অবিশ্বাস্য? তা বলাই যায়। রোমাঞ্চকর? সে তো বটেই! কিন্তু এ দুটি শব্দের কোনোকিছুই এখন শিহরিত করবে না বাংলাদেশ দলকে। বরং বলা ভালো, কাল জয়ের সুবাস পেতে পেতে আজ শেষ দিনে অবিশ্বাস্যভাবে টেস্টটা ৩ উইকেটে হেরে বসল বাংলাদেশ।
এটাই টেস্ট ক্রিকেটের সৌন্দর্য। জয়ের জন্য ওয়েস্ট ইন্ডিজকে বাংলাদেশের মাটিতে চতুর্থ ইনিংসে সর্বোচ্চ রান তাড়া করে জয়ের রেকর্ড গড়তে হতো ওয়েস্ট ইন্ডিজকে। শুধু কী তাই, টেস্ট ইতিহাসেও চতুর্থ ইনিংসে পঞ্চম সর্বোচ্চ রান তাড়া করে জয়ের নজির গড়তে হতো ক্রেগ ব্রাফেটের দলকে।
বাংলাদেশ যে জয়ের জন্য ৩৯৫ রানের পাহাড়সমান লক্ষ্য ছুঁড়ে দিয়েছিল; শেষ পর্যন্ত এ দুটি মাইলফলক গড়েই ম্যাচটা জিতেছে ওয়েস্ট ইন্ডিজ। কাইল মেয়ার্সের অতিমানবীয় ব্যাটিংয়ের সামনে এ লক্ষ্যটাই কি–না শেষ দিকে ভীষণ অল্প মনে হচ্ছিল! এতটা–ই অল্প যে, মাঠের বাইরে হারের যন্ত্রণায় কপাল কুঁচকে থাকা সাকিব আল হাসানের মুখটা ভীষণ অসহায় লাগছিল। সাকিব মাঠে থাকলে ফল তো অন্যরকমও হতে পারত!
কিন্তু যিনি চোটের কারণে থাকতে পারেননি, তাঁকে নিয়ে এখন কথা বলে আর লাভ নেই। বরং চট্টগ্রাম টেস্টে ওয়েস্ট ইন্ডিজের কাছে বাংলাদেশের ৩ উইকেটের হারের কাঁটাছেড়ায় উঠে আসতে পারে দুটি বিষয়—প্রথম দুই সেশনে কোনো উইকেট নিতে পারেনি বাংলাদেশ এবং সাকিববিহীন বাংলাদেশের আদতে তিন স্পিনার নিয়ে শেষ দিনে প্রায় নখদন্তহীন লড়াই। মুমিনুল হকের দলের শরীরী ভাষাতেই ফুটে উঠছিল, হারের মুখে বাংলাদেশ।
আর এই শরীরী ভাষা ফুটেছে প্রথম সেশনে উইকেটশূন্য থাকার পর, পরের সেশনে তো বোঝাই যাচ্ছিল হারের শঙ্কা মাথায় নিয়ে চা–বিরতিতে মাঠ ছাড়ছিলেন তারা। শেষ সেশনে মাঠে নামার আগে সাকিবের পরামর্শে উজ্জীবিত হয়ে দ্রুত ২ উইকেট তুলে নেন তাইজুল ইসলাম ও নাঈম হাসান।
কিন্তু এরপর মেয়ার্সের সঙ্গে জশুয়া দা সিলভার ১৩০ বলে ১০০ রানের জুটিতে দুই টেস্টের সিরিজে ১–০ ব্যবধানে পিছিয়ে পড়ল বাংলাদেশ। জশুয়া (৫৯ বলে ২০) জয় এনে দেওয়া পর্যন্ত উইকেটে থাকতে পারেননি। তাঁকে বোল্ড আউট করেন তাইজুল। তখন জয় থেকে ৩ রান দূরে ছিল ওয়েস্ট ইন্ডিজ। এরপর কেমার রোচ (০) এসেও দাঁড়াতে পারেননি। কিন্তু তখন উইকেট তুলে নেওয়ার আনন্দ দেখা যায়নি বাংলাদেশ দলে।
