সেই তারা, কোথায় তাঁরা

মৎস্য মারিব খাইব সুখে!

তাদের হারিয়ে ফেলা পথের খোঁজ দিচ্ছেন হাসিবুল। ছবি: জাহিদুল করিম
তাদের হারিয়ে ফেলা পথের খোঁজ দিচ্ছেন হাসিবুল। ছবি: জাহিদুল করিম

‘প্রমিজ’ করেছিলেন, ‘প্রমিসেস’ ঘুরিয়ে দেখাবেন। এক বিকেলে গাড়িতে তুলে নিয়ে সাঁ করে ছুটে চললেন ঢাকার বারিধারায়। চার বন্ধুর সঙ্গে মাদক পুনর্বাসন কেন্দ্র প্রতিষ্ঠার উদ্যোগটি নিয়েছেন আট মাস হলো। নামটাও বেশ—প্রমিসেস। 

খেলোয়াড়ি জীবনে হাসিবুল হোসেন ছিলেন ‘প্রমিজিং’ ক্রিকেটার। বাংলাদেশের কত প্রথমের সঙ্গে জড়িয়ে তাঁর নাম। তবে সব ছাপিয়ে চোখে ভেসে উঠবে সেই দৌড়—আইসিসি ট্রফির ফাইনালে কেনিয়ার বিপক্ষে এক বলে এক রান নিয়ে ব্যাট উঁচিয়ে ছুটছেন। তাঁকে থামানোর যেন কেউ নেই। বাংলাদেশের ক্রিকেটকে এক ঝটকায় বদলে দেওয়া সেই মুহূর্তটির সঙ্গে জড়িয়ে আছেন হাসিবুল।
সেই হাসিবুলের এখন দুটো পরিচয়। দুটো দুই ভিন্ন জগতের। একদিকে তিনি সুখী এক মৎস্য খামারি। আরেকটি পরিচয়, নেশার অন্ধকারে হারিয়ে যাওয়াদের দিকে হাত বাড়িয়ে দেওয়া। নিজেও যে হারিয়ে যেতে বসেছিলেন সেই চোরাবালিতে!

আইসিসি ট্রফি ফাইনালে এক রান নিয়েই হাসিবুলের সেই দৌড়।

কিছু ভুল, অমোচনীয় ভুল ছিটকে দিল ক্রিকেট-জীবন থেকে। জাতীয় দল থেকে বাদ পড়ার পর বেশ কটি বছর হারিয়ে গেলেন মাদকের আঁধারে। ভুলটা বুঝতে পারলেন এক সময়। পুনর্বাসন কেন্দ্রে চিকিৎসা নিলেন। জীবনের নতুন আলো খুঁজে পেলেন। নিজের তিক্ত অভিজ্ঞতা থেকেই বন্ধু সোহেল খান, শহীদুল ইসলাম ও ফয়সাল রেজার সঙ্গে প্রতিষ্ঠা করলেন পুনর্বাসন কেন্দ্র। মাদকের ছোবলে কাউকে হারিয়ে যেতে দেবেন না, এই প্রতিজ্ঞা থেকেই গড়ে উঠল প্রমিসেস।
হাসিবুলের সঙ্গে যাওয়া হলো সেই প্রতিষ্ঠানে। দেখা হলো কজন রোগীর সঙ্গে। হারিয়ে ফেলা পথ খুঁজতে এসেছেন। হাসিবুলকে কাছে পেয়ে উচ্ছ্বাসের ঢেউ খেলে গেলে। ‘কেন যে নেশা করেন আর এমন বন্দী জীবন কাটান ভাই, বুঝি না!’ তাঁদের উদ্দেশে বড় আক্ষেপ নিয়ে বললেন হাসিবুল। পুনর্বাসন কেন্দ্রের একেকটি কক্ষ যেন একেকটি বাগান। ‘বিলিভ, অ্যান্ড ইট ইজ পসিবল’, ‘লাভ ইজ বিউটিফুল’, ‘মে ইউ অলওয়েজ বি হ্যাপি অ্যান্ড হেলদি।’ দেয়ালে দেয়ালে আশারবাণী। ছাদে গেলে প্রাণ জুড়িয়ে আসবে। ইট-পাথরের জঙ্গলে এ যেন এক টুকরো স্বর্গীয় উদ্যান।
এমন উদ্যোগের ভাবনা কীভাবে এল? মোটা ফ্রেমের চশমাটা খুলে হাসিবুল বললেন, ‘চারদিকে মাদকের ছড়াছড়ি। কিশোর-তরুণ থেকে ৬০-৭০ বছর বয়সীও মাদকাসক্ত হয়ে পড়ছে। অন্যদের কথা কী বলব, নিজেও একসময় মাদকাসক্ত হয়ে পড়েছিলাম। এটা জীবনের জন্য কতটা ক্ষতিকর, আমার চেয়েও ভালো বুঝবে কে! এসব চিন্তা থেকেই উদ্যোগটা নেওয়া।’ প্রতিষ্ঠানটি নিয়ে হাসিবুলের স্বপ্ন আকাশসম। বললেন, ‘এটা শুরু মাত্র। ভবিষ্যতে আর্থিকভাবে অসচ্ছল মাদকাসক্তদের জন্য কিছু করার স্বপ্ন অনেক দিন ধরে। মানুষের জন্য কিছু করতে পারাটা সব সময় আনন্দের।’

