১৮৫ বর্গমিটার ঘাসের ওপর বসানো ১৮৫টি শূন্য চেয়ার। নানা ধরনের, নানা আকৃতির। ছোট চেয়ার, বড় চেয়ার। খাড়া চেয়ার, হেলানো চেয়ার। প্যারাম্বুলেটর থেকে শুরু করে সোফা-টাইপ চেয়ার। শিশুদের জন্য গাড়ির সিটে পাতার বিশেষ চেয়ার। সবগুলোর রং সাদা। সারি সারি শূন্য চেয়ারগুলোর সামনে দাঁড়ালে অদ্ভুত একটা শূন্য অনুভূতি হয়। এই ১৮৫টি চেয়ার প্রতীকী হয়ে ১৮৫টি জীবনের কথা বলছে। আসলে বলছে মৃত্যুর কথা। ২০১১ সালে ২২ ফেব্রুয়ারি ক্রাইস্টচার্চকে তছনছ করে দেওয়া ভূমিকম্পে প্রাণ হারিয়েছে নানা বয়সের যে ১৮৫ জন মানুষ, শূন্য এই চেয়ারগুলো রোদে পুড়ে, বৃষ্টিতে ভিজে স্মরণ করছে তাদের।
ওই ভূমিকম্পের বর্ষপূর্তিতে এক সপ্তাহের জন্য চেয়ারের বিশেষ এই স্থাপনাটা করেছিলেন শিল্পী পিটার মানজেনডাই। ভিনসেন্ট ভ্যানগগের ‘এম্পটি চেয়ার’ ছিল তাঁর অনুপ্রেরণা। প্রথমে কথা ছিল, ভূমিকম্পে নিহতদের স্মরণে এক সপ্তাহই থাকবে এটি। কিন্তু জনদাবির মুখে আট বছর পরও যা রয়ে গেছে। শুধু বদলেছে ঠিকানাটা। মানজেনডাই প্রথমে এটি করেছিলেন ভূমিকম্পে মাটিতে মিশে যাওয়া ব্যাপ্টিস্ট চার্চের শূন্য জায়গায়। চার্চটি আবার নির্মাণের উদ্যোগ নেওয়ার পর এটিকে সরিয়ে আনতে হয় বর্তমান ঠিকানায়। এখানেও একটা চার্চ ছিল। সেই সেন্ট পলস্ চার্চও গুঁড়িয়ে গেছে ভূমিকম্পে। ‘আগুন লাগলে দেবালয়ও রক্ষা পায় না’ প্রবাদকে সত্যি প্রমাণ করে ক্রাইস্টচার্চের ওই ভূমিকম্পে চার্চ, ক্যাথেড্রাল এসবই সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। সেটাই অবশ্য হওয়ার কথা। এর সবই তো দু্ই শ-আড়াই শ-তিন শ বছরের আগে তৈরি। এর মধ্যে সবচেয়ে বিচিত্র কাণ্ড হয়েছে ক্যাথেড্রাল অব দ্য ব্লেসড সাক্রামেন্টোতে। সেটির জানালার কাছে ভেতর দিকে মুখ করা মাদার মেরির একটা মূর্তি ছিল। ভূমিকম্প সেটিকে ১৮০ ডিগ্রি ঘুরিয়ে রাস্তার দিকে মুখ করিয়ে দিয়েছে!
