১৩৫ রানে অপরাজিত লিটন দাস
১৩৫ রানে অপরাজিত লিটন দাস

মোনালিসা আঁকছেন লিটন

‘কোনটা ভালো? মশা তোমাকে না কামড়ায়, সেটা? নাকি কামড়ানোর পরে চুলকাতে পারবে, সেটা?’

অন্তত এক রাতের জন্য হলেও বাংলাদেশ দ্বিতীয় শর্তটা বেছে নেবে বলেই অনুমান। যে দিনটা শুরু হয়েছিল ২৪ রানে ৫ উইকেটের দুঃস্বপ্নে, সেটিই শেষ হলো ২৫৩ রানের জুটির সুখস্বপ্নে ডুবে। টানা দ্বিতীয় টেস্টে শতকের দেখা পেলেন মুশফিকুর রহিম। এ দিনটায় তিনি যদিও পার্শ্বচরিত্র। লিটন দাস শতক পেয়েছেন, এমন দিনে পাদপ্রদীপের আলোটা অন্য কারও ওপরে পড়ে নাকি!

এমনিতেই ক্রিজে তাঁর উপস্থিতির চেয়ে মুগ্ধতাজাগানিয়া দৃশ্য খুব কমই আছে। ‘আগেরটা বেশি ভালো ছিল, নাকি এটা’—প্রশ্নটা তো তাঁর প্রতি শটেই জাগে। আজ অপরাজিত ১৩৫ করে সাজঘরে ফেরার পর এটাই তাঁর সেরা ইনিংস কি না, এ নিয়ে যে মৃদুস্বরে হলেও তর্ক উঠবে, তা আর আশ্চর্য কী! একটা আলোচনা অবশ্য তর্কাতীত। ইনিংসটাকে ব্যাকফুট প্লে-র বিচারে মাস্টারক্লাসের স্বীকৃতি দিয়ে দেওয়া যাচ্ছে অনায়াসে।

গত নিউজিল্যান্ড সফরেই তাঁর সেঞ্চুরি আছে, ক্যারিয়ারের ঘোর অমানিশাতেও দক্ষিণ আফ্রিকায় খেলে এসেছেন ৭০ রানের ইনিংস, ওয়ানডে বিশ্বকাপে দারুণ একটা হুক শটে ছক্কা হাঁকানোর পরই না ইয়ান বিশপ বলেছিলেন, ‘লিটন দাস ইজ পেইন্টিং আ মোনালিসা হিয়ার?’ তবু যে মাস্টারক্লাস হিসেবে এই ইনিংসটাকেই বেছে বেওয়া, তার কারণ, এই ইনিংসে পেছনের পায়ে গিয়ে যতগুলো শট খেলেছেন, আর যতটা কার্যকরভাবে খেলেছেন।

লিটনের ব্যাটিং যেন শিল্পীর তুলির আঁচড়

যদিও শর্ট বলে বারকয়েক উইকেট দিয়ে এসেছেন (হ্যাঁ, এসেছেনই), তবে একটু খাটো লেংথের বলগুলো লিটন বেশ ভালোই সামলান। বাউন্সারে চট্টগ্রামের মন্থর পিচে সাফল্য এসেছে বলেই খুব সম্ভবত প্রথম দিনের খেলা ৩০ ওভার পেরোতে না পেরোতেই (পাই-টু-পাই হিসাব চাইলে ৩৫তম ওভার থেকে) শর্ট বল রেসিপিতে চলে গেলেন শ্রীলঙ্কান পেসাররা। আর লিটনের সামনে সুযোগ এল নিজের ব্যাকফুট প্লে-র ঝুড়ি খোলার।

বোঝা তো যাবে ওয়াগন হুইলে তাকালেও, তবে কেবল পুল শটেই নিয়েছেন ৫৫ রান, একটামাত্র প্রমাণ হিসেবে এই পরিসংখ্যানই বোধ হয় যথার্থ। প্রথম দিনে মারা ১৫ চারের ৮টিই মেরেছেন পুল করে, সঙ্গে দিনের একমাত্র ছক্কাটাও।