মাছের ব্যবসায়ে পূর্ণ মনোযোগ হাসিবুলের। ছবি: জাহিদুল করিম

প্রমিসেসের উঠোন ছেড়ে এবার যাত্রা মিরপুরে। বছর দুয়েক হলো চার বন্ধু মিলে শুরু করেছেন মাছের ব্যবসা। ক্যান্টনমেন্টের ভেতরে ইজারা নেওয়া হয়েছে ১০টি পুকুর। সে পুকুরে চাষ হওয়া মাছ বিক্রি হয় উত্তরায় একটি দোকানে। গাড়ির স্টিয়ারিংয়ে হাত রেখেই ফিরে ফিরে গেলেন সুদূর অতীতে, যেখানে ফেলে এসেছেন সোনালি সব মুহূর্ত।
কেনিয়ার বিপক্ষে শেষ বলে পড়িমড়ি করে একটা রান নিয়েই বাঁধনহারা উদ্‌যাপনের স্মৃতিটা মনে করিয়ে দিতেই হাসলেন, ‘তেমন কোনো ভাবনায় আসলে ওভাবে দৌড় দিইনি। উত্তেজনায় হয়ে গেছে। আমাদের পরিকল্পনা ছিল, যে ভাবেই হোক একটা রান নিতে হবে। ব্যস, হয়ে গেল। এমন একটা জয়। আনন্দ তো লাগেই। ১৯৯৭ আইসিসি ট্রফিতে চ্যাম্পিয়ন হওয়া বাংলাদেশের ক্রিকেটের বিরাট বাঁক বদল। সৌভাগ্যবান, ঐতিহাসিক সে মুহূর্তের আমিও একজন সাক্ষী।’
গল্প আর স্মৃতিচারণ করতে করতেই গাড়ি চলে এল হাসিবুলদের মাছের দোকানে। মাছের দোকান শুনতেই আঁশটে গন্ধ আসছে নাকে? তবে ‘নায়াদ’-এ আপনাকে স্বাগতম। গ্রিক পুরাণের নদী ও ঝরনার দেবীর নামে নামকরণ যে দোকানের, সেটিকে ‘মাছের দোকান’ বলতেও কেন জানি অস্বস্তি হয়।
পরের গন্তব্য ক্যান্টনমেন্টে। যেখানে তিনি পুরোদস্তুর মাছের খামারি। কোনটা কঠিন—মাছের ব্যবসা নাকি বোলিং? ‘বোলিং যেমন কঠিন, তেমনি আনন্দের। ব্যবসা ভীষণ কঠিন, তবে আনন্দ কম। বিনিয়োগ উঠে আসবে কিনা, লাভ হবে হবে কি না—এসব চিন্তায় ঘুম হারাম হওয়ার জোগাড়! বোলিং খারাপ করেন আর ভালো করেন, খেললে টাকা পাবেন। কিন্তু ব্যবসায় খারাপ করলেই সর্বনাশ!’
কোন জীবন বেশি আনন্দের? এক মুহূর্ত না ভেবেই উত্তর, ‘অবশ্যই খেলোয়াড়ি জীবন। জাতীয় দলে খেলে যে আনন্দ পেয়েছি, তা কি আর অন্য কিছুতে পাওয়া যায়?’
ক্যারিয়ার দীর্ঘ না করতে পেরে আক্ষেপ হয়? বললেন, ‘নাহ! আক্ষেপ করে আর লাভ কী? জীবনের প্রতিটি পদক্ষেপ উপভোগ করা ভালো।’ মাঝে লেভেল-২ কোচিং কোর্স করেছিলেন। বাংলাদেশ ক্রিকেট লিগের পূর্বাঞ্চলের ম্যানেজার হিসেবেও দায়িত্ব পালন করেছেন। তবুও ক্রিকেটের সঙ্গে পুরোপুরি জড়ানোর ইচ্ছে নেই। দুই সন্তানের জনক হাসিবুলের আপাতত ধ্যানজ্ঞান ব্যবসা।
বেলা তখন পড়ে এসেছে। সূর্যের শেষ আলোটুকু চিকচিক করছে পুকুরের জলে। বিশাল পুকুরে মাছের ঝাঁক ছুটে চলেছে। ছোট্ট পোনা থেকে এত বড় হয়ে ওঠা, সব কাছে থেকে দেখেছেন। সেদিকে তাকিয়ে তৃপ্তির হাসি হেসে ওঠেন। সেই হাসি সাবেক ক্রিকেট তারকা নাকি ঝানু ব্যবসায়ীর, ধন্দে পড়ে যেতেই হয়।

আরও পড়ুন:-