যেটির শুধুই এক সপ্তাহ আয়ু পাওয়ার কথা ছিল, সেই ‘ওয়ান এইটি ফাইভ চেয়ারস’ এখন ক্রাইস্টচার্চে পর্যটকদের অবশ্য দ্রষ্টব্যের তালিকায় ওপরের দিকেই থাকে। আমিও সেটি দেখতে না গিয়ে পারলাম না। গত শুক্রবার যা দেখে মনে হলো, বাধ্য হয়ে স্থান বদল করে এখানে আনতে হয়েছে কেন, শুরুতেই তো এটি হওয়া উচিত ছিল। ওই ভূমিকম্পে মারা যাওয়া ১৮৫ জন মানুষের ১১৫ জনই ছিলেন একটা ভবনে। সেই সিটিভি ভবনটা রাস্তার ওপারেই। যেখানে এখন ভবন-টবন কিচ্ছু নেই। ধ্বংসাবশেষ সরিয়ে শূন্য জায়গাটায় একটা উদ্যানমতো বানানো হয়েছে। আছে বেশ কিছু স্মৃতিচিহ্ন আর বড় একটা স্মৃতিফলকও। যেটির কাছে গিয়ে দেখলাম, অনেকগুলো ফুলের তোড়া। কিছু ফুল একেবারে তাজা, হয়তো সকালেই কেউ দিয়ে গিয়েছে। ভূমিকম্প সিটিভি অর্থাৎ ক্যান্টারবুরি টেলিভিশনের প্রধান কার্যালয়ে রীতিমতো বহুজাতিক হত্যাকাণ্ড ঘটিয়েছিল। মৃতদের মধ্যে নিউজিল্যান্ডার তো ছিলেনই; এ ছাড়াও ছিলেন চীন, জাপান, কোরিয়া, মালয়েশিয়া, ফিলিপাইন, তাইওয়ান, থাইল্যান্ড ও তুরস্কের নাগরিক। শুধু তো টেলিভিশন নয়, ওই ভবনে একটা ভাষা শিক্ষার স্কুল ছিল। ছিল চুল বিশেষজ্ঞের অফিস, এমনকি একটা মেডিকেল সেন্টারও।
এঁদের স্মৃতি ধরে রাখার জন্য এখানে যা করা হয়েছে, তার সবই মৃতদের পরিবার ও আহতদের মতামতের ভিত্তিতে। স্তব্ধ ভর দুপুরে ওখানে দাঁড়িয়ে স্মৃতিফলকের লেখাগুলো পড়তে পড়তে আমার রানা প্লাজা ট্র্যাজেডির কথা মনে পড়ল। এখানে যা হয়েছে, সেটি প্রকৃতির খেয়াল। মানুষের তাতে হাত নেই। কিন্তু রানা প্লাজা ধসে এর প্রায় দশ গুণ বেশি মানুষ মারা যাওয়ার কারণ তো মনুষ্যসৃষ্ট। নিউজিল্যান্ডের মানুষ কি রানা প্লাজার কথা সেভাবে জানে? মনে হয় না।
প্রকৃতির যে খেয়ালের কথা বললাম, সেটি নিয়ে দারুণ একটা উদ্ধৃতি পড়ে এসেছি ‘শূন্য চেয়ার’ আর সিটিভি ভবন যাওয়ার আগেই। ক্রাইস্টচার্চের ভূমিকম্প নিয়ে ‘কোয়েক সিটি’ নামে একটা জাদুঘরই বানিয়ে ফেলা হয়েছে। সেটিতে ২০১০ আর ২০১১ পরপর দু্ই বছরে নিকট অতীতের সবচেয়ে বড় দুটি ভূমিকম্পের নানা স্মৃতিচিহ্ন রাখা। দ্বিতীয় ভূমিকম্পটিতে মৃত্যুপুরীতে পরিণত হওয়া ক্রাইস্টচার্চ আবার কীভাবে প্রাণ ফিরে পেল, আছে সেই বিশাল কর্মযজ্ঞের বিস্তারিতও। ভিডিওতে দেখতে পাবেন ওই ভূমিকম্প এবং এর পরবর্তী প্রতিক্রিয়ার কারণ নিয়ে ভূতত্ত্ববিদদের বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা। একটা জায়গায় ভূমিকম্পে নিহতদের আত্মীয়স্বজনের স্মৃতিচারণা, ভাগ্যক্রমে বেঁচে যাওয়াদের সেই অভিজ্ঞতার বর্ণনা নিয়ে তৈরি প্রামাণ্য চিত্র চলছে বড় পর্দায়।
