>কাল ২৯ রানে ৪ উইকেট নিলেন মেহেদী মিরাজ। ২৯ রানে ৪ উইকেট এর আগে সোহাগ গাজীও নিয়েছিলেন এক ওয়ানডেতে। কিন্তু বাংলাদেশের কোনো অফ স্পিনারের সেরা বোলিংয়ের রেকর্ড বিস্ময়করভাবে এখনো রাজিন সালেহর দখলে!
‘পাইলট ভাই শুধু ডেকে একবার বললেন, পারবি? আমি মাথা নাড়লাম, পারব ভাই। আর কোনো কথা বললেন না। সোজা আমার হাতে বল তুলে দিলেন।’ বলতে বলতেই রাজিন সালেহ ফিরে গেলেন ২০০৬ সালের জিম্বাবুয়ে সফরের সেই ম্যাচটায়। ২০০৬ সালের ৬ আগস্টের ম্যাচটি সাকিব আল হাসান হয়তো ভুলবেন না। আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে আবির্ভাবের সে ম্যাচেই প্রথম উইকেটের দেখা পেয়েছিলেন সাকিব। সাকিব ভুলে গেলেও রাজিন কখনো ভুলবেন না নিশ্চিত। ওই ম্যাচে রাজিন যে মাত্র ১৬ রানে নিয়েছিলেন ৪ উইকেট।
বাংলাদেশ এমনিতেই মানসম্পন্ন অফ স্পিনার পেয়েছে কম। একের পর এক বাঁহাতি স্পিনার পাওয়ার মিছিলটাও এখন ক্ষীণধারা। এরই মধ্যে মেহেদী মিরাজ ও নাঈম হাসানের মতো অফ স্পিনার আশার গান শোনাচ্ছেন। কাল তো মিরাজ দুর্দান্ত বোলিং করলেন। ২৯ রানে ৪ উইকেট। মিরাজ ৫ উইকেট পেতে পারেন এমন একটা সম্ভাবনা মাথায় রেখেই রেকর্ড ঘাঁটাঘাঁটি। আর তা করতেই বেরিয়ে এল, অফ স্পিনে ওয়ানডেতে বাংলাদেশের সেরা বোলিংয়ের কীর্তিটা আর কারও নয়; রাজিন সালেহরই।
এ এতটাই অননুমেয়; খোদ রাজিনই শোনার পর বললেন, ‘তা-ই নাকি, কী বলেন!’
মিরাজের কালকের কীর্তিটা রাজিনেরই শহরে। রাজিনের অবশ্য তা দেখা হয়নি সামনা-সামনি। তবে অনুজের জন্য শুভকামনা জানালেন। এর আগেই ফিরে গেলেন বোলার রাজিনের সেরা দিনটায়, ‘ওই সফরটা ভালোমতো মনে আছে। জিম্বাবুয়ে খুব চেষ্টা করছিল আগের বছর বাংলাদেশে এসে হেরে যাওয়ার পাল্টা জবাব দেওয়ার। ওয়ানডে সিরিজটাও ওরা জিতে নিয়েছিল, সেটি ছিল সিরিজের পঞ্চম ও শেষ ম্যাচ। ওই ম্যাচে শেষের দিকে আমি বোলিং করেছিলাম, মনে আছে।’
রাজিনকে বোলিংয়ে ডেকে পাঠিয়েছিলেন তখনকার অধিনায়ক খালেদ মাসুদ। রাজিনের ডাক পড়ার কারণ, সূর্যতরুণে একসঙ্গে খেলার সুবাদে মাসুদ জানতেন, রাজিনের বোলিংয়ে চড়াও হওয়া কখনো কখনো খুব কঠিন। আর তখন জিম্বাবুয়ে চড়াও হওয়া শুরু করেছিল। ৩৯ ওভার শেষে ২ উইকেটে ১৬০ রান তুলে ফেলা জিম্বাবুয়ে শেষ পর্যন্ত ১৯৭ রানে অলআউট। এর মূল ভূমিকা ছিল রাজিনের। বোলিংয়ে এসেই বোল্ড করেছেন ৭৫ রানে থাকা হ্যামিল্টন মাসাকাদজাকে। চার উইকেটের তিনটিই রাজিন নিয়েছে বোল্ড করে। হ্যাটট্রিকের সামনেও দাঁড়িয়েছিলেন। তা না হলেও ৪.৩ ওভারেই ৪ উইকেট!
