জিমি নিশামের ছোট্ট এক টুইটেই টেস্ট চ্যাম্পিয়নশিপ ফাইনালের সব মাহাত্ম্য উঠে এসেছিল। টেস্টের ষষ্ঠ দিনের প্রথম সেশনের খেলা শেষ হয়েছে একটু আগেই। নিউজিল্যান্ডের অলরাউন্ডারের টুইট, ‘মজার ব্যাপার, ভারত যদি এখন কিছু উইকেট হারায়, তাহলে শুধু নিউজিল্যান্ডের জয়ের সম্ভাবনাই বাড়বে না, ভারতেরও বাড়বে।’
ভারত মধ্যাহ্নবিরতিতে গিয়েছিল ৫ উইকেটে ১৩০ রান তুলে। প্রথম ইনিংসের ঘাটতি পুষিয়ে নিয়ে ততক্ষণে ভারত এগিয়ে আছে ৯৮ রানে। টেস্টের শেষ দিনের দুই সেশন মাত্র বাকি। ভারতকে ম্যাচ জিততে হলে আরও ১৫ উইকেটের পতন দেখতে হবে এই সময়ে। তবু এ ম্যাচে সম্ভাব্য চারটি ফলই হওয়ার সম্ভাবনা ছিল। তখন পর্যন্ত ড্র হওয়ার সম্ভাবনাই বেশি ছিল। কিন্তু দুই দলের যেকোনো একজনের জয়ী হওয়া কিংবা টাই হওয়ার সম্ভাবনাও উড়িয়ে দেওয়ার উপায় ছিল না।
শেষ দুই সেশন অনেক নাটকই দেখাল। শুরুতে ভারতের ধস দেখল সাউদাম্পটন। একটু পরই নিউজিল্যান্ডের সমর্থকদের মুখও অন্ধকার হয়ে উঠল। কিন্তু শেষমেশ নাটকের শেষ দিকটা পানসে করে তুলল নিউজিল্যান্ড। দারুণ পেশাদারির সঙ্গে প্রথম টেস্ট চ্যাম্পিয়নশিপের ফাইনাল ৮ উইকেটে জিতে নিল কিউইরা। টেস্টে এখন আনুষ্ঠানিকভাবেই সেরা দল নিউজিল্যান্ড।
টেস্টের জনপ্রিয়তা বাড়ানোর জন্য ও দ্বিপক্ষীয় সিরিজের গুরুত্ব বাড়ানোর জন্য দুই বছর মেয়াদি টেস্ট চ্যাম্পিয়নশিপের আয়োজন করেছে আইসিসি। পয়েন্ট পদ্ধতিতে দুই বছরের দৌড়ে সবার শীর্ষে থাকা দুই দল বেশ আয়োজন করেই মুখোমুখি হয়েছিল ফাইনালে। সবার প্রচণ্ড আগ্রহে আক্ষরিক অর্থে জল ঢেলে দিয়েছিল প্রকৃতি। বৃষ্টি–বাধায় প্রায় প্রতিদিনই খেলা বিঘ্নিত হয়েছে। প্রথম ও চতুর্থ দিনের পুরোটা তো বৃষ্টিই কেড়ে নিয়েছে। শুধু ফাইনালের জন্য একটি রিজার্ভ ডে রেখে ষষ্ঠ দিন করার নিয়মটাও কাজে আসবে না বলে মনে হচ্ছিল।
তবু শেষ দিনের শুরুটা হয়েছিল জমজমাট এক ফাইনালের পূর্বাভাস নিয়েই। সাউদাম্পটনের উইকেটে যখনই খেলার সুযোগ মিলেছে, তখনই ব্যাটসম্যানরা পরীক্ষা দিয়েছেন। ২ উইকেটে ৬৪ রান নিয়ে শেষ দিন শুরু করেছিল ভারত। কিন্তু কাইল জেমিসনের দারুণ দুই বল মুহূর্তে ৪ উইকেটে ৭২ করে দেয় ভারতকে। বিরাট কোহলি (১৩) ও চেতেশ্বর পূজারার (১৫) পর মধ্যাহ্নবিরতির আগেই অজিঙ্কা রাহানেকেও (১৫) হারায় র্যাঙ্কিংয়ের দুইয়ে থাকা দলটি।