শটগুলোর প্লেসমেন্টের প্রশংসাও কি করা উচিত নয় অল্পস্বল্প? শ্রীলঙ্কান পেসাররা যখন থেকে বাউন্সার থেরাপিতে চলে গেলেন, ফাইন লেগ আর স্কয়ার লেগ সব সময়ই থাকল, তাদের মাঝে এসে স্যান্ডউইচের মতো জুড়লেন শর্ট ব্যাকওয়ার্ড স্কয়ার লেগ। পুরো ইনিংসে লিটন যে একটামাত্র সুযোগ দিলেন (ব্যক্তিগত ৪৭ রানে), সেটাও ওই শর্ট ব্যাকওয়ার্ড স্কয়ারে দাঁড়ানো ফিল্ডার কামিন্দু মেন্ডিসকেই। তবে বাকিটা সময় লিটন যেন কাঁটাকম্পাসের মতোই নিখুঁত, ফিল্ডারদের ফাঁক গললেন মেপে মেপে।

রানের বেশির ভাগটা অবশ্য ধীরগতির বোলারদের বলেই। গত টেস্টেই স্পিনারদের বল পেছনের পায়ে বেশি বেশি খেলে সেঞ্চুরি পেয়েছিলেন মুশফিকুর রহিম, এবার লিটনও তাদের সামলাতে বেছে নিয়েছিলেন একই পন্থা। সঙ্গে সারা দিনই লং হপ-ফুল টস ডেলিভারি করে যাওয়া শ্রীলঙ্কান স্পিনারদেরও এর নেপথ্যে ভূমিকা থাকল ভালোই। লঙ্কান স্পিনারদের যে ১৩৫ বল খেলেছেন, তাতে নিয়েছেন ৭৪ রান, এর মাঝে ৬৩-ই এসেছে স্কয়ার লেগ, মিড উইকেট, পয়েন্ট এবং কাভার অঞ্চল দিয়ে। স্পিনারদের বলে মারা ১০ চারের ৮টিই মেরেছেন ব্যাকফুটে গিয়ে।

ব্যাকফুটে সৌন্দর্য ছড়িয়েছেন লিটন

তাঁর ব্যাকফুট প্লে–র দ্যুতিতে ঝলসে গিয়ে শ্রীলঙ্কান বোলাররা পরে বাধ্যই হয়েছেন ভিন্ন পরিকল্পনায় যেতে। সেখানেও অবশ্য লাভ হয়নি। দিনের শেষ চারটা তাঁর ট্রেডমার্ক ফ্লিক শটে, দিনের শেষে ২২১ বলে ১৩৫ রানের রিডিং আলোকের ঝরনাধারার উৎসই হচ্ছে।

দায়িত্ব অবশ্য শেষ হয়নি এখনো, শেষ হয়নি পরীক্ষাও। মিরপুরে সর্বশেষ পাঁচ টেস্টেই প্রথম ইনিংসে রান উঠেছে ৪০০-এর বেশি, এরপরে স্বীকৃত ব্যাটার বলতে কেবল মোসাদ্দেকই আছেন। রানটাকে ওই পর্যন্ত নেওয়ার কাজটা তাই এই জুটিকেই করতে হবে।

আর লিটন যদি সেখানটায় অগ্রণী ভূমিকা পালন করেন, একটা প্রতীক্ষাও ঘুচবে নিশ্চিত করেই। সব ফরম্যাট মিলিয়ে এই বছর সবচেয়ে বেশি রান তাঁর, টেস্ট ক্যারিয়ারে তিনটা সেঞ্চুরিও পাওয়া হয়ে গেছে, তবে ডাবল সেঞ্চুরিটা এখনো অধরা।

পরীক্ষাটা শুরু হচ্ছে এখান থেকেই। সেরাদের সেরা হতে হলে তো সেঞ্চুরি নয়, আরও বড় খেলতেও পারতে হয়।