>এনামুল হক জুনিয়র সিলেটের সন্তান। তাঁর শহরেই প্রথমবারের মতো হচ্ছে টেস্ট। শফিকুল হক, গোলাম ফারুক, হাসিবুল হোসেন ও রাজিন সালেহর সঙ্গে এনামকেও সম্মাননা জানানো হয়েছে। ক্যারিয়ার এখনো শেষ হয়নি। বাংলাদেশের খেলা টেস্টে যখন এভাবে সম্মাননা পান, কেমন লাগে তাঁর?
‘কোথায় যাচ্ছেন?’—গ্র্যান্ডস্ট্যান্ডের প্রবেশমুখে পরিচিত কণ্ঠ শুনে থমকে দাঁড়াতে হয়। আরে, এনামুল হক জুনিয়র! তিনি সিলেটের সন্তান। প্রথমবারের সিলেটে টেস্ট হচ্ছে, বিসিবির আমন্ত্রণে এসেছেন ঐতিহাসিক মুহূর্তের সাক্ষী হতে। ক্রেস্ট দিয়ে শফিকুল হক, গোলাম ফারুক, হাসিবুল হোসেন ও রাজিন সালেহর সঙ্গে তাঁকেও সম্মাননা জানানো হয়েছে লাঞ্চ বিরতিতে।
ক্রেস্টটা নিয়েই এনামুল এলেন প্রেসবক্সে। আড্ডায় মেতে উঠলেন পরিচিত সাংবাদিকদের সঙ্গে। সিনিয়র এক সাংবাদিক কৌতুক করেই জানতে চাইলেন, ক্রেস্টেও ‘জুনিয়র’ শব্দটা ব্যবহার করেছে কি না। আসলেই তো, ক্রেস্টেও লেখা ‘এনামুল হক জুনিয়র’। কিন্তু জুনিয়র তাঁর পিতৃপ্রদত্ত নাম নয়। সনদ কিংবা পাসপোর্টেও লেখা হয় না এই নাম। কিন্তু দেশের ক্রিকেটাঙ্গনে তিনি ‘এনাম জুনিয়র’ হিসেবে পরিচিত। কেন জুনিয়র সেটি তো জানেনই। আরেক বাঁহাতি স্পিনার ও মাঝে আম্পায়ারিংয়ে জড়িয়ে পড়া এনামুল হক মনি হচ্ছেন ‘সিনিয়র’। ক্রিকেটে কে আগে এসেছেন, কে পরে এসেছেন, এটির ওপর নির্ভর করে ‘সিনিয়র’-‘জুনিয়র’ পরিচিতি। মেহরাব হোসেন জুনিয়রও যেমন আছে বাংলাদেশের ক্রিকেটে।
কিন্তু দেশের বাইরের সংস্কৃতি ভিন্ন। জুনিয়র মানেই ধরে নেওয়া হয় অমুকের সন্তান! বিদেশে গেলে এনামুলকে তাই মাঝেমধ্যে প্রশ্নটা শুনতে হয়, ‘আপনি কি এনামুলের (মনি) ছেলে?’
