গতকাল বাংলাদেশের ব্যাটিং হতাশাই বাড়িয়েছে
গতকাল বাংলাদেশের ব্যাটিং হতাশাই বাড়িয়েছে

যখন তিন দিনেও টেস্ট শেষ হয় না

বাংলাদেশের তিন দিনে হেরে না যাওয়া টেস্টের সন্ধ্যায় আমরা দাঁড়িয়ে আছি প্রেসবক্স স্ট্যান্ডের চাতালের নিচে। বৃষ্টির মধ্যে হোটেলে ফেরার ট্যাক্সি মিলবে কিনা সেই অনিশ্চয়তার মধ্যে সামনে এসে দাঁড়ালেন ওবিই। ওবিইর সঙ্গে কথা বলতে বলতে আমার দুশ্চিন্তার জাল ছিন্ন হলো। কারণ ওবিইর মতো মানুষদের সঙ্গে কথা বললে ‘ইউ উইল থিংক হাই।’

৩৩ বছর বয়সী জ্যামাইকান তরুণ ওবিই ধূমপান বিরোধী মানুষ। মাত্র ৯ বছর বয়সে মারিজুয়ানায় আসক্ত হয়ে টানা ১৫ বছর সেটিতেই মজে ছিলেন। তবে কখনো সাধারণ সিগারেট টেনে দেখেননি। ১৫ বছরের ‘অভ্যাস’ ছেড়ে দিলেন কেন প্রশ্নটায় খুব বিজ্ঞের মতো বললেন, ‘মারিজুয়ানা খেলে অসুখ হয়। খুসখুসে কাশি, শ্বাস কষ্ট, এমনকি ক্যানসারও হতে পারে। তাই ছেড়ে দিয়েছি।’

ওয়েস্ট ইন্ডিজ সিরিজে এই ছবিটা নিয়মিতই দেখা যাচ্ছে

ট্যাক্সি তখনো অনিশ্চিত। ভাবলাম, ওবিইর জীবনটাকে একটু জানি। এই জীবন, ফেলে আসা জীবনও। ওবিই এখন রীতিমতো একজন শিল্পী। খেলার সময় মাঠের দুই প্রান্তে বিজ্ঞাপনের যে ম্যাট দেখতে পান, রং তুলি দিয়ে সেটি আঁকার কাজ করেন তিনি। জ্যামাইকা থেকে সেন্ট লুসিয়ার ড্যারেন স্যামি ক্রিকেট গ্রাউন্ডে এসেছেন এটা করতেই।

জানতে চাইলাম, মারিজুয়ানা যখন খেতেন, কেমন লাগত? চোখ দুটো মৃদু বুজে রাস্তাফিয়ান টুপি পরা তরুণ যেন উড়তে উড়তে ফিরে গেলেন সেই দিনগুলোতে, ‘অন্যরকম...পুরোপুরি অন্যরকম। তুমি অনেক জ্ঞানী হয়ে উঠবে। অন্যরা যেভাবে ভাববে তুমি সেভাবে ভাববে না। তোমার চিন্তাভাবনা অনেক উঁচুতে চলে যাবে... ইউ উইল থিংক হাই।’

ক্যারিবিয়ান দ্বীপরাষ্ট্রগুলোতে মারিজুয়ানা ‘কমন’ নেশা। জীবনে এই জিনিসে এক টান দেননি, এমন লোক এখানে কমই আছে। ক্ষেত্র বিশেষে সীমিত পরিসরে এই মাদক সেবন এসব দেশে বৈধ। ওবিইর দেশ জ্যামাইকায় যেমন একজন রাস্তাফারিয়ান সর্বোচ্চ ৫টি মারিজুয়ানার গাছ রাখতে পারেন, প্রক্রিয়াজাত মারিজুয়ানা সঙ্গে রাখা যায় সর্বোচ্চ ২ আউন্স। ওবিই অবশ্য বেশ গর্ব করে বললেন, ‘আমরা রাস্তাফিয়ানরা এসব নিয়মকানুন মানি না।’ এরপর মুঠোফোন খুলে দেখালেন মারিজুয়ানা গাছের ছবি, যেটি রীতিমতো একটি বিশাল বাগান থেকেই তুলে আনা।

