ক্রিকেট বলের গল্পটা দারুণ
ক্রিকেট বলের গল্পটা দারুণ

লাল, সাদা, গোলাপি—ক্রিকেট বলের গল্পটা শুনুন

ক্রিকেটের প্রথম প্রচলন হয়েছিল কোথায়? ইতিহাস বলছে, ইংল্যান্ডের দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চলে ষোড়শ শতকে খেলাটির উৎপত্তি। এরপর ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসনের বিস্তারের মাধ্যমে এটি ছড়িয়ে পড়ে ইংল্যান্ডের বাইরে, যদিও ক্রিকেটের প্রথম আন্তর্জাতিক ম্যাচ অনুষ্ঠিত হয়েছিল উনিশ শতকের দ্বিতীয় ভাগে এসে।

বলা বাহুল্য, ক্রিকেটে মৌলিক কতগুলো জিনিসের প্রয়োজন হয়। সবচেয়ে দরকারি অনুষঙ্গ হলো ব্যাট ও বল। শতাব্দীর পর শতাব্দী পেরিয়ে ক্রিকেট ব্যাটের অনেক কিছুতেই পরিবর্তন এসেছে। এটি পেয়েছে নানা আকৃতি। আজকের এ জায়গায় আসতে ক্রিকেট ব্যাটকে পাড়ি দিতে হয়েছে অনেকটা পথ। তবে ক্রিকেট বল কিন্তু শুরুতে যেমন ছিল, এখনো প্রায় তেমনই আছে। একটু এদিক-ওদিক হয়েছে, সেটি সময়ের চাহিদা বিবেচনা করেই।

ক্রিকেট বলের বিবর্তন খুব একটা হয়নি

ক্রিকেট বলের বাইরের আবরণ থাকে চামড়ার। এটিকে অনেকে কাঠের বল বললেও ক্রিকেট বল তৈরিতে কাঠ ব্যবহার করা হয় না। বরং ব্যবহৃত হয় কর্ক। অনেকগুলো ছোট কর্কের টুকরা চামড়ার আবরণ দিয়ে মুড়িয়ে সেলাই দেওয়া হয়। সেলাইয়ের মাঝখানে দেওয়া হয় আঠা। ক্রিকেটের আইন অনুযায়ী একটি মানসম্মত ক্রিকেট বলে অবশ্যই ছয়টি সেলাই থাকতে হয়।

ক্রিকেট বলের উদ্ভাবক কে

১৭৬০ থেকে ১৮৪১ সালের মধ্যে প্রথম ক্রিকেট বল তৈরি করা হয়। অনেকেই বলেন, ক্রিকেট বল প্রথম তৈরি করে ইংল্যান্ডের ডিউক পরিবার। সে সময় ডিউকরা ইংল্যান্ডের কেন্ট কাউন্টির পেনসহার্স্ট অঞ্চলের রেডলিফ হিল এলাকায় ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্প ব্যবসায় নিয়োজিত ছিল। ১৭৭৫ সালে ডিউকরা ক্রিকেট বল তৈরির জন্য ব্রিটেনের রাজা চতুর্থ জর্জের কাছ থেকে পেটেন্ট অর্জন করে। তারা সেই সময় ছয় সেলাইবিশিষ্ট ক্রিকেট বল তৈরি ও বাজারজাত করা শুরু করে। তাদের বলই ১৭৮০ সালের ক্রিকেট মৌসুমে ব্যবহার করা হয়। ক্রিকেট খেলাটা কেন্ট, সাসেক্সসহ ব্রিটেনের বিভিন্ন এলাকায় দ্রুত জনপ্রিয়তা অর্জন করে। একই সঙ্গে ডিউক পরিবারও এর ইতিহাসের অংশ হয়ে যায়। ক্রিকেটকে জনপ্রিয় করা ও ছড়িয়ে দেওয়ার পেছনে ডিউক পরিবারের অবদান কম নয় মোটেও। তারা কেবল বল তৈরির ব্যবসাতেই মনোযোগী ছিল না, মনোযোগী ছিল ক্রিকেট খেলাটার প্রচার ও প্রসারেও।