‘আসলে ক্লাব ক্রিকেট থেকে জাতীয় দল, পাইলট ভাইয়ের সঙ্গে অনেক দিন ধরে খেলেছি। উনি প্রায়ই আমার হাতে বল তুলে দিতেন। ঘরোয়া ম্যাচেও এমন হয়েছে, গুরুত্বপূর্ণ সময়ে আমাকে বল দিয়ে দিলেন। যখনই যে দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে, আল্লাহর রহমতে সেটি পালনের পূর্ণ চেষ্টা করেছি’—বলছিলেন রাজিন।
সে সময় রাজিন নিয়মিত বল করতে শুরু করেছিলেন পার্ট টাইমার হিসেবে। এমনকি মহাপরাক্রমশালী অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে সিরিজেও প্রথম দুই ম্যাচেই ৫-৫ দশ ওভার বোলিং করেছেন। ‘মনে আছে আমার বোলিংয়ে অ্যান্ড্রু সাইমন্ডস খুব ধুঁকছিল। বেশ মজাই লাগছিল। সাইমন্ডসই পরে দুটি ছক্কা মেরে হাসি থামিয়ে দিয়েছিল আমার’—হাসতে হাসতেই বলছিলেন রাজিন। সেবার অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে টানা দুই টেস্ট ফিফটিও করেছিলেন। তবে মাঠের চেয়ে, মাঠের বাইরের ঘটনার কারণে ওই সিরিজটা রাজিনের বেশি করে মনে থাকবে। শেন ওয়ার্ন খেলা শেষ হতেই মাটির মানুষ হয়ে যেতেন। রাজিনকে টানাটানি করতেন সিগারেট ফুঁকতে যাওয়ার জন্য। রাজিন খাবেন না, তবুও। ‘আর ও সব সময় কম দামি সিগারেট খুঁজত। বেশি দামের সিগারেটে নাকি মজা পেত না। ভাবেন দেখি, ওর মতো একজন কিংবদন্তি এক-দুই টাকার সিগারেট খাচ্ছে, হা হা হা।’
কত স্মৃতি! কোনো সাংবাদিক বোলার রাজিনকে নিয়ে এত কথা বলছে, এটি যে বেশ উপভোগ করছিলেন, স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছিল। খুশির চকমকি পাথর হয়ে উঠেছিলেন যেন। আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে ১৭ উইকেট। এর মধ্যে আছে বেশ কিছু বড় বড় নাম। জিম্বাবুয়ের মাসাকাজদা-টেলররা যেমন আছেন; আছেন ভারতের সৌরভ গাঙ্গুলী, ওয়েস্ট ইন্ডিজের রামনরেশ সারওয়ান, পাকিস্তানের ইউনুস খান, শোয়েব মালিক, কামরান আকমল। টেস্টে দুই উইকেটের একটি স্টিভেন ফ্লেমিং, অন্যজন মোহাম্মদ ইউসুফ!
এর মধ্যে ইউসুফকে ফিরিয়েছিলেন নিজের অভিষেক টেস্টে; যে ম্যাচটাও রাজিনের কাছে স্মরণীয় হয়ে থাকবে। করাচি টেস্টে সেবার বুক পেতে নিয়েছেন শোয়েব আখতার নামের এক গতিদানবের খুনে বাউন্সার। দলের প্রয়োজনে কীভাবে শরীরটাকে ধনুকের মতো বাঁকিয়ে ডাক করে গেছেন একের পর এক বল। অভিষেক টেস্টেই ২৯১ মিনিটের দীর্ঘ এক ইনিংস খেলেছিলেন!
কিন্তু আজ তো ব্যাটসম্যান নয়; বোলার রাজিনের সঙ্গে আলাপ। আক্ষেপের প্রসঙ্গ উঠতেই জানালেন, ‘যে ম্যাচে সৌরভকে আউট করেছি, ওই ম্যাচেই দ্রাবিড়কেও আউট করতে পারতাম। একদম চোখের সামনে আশরাফুল পয়েন্টে ক্যাচটা ফেলল। ইশ্, একটুর জন্য...।’
এই একটুর জন্য অনেক কিছু হতে হতেও না-হওয়ার আক্ষেপ রাজিনের ক্যারিয়ারের পরতে পরতে। তবে সেসব আক্ষেপের গল্প করে রাজিনের মন খারাপ করে দেওয়ার কী দরকার! রাজিন এখনো নিজেকে এই দলটার একজন ভাবেন। ভাবেন বলেই হয়তো বললেন, ‘শোনেন, আমাদের ভালো মানের অফ স্পিনার বেশি দরকার। রান আটকে রাখতে অফ স্পিনারের বিকল্প খুব কম। অফ স্পিনারকে খুব বেশি দিক দিয়ে মারা যায় না। অনেক সময় স্পিনের বিপরীতে শট খেলতে হয়, তাতে আউট হওয়ার ঝুঁকি আরও বাড়ে। ভালো লাগছে মিরাজ-নাঈমরা উঠে আসছে দেখে। আরও ভালো লাগবে, যদি আমার রেকর্ডটা ওরা দ্রুতই ভেঙে দেয়। এই দোয়া মন থেকেই করি।’
আরও পড়ুন