বৃষ্টির কারণে কাল মাঠে দিন শেষের সংবাদ সম্মেলন হয়নি। বাংলাদেশ দলের লজিস্টিক ম্যানেজার নাফিস ইকবাল মুঠোফোনে জানালেন পেসার খালেদ আহমেদের জন্য প্রশ্ন পাঠালে উত্তরগুলো তিনি ভিডিও করে আমাদের পাঠাবেন। ট্যাক্সির পাশাপাশি প্রশ্ন পাঠিয়ে খালেদের উত্তরের জন্যও একটা অপেক্ষা ছিল। এদিকে বৃষ্টি একবার কমে, আরেকবার বাড়ে। এসব ঝামেলার মধ্যে মারিজুয়ানা সম্পর্কিত জ্ঞানার্জনে আর মন টানল না। ওবিইর আগের জীবনের মতো ‘থিংক হাই’ না হলেও মেজাজটাই যে ‘হাই’ হয়ে যাচ্ছে!

ওবিইকে তার পথে ছেড়ে দিয়ে বাংলাদেশ দলের ব্যাটিংটাই বরং আবার একটু মনে করা যাক। কি এমন হলো যে, তিনবার বৃষ্টি বাধার মধ্যে মাত্র ৫৬.৩ ওভার খেলা হওয়া তৃতীয় দিনের পরও বাংলাদেশ চতুর্থ দিনে মাঠে নামবে শুধু হারের আনুষ্ঠানিকতা সারতে?

আর বৃষ্টি টাই-বা কেন এত ঝামেলা করল! বৃষ্টিতে ভেসে ভেসে খেলা চার দিনে যাওয়া আর তিন দিনে হেরে যাওয়া তো একই। বাংলাদেশের ব্যাটিং যে মানের হলো তাতে বৃষ্টি না হলে ম্যাচ তো কালই শেষ হয়ে যায়।

সেটি হয়নি। ওয়েস্ট ইন্ডিজকে আজ আরেকবার ব্যাটিংয়ে নামাতে বাংলাদেশকে করতে হবে আরও ৪২ রান। হাতে থাকা ৪ উইকেট নিয়ে এই রানটা তারা করতে পারবে, এমন আস্থা রাখতে একটু কষ্টই হচ্ছে। আর করলেই বা কত করবে! সেরকম কিছু হলে ওয়েস্ট ইন্ডিজ ব্যাটসম্যানদের জন্যও ব্যাটিংয়ে নামাটা জয়ের আনুষ্ঠানিকতার চেয়ে বেশি কিছু হওয়ার কথা নয়।

কিন্তু কেন বাংলাদেশের ব্যাটিং বারবার এমন ধসে পড়ছে? পড়ছে কারণ ব্যাটিংয়ের মৌলিক নিয়মগুলোই ব্যাটসম্যানরা গুলিয়ে বসে আছেন। দ্বিতীয় ইনিংসে সবচেয়ে থিতু ব্যাটসম্যান নাজমুল হোসেনের কথাই ধরুন। আলজারি জোসেফ রীতিমতো ছক কষে তাঁকে আউট করলেন। টানা কয়েকটা বল স্টাম্পের ওপর করে হঠাৎ অফ স্টাম্পের বাইরে একটা ওভারপিচ ডেলিভারি। নাজমুল ভুলে গেলেন ওই বলটা ছেড়ে দিতে হবে, অথবা খেলতে হলে পা’টা একটু আগাতে হবে। এসব বল জায়গায় দাঁড়িয়ে খেললে যা হয়, ব্যাটের কানায় লাগিয়ে তিনি হয়ে গেলেন কট বিহাইন্ড।

এর আগে তামিম ইকবালও কেমার রোচের সুইং করে বেরিয়ে যাওয়া বলে ব্যাট চালিয়ে উইকেটকিপারে জশুয়া দা সিলভার গ্লাভসে ধরা পড়েছেন। রোচের কি সৌভাগ্য, প্রিয় শিকার তামিমকে ফিরিয়েই টেস্টে ২৫০তম উইকেট পাওয়ার উৎসব করলেন! প্রিয় শিকার কারণ, এ নিয়ে তিনি তামিমকে আউট করলেন ১২ বার।

না, বাংলাদেশের ব্যাটিং নিয়েও আর বেশি ভাবা যাচ্ছে না। এ রকম সব আউট একবার সরাসরি দেখার পর একই দিনে দ্বিতীয়বার কল্পনায় ভাসিয়ে তোলাটা নিজের জন্যও একটা শাস্তি। আর বাংলাদেশ দল তো গত দুই-তিন সিরিজেই ব্যাটিং করছে মেজাজ ‘হাই’ হয়ে যাওয়ার মতো। স্মৃতির টেলিভিশনে সেই ব্যাটিংয়ের পুনঃপ্রচার দেখে মনকে অশান্ত করে তোলার কোনো অর্থ হয় না।

