কাল ১৫ বলে ৪০ রান করেছিলের রিংকু
কাল ১৫ বলে ৪০ রান করেছিলের রিংকু

রিংকু সিং তো মাঠে নামার আগেই জিতেছেন

রিংকু সিং কাল জেতেননি। ২১১ রান করতে হতো কলকাতাকে। ৬ উইকেট পড়ল ১৫০ রানে, সাজঘরের পথে হাঁটলেন আন্দ্রে রাসেলও। সেখান থেকে রিংকু চেষ্টা করলেন, ১৫ বলে ৪০ রান করলেনও। তবে শেষতক আর পারলেন না। দলকে জেতাতে পারলেন না রিংকু।

কাল আইপিএলের একটি ম্যাচে জিততে না পারলেও রিংকু জীবনের মাঠে আগে অনেকবারই জিতেছেন। আলীগড়ের এক নিম্নমধ্যবিত্ত পরিবারের সন্তান। ‘নুন আনতে পান্তা ফুরোয়’ বাগধারার সার্থক প্রয়োগ ঘটে বেলায় বেলায়। বাবা সংসার চালাতেন বাড়ি বাড়ি গ্যাসের সিলিন্ডার সরবরাহ করে। দিল্লির একটা টুর্নামেন্টে ম্যান অব দ্য টুর্নামেন্ট হলেন রিংকু, পেলেন মোটরবাইক। বাবার হাতে তুলে দিলেন বাইকের চাবি। এতে সিলিন্ডার সরবরাহের কাজটা আরও সহজ হয় তাঁর।

রিংকু পরে আরও একবার জিতেছিলেন। সেই জয় ক্রিকেটটা ছেড়ে দেওয়ার উপক্রম হওয়ার পরও খেলাটায় টিকে থাকা। রিংকুর পরিবার তখন দেনার দায়ে হাবুডুবু খাচ্ছে। অনূর্ধ্ব-১৯ পর্যায়ে খেলার সময় যে দৈনিক ভাতা পেতেন, তা জমিয়েও মেটানো যায়নি কর্জ। বাধ্য হয়েই খুঁজেছিলেন বিকল্প পেশা। শোনা যায়, ঝাড়ুদার হিসেবেও কয়েকটা দিন কাটিয়েছিলেন আলীগড়ের মহল্লায়।

ক্রিকেটকে আঁকড়ে ধরেই রিংকু সিংয়ের বেঁচে থাকা

ওই দুঃস্বপ্নের দিনগুলোয় ক্রিকেট ছেড়ে দেওয়াটাই স্বাভাবিক হতো, হয়তো বেশির ভাগ লোকে সেটাই করত। তবে রিংকু ছাড়েননি, বরং ক্রিকেটটাকে আঁকড়ে ধরেছিলেন আরও শক্ত করে। ভাগ্যিস, ধরেছিলেন! নয়তো আইপিএলের নিলামের টেবিলে সেদিন জিততেন কী করে!

২০১৮ সালের নিলামে নাম লিখিয়েছিলেন, কেউ কিনবেন বলে আশাই করেননি। আর কিনলেও ভিত্তিমূল্য ২০ লাখ রুপি জুটবে বলেই ধরে নিয়েছিলেন। কিন্তু সেদিন তাঁকে নিয়ে কাড়াকাড়ি পড়ে গেল মুম্বাই ইন্ডিয়ানস আর কলকাতা নাইট রাইডার্সের মধ্যে। দাম উঠল ৮০ লাখ রুপি। ওই অর্থযোগেই ভালো একটা বিয়ে দেওয়া গেল বড় ভাইকে, বড় বোনের বিয়ের জন্যও ব্যাংকে জমা পড়ল কিছু পরিমাণ অর্থ।

তবে অর্থযোগ ঘটলেও কেকেআর রিংকুকে বেঞ্চেই বসিয়ে রাখল বরাবর। করোনার কারণে আইপিএলের নিলামচক্রটা তিনের জায়গায় বেড়ে হলো চার বছর। প্রতিবছরই মাঠে নামলেন, তবে বদলি ফিল্ডার হিসেবে। ম্যাচসংখ্যাটা তাই চার বছরে দুই অঙ্কের ঘর ছুঁল কোনোক্রমে, হলো ১১।

ওই ১১ ম্যাচেও সাকল্যে সংগ্রহ ৭৭ রান। তবে ফ্র্যাঞ্চাইজি-কর্তাদের মন জয়ের কাজটা ঠিকই হয়ে গেছে। মাঠের বাইরের আমুদে রিংকুর ভূমিকা আছে, আন্দ্রে রাসেলের স্ত্রী পর্যন্ত রিংকু বলতে পাগল। এবারকার আইপিএলে নিলামেও তাই ফের রিংকুকে দলে ভেড়াল কেকেআর। কেকেআরের মালকিন জুহি চাওলার মেয়ে জাহ্নবী মেহতা বলেন, রিংকু ড্রেসিংরুম পুরো মাতিয়ে রাখেন। দারুণ ছেলে!

