২০১৮ অনূর্ধ্ব-১৯ বিশ্বকাপে বিস্ময় জাগিয়েছিলেন মুজীব-উর-রহমান। নামের পাশে লেখা লেগ স্পিনার। কিন্তু বল উইকেটে পড়ার পর বিশাল বিশাল সব বাঁক নিয়ে ডানহাতি ব্যাটসম্যানের ভেতরের ঢোকার চেষ্টা করছে। লেগ স্পিনার ট্যাগটা খসে পড়তে বেশি দিন লাগেনি। মাঝে কিছুদিন রহস্য স্পিনার শব্দটাও ব্যবহার করা হয়েছে।
তাঁর স্বদেশি রশিদ খানের গল্পটা আবার অমন নয়। তাঁর নামের পাশে থাকা লেগ স্পিনার ট্যাগটা খসেনি। এখন লেগ স্পিনই করেন। তবে তাঁর ছোড়া বলের অর্ধেকই ডানহাতি ব্যাটসম্যানের বাইরের দিকে না গিয়ে ভেতরে ঢোকার চেষ্টায় রত। রশিদ কিংবা মুজীব-দুজনেরই বল খেলাটা ব্যাটসম্যানের জন্য কঠিন। কারণ, উইকেটে পড়ার পর একজন স্পিনারের চেয়ে অস্বাভাবিক দ্রুতগতিতে বল ছোটাতে জানেন এ দুজন।
বিশ্বজুড়ে টি-টোয়েন্টির জোয়ারে লেগ স্পিনারদের দাম বাড়ছে। সেটা অবশ্য প্রথাগত লেগ স্পিনারদের নয়। শেন ওয়ার্ন বা স্টুয়ার্ট ম্যাকগিলদের মতো বড় বড় বাঁক নেওয়াতে পারা স্পিনারদের দেখা আর মিলছে না। কারণ, সময়টা এখন গুগলির। সাধারণ গুগলি নয়। উইকেটে পড়ে দুরন্ত গতিতে স্টাম্পে ঢোকার মতো গুগলির। কারণ, আধুনিক ক্রিকেটে ব্যাটসম্যান–বান্ধব কন্ডিশনে বাড়তি চমকই একমাত্র অস্ত্র হয়ে উঠেছে। তাই বিশ্ব ক্রিকেটে আবারও ফিরে আসছে ‘গুগলি বোলার’দের দিন।
টি-টোয়েন্টি ক্রিকেট আবিষ্কারেরও এক শ বছর আগে, ঠিক এভাবেই নিজের ক্রিকেটীয় সত্তাকে বাঁচিয়ে রাখার জন্য গুগলিকে বিশ্বজুড়ে ছড়িয়ে দিয়েছিলেন একজন। না, গুগলির আবিষ্কর্তা নন তিনি, ওই কঠিন কাজটা সেরেছেন বার্নার্ড বসানকুট। কিন্তু ইংলিশ স্পিনারের শিল্পকে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দিয়েছেন রেগি শোয়ার্জ।
লন্ডনে জন্ম নেওয়া এই ক্রিকেটারকে ১৯০২ সালে ইংল্যান্ড ছাড়তে হয়েছিল। কারণটা আর কিছু নয়, বড্ড জঘন্য ক্রিকেট খেলছিলেন শোয়ার্জ। মৌসুম শুরু হওয়ার আগে তাই প্রাক–বিবরণীতে হেনরি লেভেস-গাওয়ার বলেছিলেন, ‘গত মৌসুমে যাদের দেখা গিয়েছিল, তাদের সবাই এবারও থাকবে, জনাব শোয়ার্জ বাদে।’ কারণ আর কিছুই নয়, মিডলসেক্স দলে খেলার মতো যোগ্যতা ছিল না রেগির। তবু মৌসুমে ১৮ ইনিংস ব্যাট করেছিলেন, রান করেছিলেন ৮.১২ গড়ে। ৩০ ওভার বল করে একটি উইকেটও মিলেছিল। ৭ সেপ্টেম্বর দক্ষিণ আফ্রিকায় নতুন জীবন গড়ার আশায় উঠলেন কিংফনস ক্যাসল জাহাজে।
দুই বছর পর দক্ষিণ আফ্রিকা জাতীয় দলের অংশ হয়ে ইংল্যান্ড সফরে এসে ঘোষণা দিলেন পুনর্জন্মের। প্রথম তিন ম্যাচে বল করেননি। চতুর্থ ম্যাচে দ্বিতীয় ইনিংসে ২ উইকেটে ১১৬ রান তুলে ছুটছিল অক্সফোর্ডের। মাত্র ৭.২ ওভার বল করেই স্বাগতিকদের ধসিয়ে দিলেন। পাঁচটি উইকেট পেয়েছেন, পাঁচজনই বোল্ড। ১৬৭ রানে অলআউট অক্সফোর্ড। সফরটা শোয়ার্জের শেষ হলো ৯৬ উইকেটে।
