পরপরই বিরাট খরা। টানা ৩০ ইনিংস সুযোগ দিয়েও হামিশের কাছ থেকে ভালো কিছু বের করতে ব্যর্থ হন নিউজিল্যান্ড ক্রিকেটের নির্বাচকেরা। ২০১৫ সালের পর আর কখনোই নিউজিল্যান্ডের ক্যাপ ওঠেনি হামিশের মাথায়।