তারওপর সেদিন দলের প্রশিক্ষক শ্রেণির একজন হতাশ হয়ে বলছিলেন, তিনি নিজেও নাকি ধরতে পারছেন না ব্যাটসম্যানদের রোগটা কোথায়। বেশি দুশ্চিন্তা তরুণ ব্যাটসম্যানদের নিয়ে। অভিজ্ঞরা খারাপ সময়ে পড়ে আবার সেটা থেকে বেরিয়ে আসার পথটা চেনেন। কিন্তু এই পর্যায়ে এসে তরুণেরা এখনো সেই উত্থান-পতনটা দেখেননি। তাদের এই চক্কর থেকে বের করে আনাটাই বেশি কঠিন মনে হচ্ছে তাঁর কাছে। তো ডাক্তারই যখন রোগীর অবস্থা দেখে এ রকম টেনশনে পড়ে যান, আমাদের মতো দর্শনার্থীর আর কি করার আছে! এর চেয়ে অন্য চিন্তা করা যাক।

কাল বারবার বৃষ্টি এসে বাংলাদেশকে তিন দিনে হারা থেকে বাঁচিয়ে দিলেও আজ চতুর্থ দিনে নিশ্চিত রেহাই নেই। এসব ক্ষেত্রে টেস্টের পড়ে থাকা দিনগুলোতে সিরিজ কাভার করতে আসা সাংবাদিকেরা পড়ে যান সংকটে। না থাকবে খেলা, না থাকবে খেলোয়াড়দের মন কথা বলার মেজাজে, না থাকবে লেখার বিষয়। হ্যাঁ, ব্যাটিংটাকে কাটাছেঁড়া করে কত কিছুই লেখা যায়, কিন্তু সেটারও তো একটা সীমা আছে। প্রতিদিন ব্যাটিং ভালো হবে না আর প্রতিদিনই কাটাছেঁড়া করে মস্তিষ্কে রক্তারক্তি অবস্থা—এ আর কত!

সেন্ট লুসিয়া টেস্টের সম্ভাব্য ফাঁকা পঞ্চম দিনের চিন্তাটাও তাই তৃতীয় দিন বিকেলেই হানা দিল। আশার কথা, টি-টোয়েন্টি দলের বাকি ক্রিকেটাররা এরই মধ্যে দলের সঙ্গে যুক্ত হয়েছেন। মঙ্গলবার সকালে বাংলাদেশ এবং ওয়েস্ট ইন্ডিজ দুই দল একই ভাড়া করা ফেরিতে সমুদ্রপথে ডোমিনিকা যাবে। তার আগের দিন সেন্ট লুসিয়ায় একদিনের বাড়তি অনুশীলনের সুযোগ নিশ্চয়ই নিতে চাইবে দল। সাদা বলের অনুশীলনের সুযোগে টেস্টের হতাশা থেকে যদি সফরের মুখটা টি-টোয়েন্টির বন্দরের দিকে ঘুরিয়ে দেওয়া যায়, মন্দ কি!

কিন্তু সে উপায়ও কি রেখেছে বাংলাদেশ দল? সর্বশেষ ১০টি টি-টোয়েন্টির নয়টিতেই হার। আশার জাল যে বুনবেন, সে সুতোই তো নেই! আর এই সব ম্যাচেও ব্যাটিংটা হয়েছে হতাশার। ও, ঘুরেফিরে আবার সেদিকেই... ব্যাটিং!

আসলে তিন দিনে না হারা টেস্টের তৃতীয় দিনের শেষটা যখন চতুর্থ দিনের জন্য শুধু শেষের আনুষ্ঠানিকতাই বাকি রাখে এবং সেটার জন্য কাঠগড়ায় দাঁড়ায় বাজে ব্যাটিং, তখন এই আলোচনা এড়িয়ে যাওয়ার আর উপায় থাকে না। ব্যাটিংয়ের সমস্যার সমাধান ভালো করার চেষ্টায়, ভালো কিছুর ইচ্ছায়, ভালোভাবে খেলায়। ড্রেসিংরুমে কোচরাও নিশ্চয়ই এই কথাটাই সবার আগে বলবেন ব্যাটসম্যানদের, ‘চিন্তাটাকে উন্নত কর... থিংক হাই।’

তবে সেটি অবশ্যই ওবিইর ফেলে আসা জীবনের প্রক্রিয়ায় নয়।