তা রিংকু যত ভালো ছেলেই হোন না কেন, সমর্থক-সমালোচকেরা তো দেখবেন মাঠের পারফরম্যান্সটাই। সেটা সেভাবে হচ্ছিল না বলে নিলামে তাঁর দাম নিয়ে ব্যঙ্গ-বিদ্রূপ হলো বিস্তর। ময়দানে নামলেন সৃজিত মুখার্জিও। কলকাতার এক পত্রিকায় আবার জাহ্নবীর বক্তব্যের তরজমা করা হলো এমন, ‘মানে? কৌতুকরস আমদানির জন্য এত দামে রিংকু দলে নাকি?’

মাঠে হারলে কিছু এসে যায় না, জীবনের লড়াইয়ে যে বহুবার জিতেছেন রিংকু

রেকর্ড বইয়ের পাতাটা একটু উল্টেপাল্টে দেখলেই অবশ্য জানতে পারার কথা, উত্তর প্রদেশের হয়ে ঘরোয়া মৌসুমটা দুরন্তই কেটেছে রিংকুর। এবারের আইপিএল মৌসুম শুরুর আগে সৈয়দ মুশতাক আলী ট্রফিতে উত্তর প্রদেশের হয়ে ৫ ম্যাচে ব্যাট হাতে ২ অর্ধশতকে করেছেন ১৮৭ রান, স্ট্রাইক রেট ১৪৬.০৯। আর লিস্ট ‘এ’ টুর্নামেন্ট বিজয় হাজারে ট্রফিতে করেছিলেন ৭ ম্যাচে ৩৭৯ রান। ৮৯.১৭ স্ট্রাইক রেটের চেয়ে গড়টাই বেশি, ৯৪.৭৫!

সাম্প্রতিক পরিসংখ্যানটা বোধ হয় অজানা ছিল ব্রেন্ডন ম্যাককালামের নেতৃত্বাধীন কেকেআর ম্যানেজমেন্টেরও। এমনিতেই নিলাম টেবিলে গুবলেট পাকিয়ে ফেলেছিলেন সুহানা খান-আরিয়ান খানরা। তবু প্রথম কয়েক ম্যাচে রিংকুর বদলে অন্যদেরই বাজিয়ে দেখতে চাইলেন কোচ-অধিনায়ক। লাভ হলো না। ভরসা খুঁজতে হলো রিংকুতে।

প্রথম ম্যাচেই ২৮ বলে ৩৫ রানের ইনিংসে আভাস দিলেন কিছুটা, দিল্লি ক্যাপিটালসের বিপক্ষে পরের ম্যাচে করলেন ১৬ বলে ২৩। তবে নিজের গল্পটা জানানোর সুযোগ পেলেন রাজস্থানের বিপক্ষে ম্যাচে, ২৩ বলে অপরাজিত ৪২ রানের ইনিংস খেলে হয়েছিলেন ম্যাচসেরা।

দুই নম্বর ম্যাচসেরার পুরস্কার জেতার সুযোগ এসেছিল গতকাল, লক্ষ্ণৌ সুপার জায়ান্টসের বিপক্ষে ম্যাচে। যখন উইকেটে নামলেন, কলকাতাকে টুর্নামেন্টে টিকে থাকতে করতে হতো ২৬ বলে ৬৯ রান। আন্দ্রে রাসেল প্যাভিলিয়নে ফিরতে ফিরতে সমীকরণটা হয়ে গেল ২০ বলে ৬১। রিংকু নিয়ে গেলেন ২ বলে ৩ রান চাই দূরত্বে। ফিরলেন অবশ্য সেখান থেকেই। কলকাতাও আর এগোতে পারল না তাঁকে ছাড়া!

মাঠের লড়াইয়ে রিংকু কাল হেরেই গেলেন। অবশ্য, এই হারে কীই-বা এসে-যায়! জীবনের লড়াইয়ে তো বহুবার জিতেছেন তিনি।