ইংল্যান্ডে সব সময়ই ডিউক বল দিয়ে খেলা হয়েছে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের আগপর্যন্ত ক্রিকেট বল বলতে সবাই বুঝত ডিউক ব্র্যান্ডের বল। এটা ব্যবহৃত হতো দুনিয়াজুড়ে। তবে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর থেকে অস্ট্রেলিয়া নিজেদের ব্র্যান্ডের বল তৈরি করার চিন্তাভাবনা শুরু করে। সে অনুযায়ী টম্পসন পরিবারের মালিকানাধীন কুকাবুরা কোম্পানি অস্ট্রেলিয়ান ক্রিকেট বোর্ডের কাছ থেকে ক্রিকেট বল তৈরির অনুমোদন লাভ করে। এই কুকাবুরার তৈরি লাল বলের চেয়ে এ যুগে অবশ্য সাদা বলই পৃথিবীতে বেশি পরিচিত। এ সময় সীমিত ওভারের ক্রিকেটের জন্য যে সাদা বল ব্যবহার করা হয়, তার বেশিরভাগই কুকাবুরা কোম্পানির তৈরি। এ মুহূর্তে কুকাবুরা হচ্ছে ক্রিকেট বলের বৃহত্তম প্রস্তুতকারক। সেটি লাল, সাদা কিংবা গোলাপি যে রঙেরই হোক।

কুকাবুরার সাদা বল সীমিত ওভারের ক্রিকেটকে আকর্ষণীয় করেছে

এ মুহূর্তে ডিউক ও কুকাবুরার পাশাপাশি ভারতভিত্তিক স্যানসপ্যারেইলস গ্রিনল্যান্ড কোম্পানির (এসজি) তৈরি ক্রিকেট বলও বাজারে চলছে। এসজি ব্র্যান্ডের বল আন্তর্জাতিক ক্রিকেটেও ব্যবহার করা হয়। বিভিন্ন দেশের ঘরোয়া ক্রিকেটেও এসজি বলের যথেষ্ট চাহিদা। এসজি প্রথম ক্রিকেট বল তৈরি করে ১৯৩১ সালে। দুই ভাই কেদারনাথ আনন্দ ও দ্বারকানাথ আনন্দই মূলত এই এসজি কোম্পানির প্রতিষ্ঠাতা। এ ব্র্যান্ডের বলেরও যথেষ্ট সুনাম আছে ক্রিকেট দুনিয়ায়। সীমিত ওভারের ক্রিকেটে ব্যবহৃত সাদা বলের ক্ষেত্রে এসজির গুণাগুণ অনেকটাই কুকাবুরা বলের কাছাকাছি। ১৯৯৪ সাল থেকে ভারতের মাটিতে অনুষ্ঠিত টেস্ট ম্যাচগুলোতে ব্যবহার করা হচ্ছে এই এসজি বল।

তিনটি প্রতিষ্ঠানের বলই ব্যবহার হয় আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে

ক্রিকেট উদ্ভাবন থেকে এর বলের রং লালই ছিল দীর্ঘদিন। ১৯৭৭ সালে অস্ট্রেলিয়ায় মিডিয়া টাইকুন ক্যারি প্যাকারের উদ্যোগে সীমিত ওভারের ক্রিকেট ফ্লাডলাইটের আলোতে আয়োজনে প্রয়োজন দেখা দেয় সাদা রঙের বলের। সেটি ছিল ক্রিকেটের এক বড় বিপ্লব। প্রথম দিকে উদ্যোগটি নিয়ে ক্রিকেট রোমান্টিকরা নাক সিঁটকালেও সাদা বলের ক্রিকেট এখন আধুনিক ক্রিকেটের বড় সম্পদ। সাদা বল সুইং ও গতিশীলতায় লাল বলের চেয়ে অনেকটাই এগিয়ে। ক্রিকেটকে আকর্ষণীয় ও আর্থিকভাবে শক্তিশালী করতেও সাদা বলের একটা বড় অবদান আছে। ক্রিকেটে বোলারদের আরও একটি শক্তিশালী অস্ত্র রিভার্স সুইংয়েও দারুণ কার্যকর সাদা রঙের ক্রিকেট বল। সাধারণত সাদা বল পুরোনো হয়ে গেলে এতে খুব ভালো রিভার্স সুইং করাতে পারেন বোলাররা। তবে ক্রিকেটের বড় সংস্করণে (টেস্ট ম্যাচ) লাল বল চিরন্তন। সাদা বলের তুলনায় লাল বল বেশি সময় খেলার উপযোগী থাকে। এটি ঔজ্জ্বল্যও হারায় সময় নিয়ে, ধীরে ধীরে।

