ভারত ও ইংল্যান্ডের সিরিজ জমে উঠেছে বেশ। এক ম্যাচ ইংল্যান্ড জিতছে, পরের ম্যাচেই ফিরে আসছে ভারত। চার ম্যাচ শেষে সিরিজে ২-২ সমতা, পাঁচ ম্যাচের সিরিজের মীমাংসা এখন হবে শেষ ম্যাচেই। টি-টোয়েন্টিতে বর্তমানে ফর্ম বিচারে সেরা দুই দলের সিরিজে নজর রাখছেন সবাই। ইউটিউবের সুবাদে ইদানীং পাকিস্তানের সব সাবেক ক্রিকেটারের বিশ্লেষণ হরহামেশাই শোনা যাচ্ছে। ভারত-ইংল্যান্ড সিরিজ নিয়েও তাই নিয়মিতই কথা শোনা যাচ্ছে ইনজামাম-উল-হক ও রমিজ রাজাদের কথা।
টেস্ট সিরিজে ভারতের তরুণদের নিয়ে উচ্ছ্বসিত প্রশংসা করেছিলেন ইনজামাম। ঋষভ পন্তের ব্যাটিং দেখে নাকি বীরেন্দর শেবাগের কথা মনে পড়েছিল তাঁর। এই উইকেটকিপারকে বাঁহাতি শেবাগ বলেই ডেকেছেন ইনজামাম। আর টি-টোয়েন্টি সিরিজ দেখে রমিজ রাজা শেবাগের আরেক সতীর্থকে টেনে এনেছেন। তবে মহেন্দ্র সিং ধোনির সঙ্গে ভারত দলে তুলনীয় কাউকে খুঁজে পাননি রমিজ রাজা। বরং ধোনির সঙ্গে বর্তমান পাকিস্তান দলের কোচের তুলনা টেনেছেন।
তুলনাটা শুনলে অবশ্য কারোরই খুশি হওয়ার কথা নয়। নেতিবাচক মানসিকতায় দুজনের মধ্যে মিল খুঁজে পেয়েছেন রমিজ। তাঁর মতে, ধোনি যেমন রক্ষণাত্মক ক্রিকেট খেলাতেন তাঁর দলকে, পাকিস্তান কোচ মিসবাহ-উল-হকও সেভাবেই খেলাচ্ছেন বর্তমান পাকিস্তানকে।
ক্রিকেটবাজের ইউটিউব চ্যানেলের সঙ্গে কথোপকথনে এমন বিস্ময়কর তুলনা টেনেছেন রমিজ। চলমান সিরিজে ভারত ও ইংল্যান্ড দলের মান ও দক্ষতা নিয়ে নিজের উচ্ছ্বাস জানিয়েছেন রমিজ। বর্তমানে টি-টোয়েন্টি সংস্করণে এই দুই দলের সঙ্গে অন্য দলগুলোর তফাত অনেক বেশি বলে মনে হচ্ছে সাবেক পাকিস্তান অধিনায়কের। তাঁর ধারণা, বছরের শেষে টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপে অন্য দলগুলো কত বড় পরীক্ষা দেবে, সেটার একটা ধারণা এবারের সিরিজেই পাওয়া যাচ্ছে, ‘আমার মতে, এটা অন্য দলগুলোর জন্য একটা বার্তা, দক্ষতা কতটা বাড়াতে হবে, সে ব্যাপারে। এই ফরম্যাটে বিশ্বকাপের আগে কীভাবে নিজেদের পরিকল্পনা সাজাতে হবে, সেটা বোঝা যাচ্ছে এতে। সেরা দুই দলকে খেলতে দেখছি আমরা এবং আমার মতে বিশ্বকাপে ইংল্যান্ডকে হারানোই সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ সবার জন্য। সাদা বলের ক্রিকেটে তাদের এই বিশাল উত্থান আসলেই চমকপ্রদ। বিশেষ করে কয়েক বছর আগে ওরা তো ওয়ানডে ক্রিকেটকেই গুরুত্ব দিত না। আর টি-টোয়েন্টি ক্রিকেট তো বাদই। ইংল্যান্ড দল এখন ভয়ডরহীন ক্রিকেট খেলে এবং সাদা বলে আগ্রাসী ক্রিকেট খেলে।’
এই ভয়ডরহীন ক্রিকেটের প্রসঙ্গেই উঠে এল মিসবাহর কথা। একসময় আগ্রাসী ক্রিকেটের জন্য বিখ্যাত ছিল পাকিস্তান। তাদের মানসিকতা ও খেলার ধরনের কারণে আগ থেকে কিছু বলা যেত না। কিন্তু বর্তমান পাকিস্তান দলে সেই পরিচিত আগ্রাসন খুঁজে পাচ্ছেন না রমিজ। আর এর দায়টা কোচের ওপরই দিতে চান এই ধারাভাষ্যকার ও বিশ্লেষক, ‘মিসবাহর শিক্ষা ও বড় হয়ে ওঠা একেবারে আলাদা। সহজভাবে ব্যাখ্যা করি। সে হলো গরিবের ধোনি। এম এসও (ধোনি) একটু রক্ষণাত্মক ছিল, কখনো আবেগ দেখাত না, কখনো বাড়তি অনুভূতি টের পেতে দিত না। মিসবাহও এমন।’