২০১০ আর ২০১১ নিকট অতীত বলেই ক্রাইস্টচার্চে ভূমিকম্প বললে এই দুটির কথা মনে পড়ে। ধ্বংসযজ্ঞ বেশি চালিয়েছে বলে দ্বিতীয়টি আরও বেশি। ‘কোয়েক সিটি’তে ঢুকতেই সামনের দেয়াল জুড়ে সাল উল্লেখ করে মনে করিয়ে দেওয়া হয়েছে, এই ক্রাইস্টচার্চ শহরের জন্মলগ্ন থেকেই ভূমিকম্পের সঙ্গে এর পরিচয়। এই শহরের নিচে বিশ্বের সবচেয়ে বড় দুটি টেকটোনিক প্লেটের অবস্থান। অস্ট্রেলিয়ান আর প্যাসিফিক প্লেটের মতিগতির ওপরই তাই নির্ভর করে এই শহরের অস্তিত্ব। সে কথা মনে করিয়ে দিতে কোয়েক সিটিতে ভূমিকম্পের ইতিহাসের নিচেই উদ্ধৃত উইল ডুরান্টের একটা উক্তি—‘সভ্যতা টিকে থাকে ভূতাত্ত্বিক সম্মতির ভিত্তিতে, যেটি যেকোনো সময়ে বিনা নোটিশে বদলে যেতে পারে।’ কথাটা যে কত সত্যি, সেটি তো যেকোনো প্রাকৃতিক দুর্যোগের সময়ই টের পাওয়া যায়। সভ্যতা নিয়ে ডুরান্টের যেকোনো কথাই আসলে শিরোধার্য। সভ্যতার ইতিহাস লিখেই তো তাঁর আসল খ্যাতি। স্ত্রী অ্যারিয়েল ডুরান্টের সঙ্গে যৌথভাবে ১১ খণ্ডের ‘দ্য স্টোরি অব সিভিলাইজেশন’ বইয়ের লেখকের অনেক কথাই তো ‘স্মরণীয় বাণী’র মর্যাদা পেয়ে গেছে।
‘ভূকম্পের শহর’ নামটা আসলে যথার্থই। সব ভূমিকম্প সমান ধ্বংসযজ্ঞ চালায় না, কোনোটি হয়তো একটু কাঁপুনি দিয়েই শান্ত হয়ে যায়। তা না হলে ক্রাইস্টচার্চ বলে কোনো শহর আর থাকত না। শুনলে বিশ্বাস করবেন কি না, ২০১২ সালের ২২ ফেব্রুয়ারির ওই মহা আলোচিত ভূমিকম্পের পর ক্রাইস্টচার্চে আরও প্রায় দশ হাজার বার ভূমিকম্প হয়েছে!
মাওরি উপকথা বিশ্বাস করলে কিন্তু এসবে টেকটোনিক প্লেটের কোনো ভূমিকা নেই। সবই রোয়াওমোকোর কাণ্ড! তা এই রোয়াওমোকোটা কী? ‘কী’ নয়, প্রশ্নটা হবে—কে? নিউজিল্যান্ডের আদিবাসী মাওরিরা বিশ্বাস করে, রোয়াওমোকো হলেন ভূমিকম্প আর আগ্নেয়গিরির দেবতা। তাঁর বাবা-মা আত্মীয়স্বজনের ষড়যন্ত্রে বিচ্ছিন্ন হয়ে যাওয়ার পর তিনি এখনো মায়ের গর্ভেই আছেন। গর্ভস্থ রোয়াওমোকো যখন লাথি মারেন বা গা মোচড় দেন, তখনই আসলে ভূমিকম্প হয়। বিশ্বাস না করে উপায় কী, ‘কোয়েক সিটি’তে ঢুকতেই যে এ কথা লেখা!