যা বোঝা গেল, দেশের ক্রিকেটে এনামুল আর 'সিনিয়র' হবেন না! নামে না হন, কাজে কিন্তু অনেক এগিয়ে আছেন। দেশের ঘরোয়া প্রথম শ্রেণির ক্রিকেটে ৪৫৩ উইকেট নিয়ে এই মুহূর্তে দ্বিতীয় সর্বোচ্চ উইকেটশিকারি ৩১ বছর বয়সী এই বাঁহাতি স্পিনার। ৫৪২ উইকেট নিয়ে তাঁর সামনে শুধু আবদুর রাজ্জাক। এখন ক্যারিয়ারটা ঘরোয়া প্রথম শ্রেণির ক্রিকেটে সীমাবদ্ধ থাকলেও আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে শুরুটা তাঁর দুর্দান্ত।
বিশেষ করে টেস্টে প্রতিপক্ষ জিম্বাবুয়ে হলেই এনামুলের নামটা স্মৃতিতে ভেসে আসবেই। ২০০৫ সালের জানুয়ারিতে বাংলাদেশ প্রথমবারের মতো যে টেস্ট জিতল, সেটিতে বড় অবদান রেখেছিলেন। জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে ঢাকায় সিরিজের দ্বিতীয় টেস্টে পেলেন ১২ উইকেট। সবচেয়ে কম বয়সে (১৮ বছর ৪০ দিন) ম্যাচে ১০ উইকেট পাওয়ার রেকর্ডটা এখনো তাঁর অধিকারে। ওই সিরিজে পেলেন ১৮ উইকেট। ২০১৬ সালের অক্টোবর পর্যন্ত দুই টেস্ট সিরিজে বাংলাদেশের সবচেয়ে সফল বোলার হিসেবে রেকর্ডটি ছিল তাঁর।
পরে যেটি ভেঙে দিয়েছেন মেহেদী হাসান মিরাজ। জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে আরেকটি টেস্ট যখন চলছে, এনামুলের স্মৃতিতে ফিরে আছে দুর্দান্ত সেই সিরিজটা, ‘সেই স্মৃতি নিয়েই তো আছি। আমাকে আপনারা চেনেন ওই পারফরম্যান্সরে কারণেই। বাংলাদেশের মানুষ আমাকে চেনে ওই পারফরম্যান্স দিয়ে। ১০০ বছর পরও হয়তো এই পারফরম্যান্স গণ্য করা হবে। আমাকে অনেকে উৎসাহিত করে এই পারফরম্যান্স মনে করিয়ে।’
ক্যারিয়ারের শুরুটা কী দুর্দান্ত, সময়ের স্রোতে এনামুল নিয়মিত হতে পারেননি বাংলাদেশ দলে। আজ তাঁর শহর সিলেটে প্রথমবারের টেস্ট হচ্ছে, তিনি সেটি দেখছেন দর্শক হয়ে। আজ যখন নিজের ঘরের মাঠে দেখলেন, টেস্ট খেলছে বাংলাদেশ। স্পিন-সহায়ক উইকেট দেখে এনামুলের চোখটা নিশ্চয়ই চকচক করেছে। মনে মনে হয়তো আফসোসটা জেগেছে, ‘আহ, যদি খেলতে পারতাম!’
ঘরোয়া ক্রিকেট ভালোভাবে চালিয়ে যাচ্ছেন, কিন্তু জাতীয় দল হয়ে গেছে দূরের বাতিঘর। স্বাভাবিকভাবে হতাশা আর আফসোস এনামুলের মনে। তবে আশা-স্বপ্নই বাঁচিয়ে রাখে মানুষকে। ২০১৩ সালের এপ্রিলে সর্বশেষ টেস্ট খেলা এনামুলও স্বপ্ন দেখেন, ‘এ বয়সে স্পিনাররা পোক্ত হয়, অভিজ্ঞ হয়। এ বয়সে বিশ্বের সব দলেই কার্যকর ভূমিকা পালন করে স্পিনাররা। ৩০-৩২ বছর বয়সে ধার বাড়ে স্পিনারদের। আমি এ মুহূর্তে দলের বাইরে, আফসোস হয়। তবে নিজেকে উদ্বুদ্ধ করি এই ভেবে যে আমার বয়স তেমন হয়নি, আমি পরিশ্রম করে যাব। যদি পারফরম্যান্স আর ফিটনেস থাকে, নির্বাচকেরা চান, জাতীয় দলে খেলার সুযোগ আবার আসবে।’
যদি আর না–ও সুযোগ পান, তবুও এনামুলকে মনে রাখবে বাংলাদেশ। টেস্ট আঙিনায় ক্রমাগত হোঁচট খেতে থাকা বাংলাদেশ যখন একটা জয়ের জন্য ছটফট করেছে, সেই অচলায়াতন ভেঙেছে যে কজনের হাত ধরে, এনামুল জুনিয়র নামটা তাঁদের মধ্যে সবচেয়ে উজ্জ্বল।