দেশের বেশির ভাগ ক্রিকেটারের আয়ের উৎস ঘরোয়া ক্রিকেট। করোনাভাইরাসে খেলা বন্ধ বলে আর্থিক সংকটে পড়েছেন তাঁরা।
প্রায়ই মাঠে যান এনামুল হক জুনিয়র। সিলেট আন্তর্জাতিক স্টেডিয়ামে জাতীয় দলের ক্রিকেটারদের অনুশীলন শেষ হলে শুরু হয় তাঁর অনুশীলন। তবে বাংলাদেশ দলের খেলোয়াড়েরা অনুশীলন করছেন একটা লক্ষ্য নিয়ে—সামনে শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে টেস্ট সিরিজ। সেখানে ভালো করতে হবে। কিন্তু ঘরোয়া ক্রিকেটের চৌহদ্দিতে আটকে থাকা এনামুলের মতো ক্রিকেটারদের সামনে এই করোনাকালে অন্তত কিছু নেই। কী তাঁদের লক্ষ্য, কোন অনুপ্রেরণায় তাঁরা মাঠে যান প্রতিদিন?
দেশের বর্তমান করোনা পরিস্থিতিতে বিসিবি এখনো ঘরোয়া লিগ বা টুর্নামেন্ট আয়োজনের নিশ্চয়তা দিতে পারছে না। প্রিমিয়ার লিগ স্থগিত হয়ে আছে পাঁচ মাসের বেশি হলো। বিপিএলসহ অন্য লিগগুলো হবে, সে সম্ভাবনাও এখন পর্যন্ত দেখা যাচ্ছে না। তবু মাঠে যাওয়ার কথা বলতে গিয়ে পরশু মুঠোফোনে এনামুলের কণ্ঠটা বেশ করুণ শোনাল, ‘বসে থাকলে বাসার লোকজন ভাবে, মাসের পর মাস ঘরে বসা; কোনো কাজকর্ম নেই! অথচ তারা পত্রিকা-টিভিতে দেখছে, জাতীয় দলের অনুশীলন শুরু হয়েছে। মাঠে গেলে অন্তত সতীর্থদের সঙ্গে দেখা হয়, ওটাই ভালো লাগে। আর সবাই যেন ভাবে, আমি কাজের মধ্যে আছি।’
সত্যি বলতে কী, এখন সঞ্চয় ভেঙে খাচ্ছি। আয় নেই, অথচ ব্যয় আছেমুক্তার আলী
এনামুলের মতো অভিজ্ঞতা হচ্ছে দেশের অনেক ক্রিকেটারেরই। শ্রীলঙ্কা সফর সামনে রেখে জাতীয় দলের খেলোয়াড়েরা সুযোগ পাচ্ছেন মিরপুর শেরেবাংলা স্টেডিয়ামের মাঝ উইকেটে কিংবা ইনডোরে অনুশীলন করার। কিন্তু দেশের বেশির ভাগ ক্রিকেটারই তাকিয়ে অনিশ্চিত ভবিষ্যতের দিকে। আর্থিক সংকটে পড়ে অনেকে চলছেন সঞ্চয় ভেঙে। জীবিকার এই সংকটকালে অনেক খেলোয়াড় ক্রিকেট থেকে দূরে সরে যাওয়ার পরিকল্পনাও করছেন বলে জানালেন রাজশাহীর পেস বোলিং অলরাউন্ডার মুক্তার আলী, ‘সত্যি বলতে কী, এখন সঞ্চয় ভেঙে খাচ্ছি। আয় নেই, অথচ ব্যয় আছে। এ কারণে অনেকে ক্রিকেট থেকে সরে যাওয়ার পরিকল্পনা করছে। কেউ ব্যবসা কিংবা বিদেশে যাওয়ার পরিকল্পনা করছে। সংকটটা দীর্ঘায়িত হলে বিসিবি ভবিষ্যতে ভালো ক্রিকেটার পেতে সমস্যায় পড়বে। ওপরেও খেলোয়াড় পাবে না, নিচেও থাকবে না।’
