মাশরাফি বিন মুর্তজা

নাম

 মাশরাফি বিন মুর্তজা

জন্ম

 অক্টোবর ০৫, ১৯৮৩, নড়াইল, যশোর

ধরন

 ডানহাতি ফাস্ট বোলার

অভিষেক

বনাম জিম্বাবুয়ে, নভেম্বর ২৩, ২০০১

চিত্রা নদীর সঙ্গে তাঁর সম্পর্ক দস্যিপনার দিনগুলোর খুব কাছের বন্ধুর মতো। যখন খুশি ঝাঁপিয়ে পড়েন, নদীর গতিবেগের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে সাঁতার কাটেন। যখন খুশি, নদীতে ছিপ ফেলে বসে থাকেন। নড়াইলের সঙ্গে তাঁর আত্মার সম্পর্ক। আর তাই সুযোগ পেলেই দৌড়ে চলে আসেন। আর এলাকায় ফিরে তাকে আর পায় কে! যখন খুশি, আড্ডা মারতে মারতেই হঠাৎ করে বেরিয়ে পড়েন বাইক নিয়ে। গতির নেশা যে তাকে পেয়ে বসেছে সেই ছেলেবেলায়!

এই গতির নেশাই তাকে প্রথমবার নিয়ে এল আলোচনায়। তখন মাত্রই অনূর্ধ্ব-১৭ পর্যায়ে আঞ্চলিক এক টুর্নামেন্ট খেলছেন। এমনই বয়সে দুরন্ত গতির বোলিং, বিশাল সব ছক্কা মারার সামর্থ্য, আর ক্ষিপ্র ফিল্ডিং। দ্রুতই সুযোগ পেলেন বিকেএসপিতে ‘এমআরএফ ফাউন্ডেশন’ আয়োজিত এক ক্যাম্পে, আর নজর কেড়ে নিলেন সেই ক্যাম্পে বিশেষজ্ঞ হয়ে আসা ওয়েস্ট ইন্ডিয়ান কিংবদন্তি অ্যান্ডি রবার্টসের। তাঁরই পরামর্শে সুযোগ পেলেন বাংলাদেশ ‘এ’ দলে।

সেবার ভারতে মুম্বাইয়ের বিপক্ষে একটিমাত্র ম্যাচ খেলার পরই জাতীয় দলে সুযোগ পেয়ে যান। গতির ঝড়ে রীতিমতো জবুথবু করে রেখেছিলেন প্রতিপক্ষকে, একজন ব্যাটসম্যানের হেলমেট পর্যন্ত ভেঙে ফেলেছিলেন। এমন দুরন্ত বোলারকে জাতীয় দলের বাইরে আর কত দিনই বা রাখা যায়!

বাইরে আর রাখা গেলও না। ১৯৯৯ সালের পর মাত্র তৃতীয় খেলোয়াড় হিসেবে কোনো প্রথম শ্রেণির ম্যাচ খেলার আগেই টেস্ট দলে সুযোগ পেলেন, অভিষেকও হয়ে গেল মহাসমারোহে। অভিষেকের পর থেকে সেই যে পিছু নিল ইনজুরি, গোটা ক্যারিয়ারে আর ছাড়া পেলেন না। একের পর এক ইনজুরিতে জর্জরিত হয়ে বারবারই তাকে চলে যেতে হয়েছে মাঠের বাইরে, আবার ফিরেও এসেছেন প্রবল পরাক্রমে।

তবে প্রথমবারের মতো ক্রিকেটবিশ্বের নজরে আসেন বাংলাদেশের শততম ওয়ানডে ম্যাচে, ভারতকে একাই হারিয়ে দিয়েছিলেন ব্যাট হাতে ৩১ রান ও ফিল্ডিংয়ে দুই ক্যাচের পাশাপাশি ১০ ওভারে মাত্র ৩৬ রান দিয়ে ২ উইকেট সংগ্রহ করে।

এখন পর্যন্ত ওয়ানডে ক্রিকেটে নিজের সেরা পারফরম্যান্স আসে ২০০৬ সালে কেনিয়ার বিপক্ষে। নাইরোবিতে অনুষ্ঠিত সেই ম্যাচে চতুর্থ বোলার হিসেবে বোলিংয়ে এসে একে একে তুলে নিয়েছিলেন ছয় উইকেট। ইনিংস শেষে তাঁর বোলিং বিশ্লেষণ ছিল ১০-০-২৬-৬! এই পারফরম্যান্সের মাধ্যমেই মাশরাফি ভেঙে দেন আফতাব আহমেদের গড়া সেরা বোলিংয়ের রেকর্ড। সে বছর ওয়ানডে ক্রিকেটে সর্বোচ্চ উইকেট সংগ্রাহক (৪৯) ছিলেন মাশরাফিই।

২০০৭ বিশ্বকাপে বাংলাদেশ গিয়েছিল ‘আন্ডারডগ’ হিসেবেই। উপরন্তু, ভারতের বিপক্ষে ম্যাচের আগের দিন পাওয়া গেল এক দুঃসংবাদ। মাশরাফির অন্তরঙ্গ বন্ধু এবং বাংলাদেশের উদীয়মান অলরাউন্ডার মানজারুল ইসলাম রানা নিহত হয়েছেন এক বাইক দুর্ঘটনায়। সেই শোকের পাশাপাশি মাশরাফির সঙ্গী হলো জ্বর। প্রশ্ন উঠল, খেলতে পারবেন তো তিনি?