শোয়ার্জ এর মাঝেই নিজের প্রতিশোধ নিয়েছেন। দক্ষিণ আফ্রিকাকে নিয়ে মিডলসেক্সকে হারানোর ম্যাচে আতঙ্ক হয়ে উঠেছিলেন। সেই মিডলসেক্স, যাদের দলে খেলার যোগ্যতা না থাকায় তাঁকে দেশ ত্যাগ করতে হয়েছিল। ইভেনিং স্ট্যান্ডার্ড সে ম্যাচ নিয়ে লিখেছিল, ‘সে ধারণার বাইরে উন্নতি করেছে। মিডলসেক্সে কয়েক বছর আগে যা খেলত, সব দিক থেকেই তার অবিশ্বাস্য উন্নতি।’
মজার ব্যাপার, এই অবিশ্বাস্য উন্নতির বীজ মিডলসেক্সেই পোঁতা হয়েছিল। এখানেই বার্নাড বসানকুটের দেখা মিলেছিল শোয়ার্জের। তাঁর আবিষ্কার করা গুগলি শেখার জন্য শোয়ার্জের আগ্রহ দেখে যত্ন করে শিখিয়েছেন তা। ইংল্যান্ডের হয়ে টেস্ট খেললেও বলের নিয়ন্ত্রণে কখনো দক্ষতা আনতে পারেননি বসানকুট। শোয়ার্জ সেটা করে দেখিয়েছেন। আর ১৯০৪ সফরে শিক্ষার বাকি সরঞ্জামও বসানকুটের কাছ থেকে নিয়ে গেছেন শোয়ার্জ।
নিজেকে প্রমাণে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ শোয়ার্জের পরিশ্রমের কথা লিখেছে রিডিং অবজারভার, ‘সপ্তাহের পর সপ্তাহ সে জোহানেসবার্গের ওয়ান্ডেরার্স ক্লাবে এসে বল করত। প্রথম দিকে একটা বলও উইকেটের ধারেকাছে পড়েনি। অন্য ক্রিকেটাররা এসে জড়ো হয়ে টিটকারি করত। কিন্তু তাতেও শোয়ার্জের কিছু এসে যেত না। যেদিন উইকেটে বল ফেলতে পারলেন, সেদিন অবশ্য সবাই মিলে আনন্দ চিৎকার দিয়ে উঠেছিল।’
শোয়ার্জের একটাই সমস্যা ছিল। গুগলি করতেন, মাঝেমধ্যে দু-একটা বল সোজাও যেত। কিন্তু লেগ স্পিন করতে পারতেন না। কিন্তু যেটা পারতেন সেটাই করতেন বুদ্ধির সঙ্গে। ভয়ংকর গতিতে পাঠাতেন একের পর এক গুগলি। সিবি ফ্রাইয়ের মতো কিংবদন্তিও তাঁর বোলিং দেখে বলেছিলেন ফলিত গণিতবিদদের উচিত এই অ্যাকশন পরীক্ষা করে দেখা।
শোয়ার্জের দেখা দেখি দক্ষিণ আফ্রিকা দলে আরও গুগলি বোলারের আবির্ভাব হয়েছিল। তাঁর শেখানো অস্ত্রে ইংল্যান্ডকে ১৯০৯–১০ মৌসুমে সিরিজ হারিয়েছিল প্রোটিয়ারা। শোয়ার্জের সঙ্গে গর্ডন হোয়াইট, অব্রে ফকনার ও বার্ট ভোগলার মিলে দক্ষিণ আফ্রিকাকে ক্রিকেট মানচিত্রে জায়গা করে দিয়েছিলেন। ১৯০৮ সালে তাই সেই হেনরি লেভেস-গাওয়ারই লিখেছে, বসানকুট হয়তো পেটেন্ট আবিষ্কার করেছে কিন্তু সে কখনো শিল্পটা আয়ত্ত করেনি। এটার দক্ষতা পূর্ণতা পেয়েছে দক্ষিণ আফ্রিকার কাছে।
২০ ম্যাচে ৫৫ টেস্ট উইকেট কিংবা প্রথম শ্রেণিতে ৩৯৮ উইকেটের শোয়ার্জের গল্পটা পুরোপুরি বলতে পারে না। বসানকুট যে শিল্পের জন্ম দিয়েছিলেন সেটা হয়তো হারিয়েই যেত তাঁর নিয়ন্ত্রণহীনতায়। কিন্তু শোয়ার্জ সে শিল্পের পূর্ণতা দিয়েছেন। দেখিয়েছেন শুধু নিয়ন্ত্রণ আর গতির সমন্বয়েই ব্যাটসম্যানদের স্তব্ধ করে দেওয়া যায় স্পিন বোলিংয়েই। সেই শিল্পই তো টি-টোয়েন্টি যুগে দেখা দিয়েছে আবার।
১৯১২ সালে অবসর নেওয়া শোয়ার্জ বিশ্বযুদ্ধে অংশ নিয়েছিলেন। ভয়ংকর সে লড়াই থেকে বেঁচে ফিরে আসাদের একজন এই স্পিনার। কিন্তু একটি বিশ্বযুদ্ধ যা পারেনি, সেটাই করে দেখিয়েছে ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র ভাইরাস। বিশ্বযুদ্ধ থামার ছয় দিন পর স্প্যানিশ ফ্লুতে মৃত্যু হয়েছে তাঁর। মাত্র ৪৩ বছর বয়সে বিদায় নিয়েছেন গুগলির প্রকৃত গুরু।