সেদিন গ্যালারিতে স্ত্রী সানিয়া মির্জাকে দেখে শোয়েব মালিক বাড়তি অনুপ্রেরণা পেয়েছিলেন হয়তো!
না হলে এই বয়সে শোয়েবের ওপর এ শক্তি এসে ভর করবে কেন? খেললেন সাকল্যে ১৮টা বল, এর মধ্যে ছয়বার ক্রিস গ্রিভস, মার্ক ওয়াট আর সাফিয়ান শরিফকে উড়িয়ে সীমানাছাড়া করলেন। পাকিস্তানের ইনিংস যখন শেষ হলো, শোয়েব মালিকের নামের জ্বলজ্বল করছে ৫৪টি রান। জানা গেল, পাকিস্তানের জার্সি গায়ে টি-টোয়েন্টিতে এত কম বলে কেউ ফিফটি করেননি।
এমনকি এই বিশ্বকাপেও এক লোকেশ রাহুল ছাড়া এত কম বলে পঞ্চাশ ছোঁয়ার কৃতিত্ব নেই কারও। তবে একদিক দিয়ে রাহুলের চেয়েও শোয়েব ছিলেন বেশি বিধ্বংসী। রাহুলের ফিফটি ১৮ বলে এলেও ওই ১৮ বলেই শোয়েব করেছেন ৫৪। ৪৮ রানে থাকা অবস্থায় ছক্কা মারলে যা হয় আর কী! প্রেমময়ী স্ত্রীর প্রেরণা পেলে যা হয় আর কী!
ক্রিকেটে গ্যালারি থেকে সঙ্গীর সমর্থন দেওয়ার বিষয়টা আজকের নয়। নিজের ব্যস্ততা থেকে সুযোগ মিললে আনুশকা শর্মা প্রায়ই চলে যান বিরাট কোহলির খেলা দেখতে।
রোহিত শর্মার স্ত্রী রিতিকা সাজদেহ তো গ্যালারির নিয়মিত দর্শক। এমনকি বাংলাদেশের সাকিব আল হাসানের খেলা দেখতেও প্রায়ই মাঠে দেখা যায় উম্মে আল হাসান শিশিরকে। একই কথা প্রযোজ্য এবি ডি ভিলিয়ার্সের স্ত্রী ড্যানিয়েলে ডি ভিলিয়ার্সের ক্ষেত্রেও। এমন উদাহরণ আরও আছে অবশ্যই।
কিন্তু শোয়েব আর সানিয়ার গল্পটা সবার থেকেই যেন একটু আলাদা। দুজন দুজনকে চেনেন সেই ২০০৩ সাল থেকে। পরিণয় ২০১১ সালে। দুই চিরপ্রতিদ্বন্দ্বী দেশের নাগরিক ও দুই খেলার দুই জনপ্রিয় তারকা হওয়া সত্ত্বেও যেভাবে নিজেদের ভালোবাসাকে পরিণতি দিয়েছেন, সেটি অবিশ্বাস্য। আরও অবিশ্বাস্য জাতীয়তাবাদী বিদ্বেষের সামনে একে অন্যের জন্য ঢাল হয়ে দাঁড়ানোটা।
শোয়েবের স্ত্রী সানিয়াকে নিয়ে নতুন করে বলার কিছু নেই। লিয়েন্ডার পেজ-মহেশ ভূপতি জুটির পর ভারত থেকে এত জনপ্রিয় ও সফল টেনিস তারকা বের হননি, তা নিঃসন্দেহে বলা যায়। অন্যান্য অধিকাংশ জনপ্রিয় খেলোয়াড়ের সঙ্গীর সঙ্গে সানিয়ার পার্থক্যের জায়গাটা এখানেই—তিনি নিজেও একজন অ্যাথলেট।
পেশার কারণে একজন ক্রীড়াবিদের জীবন কতটা কঠিন হতে পারে, খেলাধুলা কীভাবে ব্যক্তিগত জীবনের ওপর প্রভাব ফেলতে পারে, সেটা অন্য যেকোনো জীবনসঙ্গীর চেয়ে সানিয়া বুঝবেন ভালো। নিয়ত দুজন দুজনের পেশাকে সম্মান করেছেন, সঙ্গীর সতীর্থদের আপন করে নিয়েছেন। সানিয়া তো পাকিস্তান দলের খেলোয়াড়দের প্রিয় ‘ভাবি’ই হয়ে গেছেন বলতে গেলে!
