রাজীব নায়ারকে চেনেন? নাম শুনেছেন কখনো?
না শুনে থাকলে বুঝতে হবে, ক্রিকেটের রেকর্ড-টেকর্ড নিয়ে আপনার খুব একটা উৎসাহ নেই। রাজীব নায়ার তো যেনতেন ক্রিকেটার নন। হ্যাঁ, আন্তর্জাতিক ক্রিকেট খেলেননি, ভারত ‘এ’ দল পর্যন্ত গিয়েই শেষ হয়ে গেছে তাঁর দৌড়। তারপরও তাঁর নামটা সবার জানা উচিত। কারণ এই রাজীব নায়ার এমন একটা রেকর্ড করে রেখেছেন, যা কোনো দিন না ভাঙলেও অবাক হওয়ার কিছু নেই। প্রথম শ্রেণির ক্রিকেটে যে এক হাজার মিনিট ব্যাটিং করা যায়, এটা এই ভদ্রলোকের আগে কেউ প্রমাণ করতে পারেননি।
নামটা জানতাম। ছবিও দেখেছি। কিন্তু সেই ছবির সঙ্গে এমন ঘনিষ্ঠ পরিচয় ছিল না যে দেখেই চিনে ফেলব। হাত তিনেক দূরে দাঁড়ানো লোকটাই যে ১০১৫ মিনিট ব্যাটিং করে প্রথম শ্রেণির ক্রিকেটে দীর্ঘতম ইনিংস খেলার রেকর্ডের মালিক, তা বুঝতেই পারতাম না যদি ধর্মশালা স্টেডিয়ামের কিউরেটর পরিচয় করিয়ে না দিতেন। কাল সকালে স্টেডিয়ামে পার্কিংয়ের জায়গায় দাঁড়িয়ে বাংলাদেশ দলের নেট দেখছি আর কিউরেটরকে উইকেট নিয়ে এটা-ওটা জিজ্ঞেস করছি। এমন সময় তিনি এলেন। কিউরেটর বললেন, ‘ওকে চেনেন? ও হানিফ মোহাম্মদের রেকর্ড ভেঙেছে।’
রাজীব নায়ার নামটা বিদুচ্চমকের মতো মনে এল। নায়ারের ওই কীর্তি ১৯৯৯ সালের ৩ নভেম্বর। ব্রিজটাউনে হানিফ মোহাম্মদের টেস্ট বাঁচানো ওই অবিস্মরণীয় ইনিংসের প্রায় ৪১ বছর পর। ফলো অন করতে নেমে ৯৭০ মিনিট ব্যাটিং করে ৩৩৭ করেছিলেন হানিফ। পাকিস্তানের প্রথম ব্যাটিং গ্রেট অবশ্য দাবি করেন, হিসাবে ভুল হয়েছে। ৯৭০ মিনিট নয়, তিনি আসলে ব্যাটিং করেছিলেন ৯৯৯ মিনিট। তা-ই যদি হয়ে থাকে, তাতেও রাজীব নায়ার হানিফ মোহাম্মদের রেকর্ড ভেঙেছেন।
জম্মু ও কাশ্মীরের বিপক্ষে ব্যাটিং করতে নেমেছিলেন দ্বিতীয় দিন সকালে দলের প্রথম উইকেট পড়ার পর। যখন আউট হলেন, চার দিনের ম্যাচ প্রায় শেষ হতে চলেছে। ১৬ ঘণ্টা ৫৫ মিনিট ব্যাটিং করে ৭২৮ বলে ২৭১ রান। ক্যারিয়ারের প্রথম ডাবল সেঞ্চুরি, কিন্তু রাজীব নায়ারের মনে তখন বড় দুঃখ। ট্রিপল সেঞ্চুরিটা যে ফসকে গেল! আউট হয়ে ফেরার সময় সেই দুঃখেই কাতর ছিলেন। রেকর্ডের আনন্দ তাঁকে স্পর্শই করেনি। রেকর্ড করেছেন, এটাই যে জানতেন না!
সেটি জেনেছেন চার দিন পর! রাজীব নায়ারই জানালেন অবিশ্বাস্য এই তথ্যটা, ‘ওই ইনিংস খেলার চার দিন পর দিল্লি থেকে এক সাংবাদিক ফোন করে আমাকে অভিনন্দন জানিয়ে বললেন, আমি নাকি বিশ্ব রেকর্ড করেছি। আসলে হিমাচল তো ছোট দল। এখনো সেভাবে কেউ খোঁজখবর রাখে না, তখন তো আরও রাখত না। দিল্লি বা মুম্বাইয়ের কেউ এই রেকর্ড করলে হয়তো সেদিনই হইচই পড়ে যেত। দেখেন না, এই যে কদিন আগে মুম্বাইয়ের একটা ছেলে এক হাজার রান করল, তাকে নিয়ে পুরো ভারতে আলোড়ন।’
হানিফ মোহাম্মদের যে অমন একটা রেকর্ড আছে, সেটিও জানতেন না নায়ার। ব্রায়ান লারা প্রথম শ্রেণির ক্রিকেটে তাঁর সর্বোচ্চ স্কোরের রেকর্ড ভেঙে দেওয়ার পর হানিফ ফোন করে লারাকে অভিনন্দন জানিয়েছিলেন। রাজীব নায়ারের ভাগ্যে তা জোটেনি। রেকর্ড ভাঙার পর হানিফের সঙ্গে দেখাও হয়নি।
এই রেকর্ড তো বিশ্বজনীন কীর্তি। হিমাচল প্রদেশের পক্ষেও এমন সব কীর্তি করে রেখেছেন যে রাজীব নায়ারকে অনায়াসেই ‘মিস্টার হিমাচল ক্রিকেট’ বলা চলে। হিমাচলের পক্ষে রঞ্জি ট্রফিতে প্রথম সেঞ্চুরি তাঁর। উত্তরাঞ্চলের বাকি পাঁচটি দল পাঞ্জাব, দিল্লি, হরিয়ানা, সার্ভিসেস এবং জম্মু ও কাশ্মীর। হিমাচলের প্রথম ব্যাটসম্যান হিসেবে এই পাঁচ দলের বিপক্ষেই সেঞ্চুরির কীর্তিও তাঁর। দুলীপ ট্রফিতে অভিষেকেই সেঞ্চুরি করেছেন। নিজেই উৎসাহভরে জানালেন এসব তথ্য। সঙ্গে এটাও, রঞ্জি ট্রফিতে হিমাচলের প্রথম ম্যাচে অধিনায়ক ছিলেন তাঁর বাবা মেজর এস সি নায়ার। ক্রিকেট তাহলে তাঁর রক্তেই ছিল। ‘ঠিক বলেছেন, আমার দাদাও কিন্তু ক্রিকেটার ছিলেন’—সোৎসাহে বললেন নায়ার। এখনো ক্রিকেটের সঙ্গেই আছেন। হিমাচল প্রদেশের রঞ্জি দলের নির্বাচক হয়ে।
টি-টোয়েন্টি যুগে ব্যাটসম্যানদের লম্বা ইনিংস খেলার অভ্যাস যেখানে দিন দিন কমছে, রাজীব নায়ারের রেকর্ডটা কি ভাঙবে কোনো দিন? মুখে একটা হাসি ছড়িয়ে নায়ার বললেন, ‘আমার তো মনে হয় না!’