মিসবাহকে বদলের আহ্বানও জানালেন রমিজ, ‘তবে আমার মতে, ওকে আধুনিক চিন্তাধারার সঙ্গে মানিয়ে নিতে হবে। মিসবাহকে নতুন চিন্তার সঙ্গে মানিয়ে নিতেই হবে। কারণ, পাকিস্তান ক্রিকেটের চলার পথ এখনই ঠিক করতে হবে। আগ্রাসী ক্রিকেট আমাদের ডিএনএর মধ্যেই আছে। আমার মনে হয়, মিসবাহ বেশি রক্ষণাত্মক হয়ে পড়ে আর কোনো ম্যাচ হারলে তো একদম গুটিয়ে যায়। কিন্তু আমাদের যদি তেমন খেলোয়াড় ও প্রতিভা থাকে, তাহলে সামান্য ধাক্কায় ভয় পাওয়ার কিছু নেই।’
নিজের দল আগ্রাসী ক্রিকেট খেলতে পারছে না, ওদিকে ভারতের ক্রিকেট মানেই আগ্রাসন। ভয়ডরহীন ক্রিকেট খেলেই অস্ট্রেলিয়ার মাটিতে দ্বিতীয় সারির দল নিয়েও সিরিজ জিতে এসেছেন অজিঙ্কা রাহানেরা। মূল পেস আক্রমণ ও ব্যাটিং লাইনআপের গুরুত্বপূর্ণ সব সদস্য ছাড়াও দলটি ভড়কে যায়নি। এর পেছনে কোচ রবি শাস্ত্রীর অবদান খুঁজে পাচ্ছেন রমিজ। তাঁর দাবি, রবি শাস্ত্রী খেলোয়াড়ি জীবন থেকেই এমন ছিলেন। আর এ কারণেই নাকি তাঁকে গড়পড়তা ভারতীয় অন্য ক্রিকেটারদের চেয়ে আলাদা করা যেত, ‘যখন রবির বিপক্ষে খেলতাম তখনই মনে হতো ভারত দলে ওকে মানাচ্ছে না। কারণ ওর মধ্যে সেই আগ্রাসনটা ছিল। সে নিজেরটা আদায় করার পক্ষে। দলের জন্য খেলে, দলের জন্য ইনিংসের শুরুতে নামে আবার শেষেও নামে। আর ওর শরীরী ভাষাও ভিন্ন ছিল।’
রবি শাস্ত্রীর মধ্যে পাকিস্তানের কিংবদন্তি অধিনায়ক ও বর্তমানে দেশটির প্রধানমন্ত্রী ইমরান খানের ছাপও দেখতে পেতেন বলে জানালেন রমিজ, ‘আমাদের মনে হতো ও অনেকটা “ইমরান খান হতে চাওয়া” খেলোয়াড়। কারণ, আমরাও এমন ছিলাম। রবি তার এই গুণ ভারতের এ দলেও নিয়ে এসেছে এবং ওর কপাল ভালো দলের অধিনায়ক বিরাট কোহলিও এমনটাই আগ্রাসী এবং মতামত জানাতে পছন্দ করে। এটাই ভারত দলে অনেক বড় পরিবর্তন এনেছে।’
ভারতের মতো পাকিস্তান দলেও পরিবর্তন দেখতে চান রমিজ। আর সে পথে তাঁর যে পরামর্শ, তাতে মিসবাহর চাকরি নিয়েই টানাটানি পড়ে যেতে পারে। কারণ, দলের জন্য স্থায়ী কোনো কোচ দরকার—এ ধারণাতেই বিশ্বাসী নন রমিজ, ‘অতীতে বিদেশি কোচ আনার ব্যাপারটা আমার কাছে গ্রহণযোগ্য ছিল। কারণ, তখনো আমরা এ ব্যাপারগুলোতে নতুন ছিলাম। কিন্তু এখন তো এসব ক্ষেত্রে আমরা পরিণত হয়েছি। এমনকি আমার তো মনে হয়, সব সফরে দলের জন্য স্থায়ী কোচেরও দরকার নেই। আমাদের উচিত সফরের ধরন চিন্তা করে সিরিজ ধরে ধরে শুধু বিশেষজ্ঞ কোচ (ব্যাটিং, বোলিং) নিয়োগ দেওয়া উচিত দলের জন্য। কোচদের নেওয়া হবে সফরের ওপর ভিত্তি করে এবং প্রতিপক্ষ বিবেচনা করে। ওই সিরিজে তাঁদের অভিজ্ঞতা কাজে লাগানো হবে এবং সিরিজ শেষ হলে তাঁদের বিদায় জানানো হবে। দীর্ঘ সময়ের জন্য তাদের ধরে রেখে তো লাভ নেই।’
এরপরই সেই পরিচিত ছন্দে ফিরেছেন রমিজ। পাকিস্তানের আর সব সাবেক ক্রিকেটারের মতোই ভারত-পাকিস্তান সিরিজ দেখতে না পাওয়ার কষ্টের কথা জানিয়েছেন। বলেছেন, ভারত-পাকিস্তান সিরিজ ছাড়া বর্তমান বিশ্ব টেস্ট চ্যাম্পিয়নশিপ চালু রাখার কোনো অর্থ খুঁজে পাচ্ছেন না তিনি, ‘বর্তমান পদ্ধতিটা ভুলে ভরা এবং অনেক লম্বা। এবং ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে সিরিজ না রাখার কোনো মানে হয় না। দলগুলো সমান ম্যাচ খেলেনি এবং পয়েন্ট পদ্ধতিও খুব অদ্ভুত ছিল। পরবর্তী সময়ে যখন বিশ্ব টেস্ট চ্যাম্পিয়নশিপ আয়োজিত হবে, তখন অন্য সব ক্রিকেট বন্ধ রাখা উচিত। কোনো ওয়ানডে বা টি-টোয়েন্টিও খেলা যাবে না। যদি টেস্ট ক্রিকেটের প্রচার করতেই চান, তাহলে একে প্রাণবন্ত করুন। আর এই ফরম্যাটের জন্য স্পনসরদের আগ্রহী করে তুলতে হবে।’