মাশরাফি শুধু খেললেনই না, গুঁড়িয়ে দিলেন সেই বিশ্বকাপের ‘হট ফেবারিট’ ভারতকে। মাত্র ৩৮ রানে ৪ উইকেট নিয়ে ম্যান অফ দ্য ম্যাচ হলেন সেই ম্যাচে, বাংলাদেশও অনায়াসেই হারাল ভারতকে।

২০০৯ সাল মাশরাফির জন্য বহুমাত্রিক এক বছর। মিরপুরে আয়োজিত ত্রিদেশীয় টুর্নামেন্টে নাজমুল হোসেনের সঙ্গে জুটি বেঁধে শ্রীলঙ্কাকে ডোবালেন আকণ্ঠ লজ্জায়, মাত্র ৬ রানেই তারা হারিয়ে বসল ৫ উইকেট! সে ম্যাচ জিততে পারেনি বাংলাদেশ, তবে নিজের সামর্থ্যটুকু ষোলো আনা বোঝাতে সমর্থ হয়েছিলেন মাশরাফি।

ওই বছরেই সুযোগ পেলেন আইপিএলে, কলকাতা নাইট রাইডার্স বেশ চড়া দামেই কিনে নিয়েছিল তাকে। একটি ম্যাচে সুযোগও পেয়েছিলেন বটে, তবে সেই ম্যাচ হয়তো ভুলে যেতেই চাইবেন মাশরাফি। শেষ ওভারে ২১ রান দেওয়াতেই যে দল পরাজয়ের লজ্জায় ডোবে!

২০০৯ সালেই ওয়েস্ট ইন্ডিজ সফরের আগে পেলেন অধিনায়কত্ব। সেটাও ভাগ্যে সইল না, প্রথম টেস্টে প্রথম স্পেলে বোলিং করতে গিয়েই ইনজুরিতে পড়ে বাইরে চলে গেলেন। সেই যে বাইরে গেলেন, সঙ্গে সঙ্গে যবনিকা পড়ল মাশরাফির টেস্ট ক্যারিয়ারে। এরপর যে আর সাদা পোশাক পরে মাঠেই নামতে পারেননি তিনি!

২০১১ সালে আরেকটি ট্র্যাজেডি নেমে আসে তাঁর জীবনে। প্রথমবারের মতো সেবারই ক্রিকেট  বিশ্বকাপ আয়োজন করেছিল বাংলাদেশ, মাশরাফিও দারুণভাবে চেয়েছিলেন সেই বিশ্বকাপ খেলতে। তবুও ‘হাফ-ফিট’ মাশরাফি সুযোগ পেলেন না স্কোয়াডে, অশ্রুজলে সিক্ত হয়েই ফিরতে হয়েছিল রিক্তহস্তে। চার বছর পর অবশ্য মাশরাফি’র অধিনায়কত্বেই বিশ্বকাপে কোয়ার্টার ফাইনালে পৌঁছায় বাংলাদেশ।

বিভীষিকাময় ২০১৪ সালের দুঃস্মৃতি থেকে বেরিয়ে আসার লক্ষ্যেই আরেকবার অধিনায়ক হিসেবে নিযুক্ত হন মাশরাফি। দায়িত্ব নিয়েই খোলনলচে বদলে দেন গোটা বাংলাদেশ দলের চিত্রপট। যেই দলটা কিছুদিন আগেও খুঁজে ফিরছিল জয়ের মুখ, হঠাৎ করেই তাঁরা ঘরের মাটিতে হয়ে উঠল অজেয়। বিশ্বকাপে সাফল্যের পর ২০১৫ সালে বাংলাদেশকে নিয়ে গেলেন অন্য পর্যায়ে। দলে এলেন মোস্তাফিজুর রহমান, ‘স্পিননির্ভর’ বাংলাদেশ প্রবেশ করল ‘চার পেসার’ যুগে। পরিবর্তনের শুরুটা তো হয়েছে তাঁর হাত ধরেই!

[সব তথ্য-উপাত্ত ও পরিসংখ্যান এই বিশ্বকাপের আগ পর্যন্ত]