>এই শতাব্দীতে তাঁদের দুজনকে ছাড়া এই প্রথম এশিয়া কাপ। শুধু শ্রীলঙ্কাই নয় মাহেলা জয়াবর্ধনে ও কুমার সাঙ্গাকারাকে মনে পড়বে ক্রিকেটপ্রেমীদেরও। লিখেছেন রাজ শুভ নারায়ন চৌধুরী
এই সেদিন শেষ হওয়া মাস্টার্স চ্যাম্পিয়নস লিগেও দুজনের কী দুর্দান্ত পারফরম্যান্স। তার আগে অস্ট্রেলিয়ার বিগ ব্যাশেও একই। অত দূর খুঁজতে হবে না, সর্বশেষ দশ ম্যাচের পারফরম্যান্সই দেখুন। একজনের পাঁচ ফিফটি, অন্যজনের ফিফটি একটা কম, সেটি আবার ‘পুষিয়ে’ দিয়েছেন সেঞ্চুরি করে!
শ্রীলঙ্কার সমর্থক না হলেও এই দুজনের ব্যাটিংয়ের ভক্ত হতে পারে যে কেউ। আর তাই আপনার অভিমান হতেই পারে। কুমার সাঙ্গাকারা ও মাহেলা জয়াবর্ধনে, এত ভালোই যদি খেলবেন, তবে আন্তর্জাতিক ক্রিকেট থেকে অবসর কেন? ফিফটি-সেঞ্চুরি যদি করবেনই, সবুজ মাঠে শিল্পের ছোঁয়া দিয়ে যাওয়া শটগুলো যদি খেলবেনই, তবে দুবাইয়ের স্টেডিয়ামের অল্প কিছু দর্শকের সামনে ‘পিকনিক ক্রিকেটে’ কেন? আন্তর্জাতিক পর্যায়ে আর কিছুদিন খেলে গেলে কী এমন ক্ষতি হতো! কী দরকার ছিল শুধু শুধু এভাবে ক্রিকেটপ্রেমীদের দীর্ঘশ্বাস বাড়ানোর?
দুজনের যেমন অভ্যাস, প্রশ্নটা শুনলে হয়তো মুচকি হেসে চুপটি করে দাঁড়িয়ে থাকবেন। সাধারণ দর্শকদের আক্ষেপটা তাতে শুধু বাড়বেই। দুয়ারে আরেকটি এশিয়া কাপ, তাতে সাঙ্গা-জয়া নেই!
১৬ বছর বয়সী এই শতাব্দীতে এর আগে ছয়টি এশিয়া কাপ হয়েছে। শ্রীলঙ্কা ছয়বারই খেলেছে, ছয়টি দলে অনেক খেলোয়াড় পরিবর্তন হয়েছে। তবে সবগুলোতেই দুটি নাম ছিল ধ্রুবক—কুমার সাঙ্গাকারা ও মাহেলা জয়াবর্ধনে। এবারই ব্যতিক্রম।
এশিয়া কাপে তাঁদের দুজনের হাতের ছাপ অবশ্য এখনো রয়ে গেছে। দুবছর আগে সর্বশেষ এশিয়া কাপে মিরপুরের মাঠে যে দলকে চ্যাম্পিয়ন করে গেছেন। জিতিয়েছেন তার কদিন পরে হওয়া টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপও, সেটিও শেরেবাংলা জাতীয় স্টেডিয়ামেই। আরেকবার মিরপুরে এশিয়া কাপ। এবারও থাকবে শ্রীলঙ্কা। কিন্তু তবু হয়তো ‘কী যেন একটা নেই’—অনুভূতিটা ফিরে ফিরে আসবে।
আসারই কথা। ক্রিকেট রোমান্টিকেরা অনুভব করবেন জয়াবর্ধনে-সাঙ্গাকারার শূন্যতা, ক্রিকেটও অনুভব করবে শ্রীলঙ্কান দুই নায়ককে। টি-টোয়েন্টি সংস্করণে হওয়া প্রথম এই এশিয়া কাপে হয়তো অনেক রোমাঞ্চ ছড়ানো ম্যাচ হবে, ধুন্ধুমার ব্যাটিংয়ে বড় অনেক ইনিংসও হয়তো দেখবেন, অনেক চার-ছক্কাও। টি-টোয়েন্টির মন্ত্রও তো তা-ই।
কিন্তু দিন শেষে এটি ক্রিকেটই। নিখাদ ক্রিকেটপ্রেমী চোখ হয়তো এর মধ্যেও তৃষ্ণা নিয়ে খুঁজে ফিরবে চোখে পরশ বোলানো কোনো কাভার ড্রাইভ, ক্রিকেট ব্যাকরণে ঋদ্ধ কোনো হুক-পুল। টি-টোয়েন্টির ধর্মে দীক্ষিত ডাকাবুকোদের ভিড়ে জয়াবর্ধনে-সাঙ্গাকারার চেয়ে ভালোভাবে সেটি কে করতে পারতেন!