৩ উইকেটে ১১০ রান তুলে চতুর্থ দিনের খেলা শেষ করেছিল ওয়েস্ট ইন্ডিজ। তখন ম্যাচের পাল্লা ঝুঁকেছিল বাংলাদেশের দিকে। কে জানত, আগের দিন অপরাজিত দুই অভিষিক্ত আজ বরফের মতো জমে যাবেন উইকেটে! চতুর্থ উইকেটে ৪৪২ বলে ২১৬ রানের অবিশ্বাস্য জুটি গড়ে ম্যাচের মোড় ঘুরিয়ে দেন দুই অভিষিক্ত মেয়ার্স ও এনক্রুমা বোনার। প্রথম দুই সেশনে তারা কোনো উইকেট না দেওয়ায় ম্যাচে মানসিকভাবে এগিয়ে যায় ওয়েস্ট ইন্ডিজ।
২৪৫ বলে ৮৬ রান করা বোনারকে চা–বিরতির পর এলবিডব্লুর ফাঁদে ফেলেন তাইজুল। কিন্তু মেয়ার্সকে থামানো যায়নি। ওয়েস্ট ইন্ডিজের ক্রিকেট ইতিহাসে তাঁর এই অতিমানবীয় ইনিংস সোনার অক্ষরে লেখা থাকবে। টেস্ট ক্রিকেটের ১৪৪ বছরের ইতিহাসে অভিষেকে চতুর্থ ইনিংসে দ্বি–শতক তুলে নেওয়া প্রথম ব্যাটসম্যান–ই শুধু নন, দলের জয়েও ‘নিউক্লিয়াস’ মেয়ার্সের ৩১০ বলে ২১০ রানের অপরাজিত এই ইনিংস। ৭ ছক্কা ও ২০ চারে ইনিংসটি সাজান এ বাঁহাতি।
স্পিনবান্ধব উইকেটে অন্য ব্যাটসম্যানরা যেখানে অতিরিক্ত সাবধানতা থেকে বাজে বলও সমীহ করে খেলেছেন, মেয়ার্সের সেখানে হাত খুলতে খেলতে বাধেনি। জয়সূচক রানও এসেছে তাঁর ব্যাট থেকে।
মোস্তাফিজুর রহমানকে তাঁর প্রথম ওভারে ছক্কা মেরেছেন, মিরাজ–তাইজুলের খাটো লেংথের বল লেগ ও অফ সাইড দিয়ে করেছেন সীমানাছাড়া। ড্রাইভগুলোও দেখার মতো। আবার ভালো বলে ঠিকই জমাট তাঁর রক্ষণ। এ কৌশলে ব্যাট করেই অভিষেক টেস্টে মনে রাখার মতো ইনিংস খেলেন মেয়ার্স। বিশেষ করে বাংলাদেশ দলের জন্য এই ইনিংস বহুদিন ‘ঘা’ হয়ে থাকবে। বৃহষ্পতিবার সিরিজের দ্বিতীয় ও শেষ টেস্ট ঢাকায়।
বাংলাদেশের হয়ে ৩৫ ওভারে ১১৩ রানে ৪ উইকেট নেন মেহেদী হাসান মিরাজ। ওয়েস্ট ইন্ডিজের দুই ইনিংস মিলিয়ে ৮ উইকেট নেন বাংলাদেশের প্রথম ইনিংসে এ সেঞ্চুরিয়ান। সর্বোচ্চ ৪৫ ওভার বল করেছেন তাইজুল। ৯১ রানে ২ উইকেট নেন তিনি। ৩৪ ওভারে ১০৪ রানে ১ উইকেট নাঈমের। ১৩ ওভারে ৭১ রানে উইকেটশূন্য ছিলেন পেসার মোস্তাফিজুর রহমান।