বিদায় আমলা

রংধনুর দেশ তার রং হারাল

হাশিম আমলা—নামটা ভাস্বর হয়ে থাকবে ক্রিকেটপ্রেমীদের মনের মণিকোঠায়। ছবি: টুইটার
হাশিম আমলা—নামটা ভাস্বর হয়ে থাকবে ক্রিকেটপ্রেমীদের মনের মণিকোঠায়। ছবি: টুইটার
>দক্ষিণ আফ্রিকা সাদা-কালোসহ সব জাতির দেশ হবে—এ ঘোষণা করে ‘রংধনু দেশ’ নামটি দিয়েছিলেন নেলসন ম্যান্ডেলা। কাল হাশিম আমলা আন্তর্জাতিক ক্রিকেট ছেড়ে দেওয়ার পর সংবাদমাধ্যমে ‘রংধনু তার রং হারাল’ শিরোনামে লিখেছেন দক্ষিণ আফ্রিকা দলের পারফরম্যান্স বিশ্লেষক প্রসন্ন আগোরাম। লেখাটি সংক্ষেপে প্রথম আলোর পাঠকদের জন্য তুলে ধরা হলো

আমার দেখা সেরা মানুষটি নিয়ে এ লেখা কোত্থেকে শুরু করতে পারি। গোটা দুনিয়া তাঁকে সেরা ব্যাটসম্যান হিসেবে জানে। অবশ্যই সে তাই—কিন্তু সে কতটা অসাধারণ মানুষ, তা নিয়েই আমার যত স্মৃতি। অনেক গল্প আছে—কিছু গল্প আমাকে এখনো আপ্লুত করে। তবে ভক্তরা যেন এই বিরল মানুষটি সমন্ধে ধারণা পেতে পারে, সে জন্য কিছু বলা প্রয়োজন। তাই তাঁর ঘরে রাতের খাবারের সেই ঘটনাটা দিয়ে শুরু করছি।

খাওয়া শেষ করে ভাবছিলাম প্লেটটা কোথায় রাখব। হাশিম আমলা হঠাৎ আমার হাত থেকে প্লেটটা নিয়ে নিল, খাবারের উচ্ছিষ্ট ময়লা রাখার ঝুড়িতে ফেলে প্লেটটা রাখল বেসিনে। ঘটনার আকস্মিকতায় অস্ফুট স্বরে প্রতিবাদ জানিয়ে কিছু বলতে যাব, তার আগেই সে বলল, ‘আরে ভাই, আপনি আমার ঘরে এসেছেন। আপনি আমার ভাই। কিছু ক্ষেত্রে আমার ওস্তাদও। আপনাকে সম্মান করার সুযোগটুকু দিন।’

আরেকটি খাওয়ার ঘটনা, আরেকটি স্মৃতি। আমি অতটা খেতে পারি না, আর সেদিন প্লেটের খাবারও শেষ করতে পারিনি। উঠে দাঁড়াব, এমন সময় সে বলল, ‘ভাই, খাবার নষ্ট করবেন না।’ এরপর সে আমার প্লেটে খাবারের অবশিষ্ট অংশ নিজের প্লেটে নিয়ে খেতে শুরু করল। আমি আবারও হতবাক, সেদিন বুঝেছি ভালো মানুষ হয়ে উঠতে জীবনে কী কী পরিবর্তন দরকার। হাশিম এ ব্যাপারে আমার ওস্তাদ।

এবার একটি ক্রিকেটের গল্প। আর এ গল্পটাও বুঝিয়ে দেবে হাশিম কেমন মানুষ। ২০১২ সালে এটি ছিল অস্ট্রেলিয়ায় সিরিজ ফয়সালা হওয়ার টেস্ট। এ সংস্করণে শীর্ষ দল হতে আমাদের জিততে হতো। দ্বিতীয় দিনের শেষ সেশনে আমরা দ্বিতীয়বারের মতো ব্যাট করছিলাম। লিড ছিল ৬০ রানের মতো। প্যাড পরার সময় সে সব সময় আমাকে জিজ্ঞেস করত, ‘কীভাবে খেলব?’ সেদিন ম্যাচের পরিস্থিতি বুঝে তাঁকে বললাম, ‘ভাই, প্রতি আক্রমণ করো। দিনের খেলার আরও ৩৮ ওভার বাকি ছিল। এর মধ্যে ১৪০ রানের মতো তুলতে পারলে লিড ২০০ হয়ে যাবে। আর কাল আরও ৮০ রানের মতো যোগ করা সম্ভব—২৭৫ রানের ওপাশে যেতে পারলে জয়ের আশাটা বাড়বে। তাই আমার মতে আজ আক্রমণাত্মক ব্যাটিং করা উচিত।’ অবশ্যই এ কথাগুলো মাঠে ফলানোর চেয়ে বলা খুব সহজ। মিচেল স্টার্কের নেতৃত্বে অস্ট্রেলিয়ার আক্রমণভাগ ছিল দুর্দান্ত।