টি-টোয়েন্টি ও ওয়ানডে ক্রিকেটের এ যুগে ৫ দিনের টেস্ট ম্যাচকে বাঁচিয়ে রাখা অনেক বড় এক চ্যালেঞ্জ। যত দিন যাচ্ছে, মানুষের হাতে সময় কমে আসছে। মানুষের ব্যস্ততা এখন এতটাই যে পাঁচ দিন ধরে একটি টেস্ট ম্যাচ কিংবা তিন–চার দিনের একটি প্রথম শ্রেণির ম্যাচ দেখা তাদের পক্ষে কঠিন। টেস্ট ক্রিকেটকে বাঁচাতে, এটিকে আকর্ষণীয় করতে দিনরাতের টেস্ট ম্যাচ আয়োজিত হচ্ছে এখন। ফ্লাডলাইটে সন্ধ্যার সময় টেস্ট ক্রিকেট একসময় অসম্ভব এক বিষয় হলেও হালের দুনিয়ায় এখন এটাই বাস্তব। আর দিনরাতের টেস্ট ম্যাচের জন্য ক্রিকেট বলের আরও একটি ধরনের উদ্ভব হয়েছে—গোলাপি বল। হ্যাঁ, লাল, সাদার পর ক্রিকেটে ধরেছে গোলাপি রং–ও। ২০১৫ সালে অ্যাডিলেডে অস্ট্রেলিয়া প্রথম দিনরাতের টেস্ট ম্যাচ আয়োজন করলেও ২০০৯ সাল থেকেই মেরিলিবোন ক্রিকেট ক্লাব (এমসিসি) এই গোলাপি বলের পরীক্ষা-নিরীক্ষা শুরু করে। তারা পরীক্ষা করে দেখে, দিনরাতের টেস্ট ম্যাচে গোলাপি রঙের বল কতটা দৃষ্টিবান্ধব, বিভিন্ন কন্ডিশনে এ বল কতটা উপযোগী, সেটিও পরীক্ষা করে দেখে এমসিসি। যেহেতু লাল বল ফ্লাডলাইটের আলোয় উপযোগী নয়, তাই গোলাপি বল ফ্লাডলাইটের আলোয় কতটা উপযোগী, সেটি ব্যাপক আকারে পরীক্ষা করে দেখা হয়।

২০১৫ সালে অ্যাডিলেডে অস্ট্রেলিয়া ও নিউজিল্যান্ডের মধ্যে অনুষ্ঠিত প্রথম দিনরাতের টেস্টে বোঝা যায়, লাল বলের চেয়ে গোলাপি বলের সুইং অনেক বেশি। বিশেষ করে ফ্লাডলাইটের আলোয় গোলাপি বল ফাস্ট বোলারদের কিছু বিশেষ সুবিধাও দেয়।

গোলাপি বল হাল আমলের টেস্ট ক্রিকেটের সৌন্দর্য

ক্রিকেট বলের বিভিন্ন দিক

ব্রিটিশ স্ট্যান্ডার্ড বিএস৫৯৯৩ অনুসারে ক্রিকেট বলের মান নিয়ন্ত্রিত হয়। সে অনুযায়ী এর আকার, আকৃতি, গুণগত মান, কাঁচামাল ও এর ব্যবহারের উপযোগিতা নির্ধারিত। ১৭৪৪ সালে তৈরি ক্রিকেট আইন অনুযায়ী একটি ক্রিকেট বলের ওজন ৫ থেকে ৬ আউন্সের মধ্যে নির্ধারিত। ১৭৭০ সালে নতুন করে ক্রিকেট বলের ওজন ৫ থেকে ৫.৭৫ আউন্সের মধ্যে নির্ধারিত হয়। এর পরিধি নির্ধারিত ৮.৮১২৫ থেকে ৯ ইঞ্চির মধ্যে।

এ মুহূর্তে ডিউক, কুকাবুরা, এসজি—এই তিনটি ব্র্যান্ডের ক্রিকেট বলই আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে ব্যবহার করা হয়। ডিউক বল ব্যবহৃত হয় ইংল্যান্ড ও ওয়েস্ট ইন্ডিজে। এসজি ভারতে। কুকাবুরা ব্যবহার করা হয় অস্ট্রেলিয়া ও অন্যান্য ক্রিকেট খেলুড়ে দেশে। ডিউক, কুকাবুরা ও এসজির তৈরি বলই ক্রিকেটের সর্বোচ্চ সংস্থা আইসিসির কাছে অনুমোদন পেয়েছে।