মুক্তারের আফসোস, কেন যে খেলার পাশাপাশি আরেকটা রোজগারের ব্যবস্থা রাখলেন না! ‘পাঁচ মাস ধরে শুধু অনুশীলন করে যাচ্ছি। খুব হতাশ হয়ে পড়ছি। সারা দিন বসে থাকতে অভ্যস্ত নই। আগে জানলে ক্রিকেটের পাশাপাশি একটা ব্যবসার ব্যবস্থা রাখতাম।’
যেসব ক্রিকেটারের ভিন্ন আয়ের ব্যবস্থা নেই, তাঁদের প্রায় সবাই-ই মুক্তারের মতো সঞ্চয় ভেঙে চলছেন। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক ঘরোয়া ক্রিকেটের সিনিয়র এক ওপেনার অসহায় কণ্ঠে বললেন, ‘সঞ্চয় ভেঙে আর কত দিন খাব! প্রিমিয়ার লিগের পুরো পারিশ্রমিক পেয়েছি গত বছরের মার্চে। আসলে জাতীয় দলের বাইরে কারওই আর্থিক নিশ্চয়তা নেই।’
খেলার তো কোনো খবর নেই। আমার টুকটাক ব্যবসা আছে। সেখানে মাঝেমধ্যে সময় দিইনাজমুল হোসেন
ক্রিকেটহীন এ সময়ে খেলোয়াড়দের অনেকে ঝুঁকে পড়ছেন অন্যদিকেও। বরিশালের পেসার কামরুল ইসলাম যেমন মনোযোগী হয়েছেন পড়াশোনায়, ‘আমি একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে ইংরেজি বিষয়ের ওপর স্নাতক করছি। নিয়মিত অনলাইনে ক্লাস করি এখন। শুনেছি, আমাদের বরিশাল বিভাগের অনেক খেলোয়াড় নানা ধরনের ব্যবসায় নেমেছে। কেউ মাছের ব্যবসা করছে, কেউ জিমনেসিয়াম দিয়েছে।’
মাঠে খেলা নেই মানে আয়ও নেই। সংকট কাটিয়ে উঠতে ‘ছক্কা মিলন’খ্যাত নাজমুল হোসেন তাই সময় দিতে শুরু করেছেন ব্যবসায়, ‘খেলার তো কোনো খবর নেই। আমার টুকটাক ব্যবসা আছে। সেখানে মাঝেমধ্যে সময় দিই। কোনোভাবে চলে যাচ্ছে। অনেকের তো সেটাও নেই!’
ক্রিকেটারদের আর্থিক সংকট নিরসনের উপায় বিসিবিকেই বের করতে হবে বলে মনে করেন এনামুল হক জুনিয়র। প্রথম শ্রেণির ক্রিকেটে ৪৮৪টি উইকেটের মালিক বাঁহাতি স্পিনারের চোখে অবশ্য সমাধান একটাই—মাঠে খেলা ফেরানো, ‘ইংল্যান্ড ক্রিকেট ফেরানোর পরিকল্পনা করেছে, যখন তাদের প্রতিদিন ৮০০-১০০০ জন মারা যাচ্ছিল। আমাদের পরিস্থিতি সে তুলনায় কিছুটা ভিন্ন। নভেম্বরের ফাঁকা সময়ে অন্তত সিঙ্গেল লিগ খেলেও যদি প্রিমিয়ার লিগ শেষ করা যায়, অনেক উপকার হবে। কোনো খেলোয়াড়, কোচ কিংবা ক্লাব এই পরিস্থিতে আমাদের উদ্বুদ্ধ করতে পারবে না। পারবে শুধু বিসিবি। করোনার মধ্যে নানা জায়গায় খেলা হচ্ছে, আমরা কেন পারব না?’
উত্তর কি আছে বিসিবির কাছে?