কিন্তু আমলা এত বেশি আক্রমণাত্মক ছিল যে একপর্যায়ে কোচ গ্যারি কারস্টেন এসে আমাকে জিজ্ঞেস করল তাঁকে কী বলেছি। ‘কিছুই না কোচ’—বললেও গ্যারি একটু হেসে সত্যটা বলতে বলল। এরপর আর গোপন রাখিনি। আলাপচারিতাটুকু বলে দিলাম। গ্যারি আবারও হেসে বলল, ‘হাশিম আজ অপরাজিত থাকলে তাঁকে বলবে কাল ধীরে খেলতে—ম্যাচে এখনো তিন দিন আছে। খেলা এত দ্রুত শেষ করার প্রয়োজন নেই।’

দিনের খেলা শেষে সে ড্রেসিং রুমে ফিরে জিজ্ঞেস করল, ‘ভাই জান, আপনি খুশি তো?’ আমরা ওই ৩৮ ওভারে ২৩২ রান তুলেছি আর দ্বিতীয় দিন শেষে এগিয়ে ছিলাম ৩০০ রানে। ‘ভাই, আপনার ডাবল সেঞ্চুরি পাওনা ছিল’—আমি এ কথা বলার পর জানেন সে কী বলেছে। ‘একটা কথা মনে রাখবেন, জীবনে কখনো কিছু পাওনা থাকে না। পুরোটাই সৃষ্টিকর্তার কৃপা। মনে আছে, আমি ৪ রানে থাকতে একটি ডেলিভারি ব্যাটের কানায় লেগে স্টাম্পের খুব কাছ ঘেঁষে চলে গেছে। ওটা বোল্ড হওয়া উচিত ছিল, ডেলিভারিটা ছিল দারুণ। অস্ট্রেলিয়ানদের উইকেটটা পাওনা ছিল। ওরা হয়তো ড্রেসিং রুমে আলোচনা করছে, আমি কত ভাগ্যবান, ১৯২ রান করেছি, যা পাওনা ছিল এটা তার চেয়েও বেশি। এ কারণে আমি যে রান করেছি তা নিয়েই কৃতজ্ঞ। সব সময় সন্তুষ্ট থাকুন।’

সে আসলেই এমন মানুষ। যদি বলি ভালো খেলেছ কিংবা অসাধারণ ব্যাট করেছ, সে বলবে, ‘সৃষ্টিকর্তার অনুগ্রহ। আপনাদের সবাইকে ধন্যবাদ।’ কিংবা প্রসঙ্গ পাল্টে বলবে, ‘আমার ইনিংসের চেয়ে ডেল স্টেইনের ৩ উইকেট অনেক মূল্যবান ছিল।’ আমি যেমন কখনো তাঁকে রাগতে দেখিনি, তেমনি গর্ব করতেও দেখিনি। এমনকি খুব ব্যক্তিগত পরিবেশেও নয়। কারণ সে অভিনেতা নয়—সে এমনই।

২০১০ সালের একটি স্মৃতি। সে বছর তাঁর সঙ্গে প্রথম দেখা হয়। ভারত তখন দক্ষিণ আফ্রিকা সফর করছে। হাশিম এসে বলল, ‘একটু সাহায্য করতে পারেন?’ আমি বললাম, আপনি জীবনের সেরা ফর্মে, কী আর সাহায্য করতে পারি? ‘না, না, আমি সিরিয়াস। কেউই নিখুঁত নয়। সবশেষ সিরিজে আপনার বিশ্লেষণ আমার ভালো লেগেছে। আমি আরও শিখতে চাই, বেড়ে উঠতে চাই। খেলাটা তো যে কারও চেয়ে বড়। কেউ সব শিখতে পারে না। পেসারদের ভালো খেলছি কিন্তু হরভজন সিংকে সামলাব কীভাবে? সে এ উইকেটে বাউন্স পাবে।’