ওকে পাকিস্তানকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে সানিয়া সেটাই স্বীকারও করেছেন অকপটভাবে, ‘শোয়েবের সতীর্থদের সঙ্গে আমার সম্পর্ক বেশ ভালো। আমি যখন ওদের সঙ্গে দেখা করতে যাই, অনেক সুন্দর সময় কাটে। বিশেষ করে বাবর আজম, ইমাম–উল–হক ও ওয়াহাব রিয়াজের সঙ্গে। আমরা প্রায়ই ঘুরতে বেরোই, ওরা প্রায় আমার সমবয়সী, তাই অনেক মজাও হয় একসঙ্গে। খুবই ভালো ছেলে ওরা। শোয়েবের স্ত্রী বলেই নয়, ওরা আমার বন্ধুও বটে।’
খেলাই দুজনকে এক করেছে। দিল্লির এক জিমে ২০০৩ সালে পরিচয়। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে আরও ভালো করে চেনা দুজনকে। এরপর ২০০৯ সালে না ভারত, না পাকিস্তান—তৃতীয় এক দেশে দেখা হলো দুজনের। দুজনই তখন ছিলেন অস্ট্রেলিয়ার তাসমানিয়ায়।
শোয়েব গিয়েছিলেন জাতীয় দলের হয়ে সিরিজ খেলতে, সানিয়াও গিয়েছিলেন এক টুর্নামেন্টের জন্য। সানিয়ার সঙ্গে সোহরাব মির্জার বাগদান ভেস্তে গেছে তখন, ভাঙা হৃদয়ের প্রভাব পড়েছিল পারফরম্যান্সের ওপরেও। ওদিকে সানিয়ার মতো শোয়েবও ভাঙা হৃদয় নিয়ে ঘুরছিলেন।
আয়েশা সিদ্দিকা নামের এক প্রবাসী নারীর সঙ্গে ফোনে বিয়ে করে প্রতারণার শিকার হয়েছিলেন, যা বিচ্ছেদে গড়ায়। বিদেশের মাটিতে বিদেশি খাবার খেতে খেতে বিরক্ত হয়ে গিয়েছিলেন হয়তো, দুজন খুঁজে খুঁজে ভারতীয় এক রেস্টুরেন্টে তড়কা ডাল আর ভাত খাওয়ার জন্য ছুটেছিলেন।
সেখানেই বুঝলেন, শুধু ডাল–ভাতই নয়, দুজনের পছন্দের সীমা এর চেয়েও বিস্তৃত।
দুজন দুজনকে চিনতে বেশি সময় নিলেন না। বছর পেরোতে না পেরোতেই সিদ্ধান্ত নিলেন বিয়ে করার। তখন প্রশ্ন উঠেছিল, একটু বেশিই তাড়াতাড়ি হয়ে যাচ্ছে না?
আত্মজীবনী ‘এইসেস অ্যাগেইনস্ট অডস’-এ সানিয়া নিজের অবস্থান পরিষ্কার করেছেন সুন্দরভাবে, ‘মানুষ বছরের পর বছর একজনের সঙ্গে প্রেম করার পরে বিয়ের সঙ্গে সঙ্গেই বিচ্ছেদ করে ফেলে। আবার অনেকে কিছুদিন একে অন্যকে চেনার পর বিয়ে করে আজীবন সুখে থাকে। আমরা সৌভাগ্যবান যে আমরা একে অন্যকে খুঁজে পেয়েছি। তাড়াতাড়ি সিদ্ধান্ত নিয়েছি। কারণ, আমরা বুঝতে পেরেছিলাম, আমরা একই রকম চিন্তাভাবনা করি।’
সমর্থকদের প্রিয় ‘শোয়ানিয়া’র সেই সিদ্ধান্তটা যে ভুল ছিল না, তা প্রায় এক যুগ পর দুজনের রসায়নটা দেখেই বোঝা যায়!