জয়াবর্ধনে ছিলেন ব্যাটিং সৌন্দর্যের একনিষ্ঠ পূজারি। চোখের জন্য প্রশান্তির ছিল তাঁর ব্যাটিং। প্রতি শটে ব্যাট যেন বলে আদুরে পরশ বুলিয়ে যায়। মাঝেমধ্যে টি–টোয়েন্টির দাবি মেনে স্কুপ-টুপও খেলতেন। যেন দেখিয়ে দেওয়া, ‘দেখো, এখানেও আমি-ই মাস্টার’।
আর সাঙ্গাকারা? ক্রিকেট ব্যাকরণের ক্লাসে একেবারে ফার্স্ট বেঞ্চের ছাত্র। টি-টোয়েন্টিতেও ব্যাকরণ মেনে খেলার ব্যাপারে খুব একটা আপস করেননি। কিন্তু দর্শক বিনোদনের বিষয়ে কখনো আপস করেছেন?
অপরাধ হবে তাঁদের দুজনের স্মৃতিকথনে শুধু ব্যাটিং নিয়ে কথা বলাও। ব্যাটিংয়ের মতো শুদ্ধবাদী তো তাঁরা ছিলেন খেলার চেতনার দিক দিয়েও। ‘জেন্টলম্যানস গেমে’র দুই ‘ট্রু জেন্টলম্যান’! মাঠে বা মাঠের বাইরে। তবে ‘বিনয়’ শব্দটার মধ্যে যে একটা নীরস ভাব থাকে, সাঙ্গা-জয়া তো তেমনও নন। দুজনই শ্রীলঙ্কার অধিনায়ক ছিলেন, তাই সংবাদ সম্মেলনে অনেক বেশিই আসতে হতো। যেকোনো ক্রীড়াব্যক্তিত্বকে জিজ্ঞেস করে দেখুন, সেসব সংবাদ সম্মেলন নিয়ে মজার অভিজ্ঞতার ঝুলি খুলে বসে যাবেন হয়তো। বিনয় মানে এমন নয়, আক্রমণাত্মক ছিলেন না। কিন্তু সেই আক্রমণাত্মক ভাষা কখনো কানে বেঁধেনি।
দুজন না থাকায় হয়তো প্রতিপক্ষ দলের জন্য একটু সুবিধাই হয়েছে। শ্রীলঙ্কার মুখোমুখি হওয়ার আগে নিজেদের টিম মিটিংয়ে মাশরাফি-ধোনি-আফ্রিদিরা হয়তো এটি ভেবে স্বস্তি বোধ করবেন। অবশ্য একটু খারাপও লাগতে পারে—চ্যাম্পিয়ন খেলোয়াড়দের মুখোমুখি হওয়ার মধ্যেই তো আনন্দটা সবচেয়ে বেশি!
অন্য দলগুলোর অধিনায়কদের মিশ্র অনুভূতি হতে পারে, কিন্তু অ্যাঞ্জেলো ম্যাথুস? কী ভাববেন টিম মিটিংয়ে বসে? হয়তো দুই কাঁধে দুই নায়কের হাতের নির্ভরতার ছোঁয়ার শূন্যতা অনুভব করবেন। হয়তো কেন? করবেন নিশ্চয়ই!
আর তাঁরা দুজন? মাঠে দুজনের মধ্যে বন্ধুত্বটাকে মাঠের বাইরেও নিয়ে গেছেন সাঙ্গাকারা-জয়াবর্ধনে। দুজনে মিলে শ্রীলঙ্কায় একটা রেস্তোরাঁয় বিনিয়োগ করেছেন। এবার এশিয়া কাপটা হয়তো ‘মিনিস্ট্রি অব ক্র্যাব’ নামের সেই রেস্তোরাঁয় টিভি পর্দায় দেখে কাটাবেন। কে জানে, খেলা দেখতে দেখতে হয়তো গোপন দীর্ঘশ্বাস বেরোবে দুজনেরই।
দীর্ঘশ্বাস বেরোবে আরও শত–সহস্র ক্রিকেটপ্রেমীরও।