এভাবে সময় গড়িয়ে আমরা ঘনিষ্ঠ হয়েছি। প্রায় প্রতি রাতেই সে আমার কামরায় এসে চা খেত, ক্রিকেট কিংবা যা ভাবছে তা নিয়ে আলাপ করত। পছন্দের ভাত ও রুটি খেতে পারছি না বুঝতে পারলে আমাকে সে তাঁর বন্ধুর বাসায় নিয়ে গিয়ে খাওয়ার ব্যবস্থা করত। আমি এসব কিছুই মিস করব।

খাওয়া-দাওয়ার আরেকটি গল্প আছে যা সবার সঙ্গে ভাগ করতে চাই। এটা ছিল ২০১৫ সাল, বেঙ্গালুরুতে ঝুম বৃষ্টিতে ভেসে গেছে টেস্টের চার দিন। আমি সব সময় টিম হোটেলেই থাকি। এমনকি আইপিএলেও বাড়িতে যাই না। কিন্তু আবহাওয়া এমন ছিল যে টিম ম্যানেজমেন্ট থেকেই বাসায় যেতে বলা হলো। হাশিমসহ আরও কয়েকজনকে বাসায় নিয়ে যেতে চাইলাম, কিন্তু আমি যে ফ্ল্যাটে থাকি সেখানকার নিরাপত্তা নিয়ে শঙ্কায় ছিলেন নিরাপত্তাকর্মীরা। তাই আমি একাই যাই। সেদিন বিকেল সাড়ে চারটার দিকে ইমরান তাহির ও এক নিরাপত্তাকর্মী নিয়ে দরজায় হাজির হাশিম। কী করব বুঝতে পারছিলাম না। ঘরে চারজন মানুষের বসার মতো ব্যবস্থাও ছিল না। শুধু একটাই সোফা। হাশিম ভেতরে ঢুকে মেঝেতে বসে পড়ল। তাঁকে মানা করতেই বলল, ‘আপনার ঘরের মাপ নিতে এখানে আসিনি। ভালোবাসা থেকে এসেছি। আপনি আমার ভাই। দয়া করে এক পেয়ালা মসলা চা দিন।’ সে এটা খুব পছন্দ করে এবং আরেক পেয়ালা চাইল!

এই বিশ্বকাপ তাঁর প্রত্যাশামতো হয়নি। তাঁকে বলেছিলাম আমার একটা অনুরোধ আছে। বললাম, অবসর নিয়ো না ভাই! সে বলল, ‘এ নিয়ে এখনো কিছুই ভাবিনি। সবকিছু মনের ওপর নির্ভর করছে এরপর সৃষ্টিকর্তা। এবং আমি তা অনুসরণ করব। এখানে আমার কোনো স্বার্থ নেই। এটা দলীয় ব্যাপার। তাই দয়া করে এসব বলবেন না। আমি এটা করতে পারব না।’ আসলে হাশিম আমলা একজনই। আমার সন্তান তাঁর ব্যক্তিত্বের ৫০ শতাংশ পেলেও গর্ব লাগবে। নিজেকে একজন গর্বিত বাবা বলেই মনে করব। তাঁর মতো এতটা বিনয়ী, নিঃস্বার্থ ও মাটির মানুষ আর কাউকে দেখিনি।

তাঁকে নিয়ে নিজের ইচ্ছের ব্যাপারে মনের মধ্যে একটা ছবি ভাসছে। হাশিম আমলা তাঁর ঘরের মাঠ ডারবানে অবসর নিচ্ছেন। হাত তুলে জবাব দিচ্ছে দর্শক অভিবাদনের। ‘এ সম্মানটুকু আপনার প্রাপ্য’—বলতেই বুঝলাম তাঁকে আরও ভালো করে জানা উচিত ছিল, কারণ জবাব এল, ‘আপনাকে তো বলেছি, জীবনে প্রাপ্য বলে কিছু নেই। আমি যথেষ্ট পেয়েছি, ১০০ টেস্ট খেলেছি। বিশ্বকাপ শেষে থেমে যাওয়াটাও খুব ভালো, তরুণেরা সুযোগ পাবে। বিদায় সংবর্ধনা পেতে ঝুলে থাকলে নিজের কাছেই নিজের সম্মান থাকবে না। এটা দল কিংবা দেশের স্বার্থের সঙ্গে যায় না। আর সৃষ্টিকর্তা আমাকে যা দিয়েছেন তা নিয়ে আমি সন্তুষ্ট ও কৃতজ্ঞ।’