কারণ, শীর্ষে থাকা দলটি খেলছিল শীর্ষে থাকার মতো। কোনো স্পিনার ছাড়া নেমে বিশেষজ্ঞদের ভ্রু কুচকে দিয়েছিল কিউইরা। কিন্তু টিম সাউদি (৪), কাইল জেমিসন (২), ট্রেন্ট বোল্ট (৩) ও নিল ওয়াগনাররা (১) প্রমাণ করে দিয়েছেন সাউদাম্পটনের এই উইকেটে একজন স্পিনার ছাড়া নামলেও খুব একটা ক্ষতি নেই। সম্পূর্ণ ভিন্ন চার ধরনের পেসারের আক্রমণ সামলে ওঠা হয়নি ভারতের। এর মধ্যেও পাল্টা আক্রমণে গেছেন ঋষভ পন্ত। অন্য ব্যাটসম্যানরা যেখানে কোনোমতে উইকেট বাঁচিয়ে টিকে থাকার লড়াইয়ে নেমেছিলেন, সেখানে পন্তই বুঝেছিলেন বাড়তি রান মানে দলকে আরেকটু বাড়তি সময় এনে দেওয়া।
পন্তের ব্যাটিংয়ের ধরন নিয়ে শুদ্ধ বাতিকদের ক্ষোভ থাকতে পারে। কিন্তু নিউজিল্যান্ডের পেসারদের একটু হলেও অস্বস্তিতে ফেলছিলেন পন্ত। কিন্তু বোল্টকে হাঁকাতে গিয়ে পন্তের বিদায় ভারতের শেষের শুরুটা করে দেয়। ৪১ রান করা পন্তের আগেই ষষ্ঠ ব্যাটসম্যান হিসেবে রবীন্দ্র জাদেজা বিদায় নিয়েছেন। ২৮ রানে শেষ ৫ উইকেট হারিয়ে ১৭০ রানে গুটিয়ে যায় ভারত।
১৩৯ রানের লক্ষ্য। হাতে আছে ৫৩ ওভার। জিমি নিশাম তাই নতুন টুইট করলেন। কিউই অলরাউন্ডারের চোখে, এই ম্যাচে নিউজিল্যান্ডের জয়ের সম্ভাবনা ৮০ ভাগ, ড্রয়ের সম্ভাবনা ১৯ ভাগ। আর ভারতের জয়ের সম্ভাবনা মাত্র ১ শতাংশ।
নিউজিল্যান্ড ইনিংসের ১০ ওভার শেষে ভারতের সম্ভাবনা শূন্য বলে নিশাম টুইট করলেও আপত্তি করতেন না কেউ। ভারতের পেসাররা ভালো বল করছিলেন, টম ল্যাথামরাও করছিলেন অতি সাবধানী ব্যাটিং। এতে ড্রয়ের সম্ভাবনা বাড়ার পাশাপাশি ভারতের জয়ের সম্ভাবনা ক্রমশ শূন্যের দিকেই এগোচ্ছিল। ম্যাচটা জমানোর দায়িত্ব নিলেন রবিচন্দ্রন অশ্বিন। অবশ্য পার্শ্বনায়ক হিসেবে ল্যাথামের নামটাও বলা যায়। ৪০ বলে ৯ রান করে নিজের ওপরই চাপ সৃষ্টি করেছিলেন কিউই ওপেনার।
চাপ সরাতে উইকেট ছেড়ে বেড়িয়ে এলেন। লাইন মিস করায় আর ফেরা হয়নি তাঁর। ৩৩ রানে প্রথম উইকেট হারানো নিউজিল্যান্ডকে পরের ওভারেই আবার ধাক্কা দিয়েছিলেন অশ্বিন। ১ রানে থাকা নিউজিল্যান্ড অধিনায়ককে এলবিডব্লু দিয়ে দিয়েছিলেন আম্পায়ার মাইকেল গফ। সঙ্গে সঙ্গে রিভিউ নিয়েছেন কেইন উইলিয়ামসন। রিভিউ জানিয়ে দেয়, বল লেগ স্টাম্পের বাইরে দিয়েই যেত। জয়ের জন্য তখনো নিউজিল্যান্ডের দরকার ১০০ রান।
অশ্বিন পরের ওভারেই হতাশা ভুলেছেন। এলবিডব্লু হয়ে ফিরলেন ডেভন কনওয়ে (১৯)।
ব্রেন্ডন টেলর নামার পর চাপ যেন আরও বাড়ল নিউজিল্যান্ডের। কোনোভাবেই রান করতে পারছিলেন না টেলর। ওদিকে উইলিয়ামসনও পারছিলেন না স্ট্রাইক বদলাতে। মাঝে একসময় ৩১ বলে কোনো রান পায়নি নিউজিল্যান্ড। প্রথম ১৮ বলে কোনো রান করতেই পারেননি টেলর। মোহাম্মদ শামির বলে চার মেরে ঘোর কাটালেন। পরের তিন স্কোরিং শটের দুটিও চার। রান তোলার গতি এরপর শুধু বেড়েছে। ২২ ওভার শেষে ৪৬ রান করা নিউজিল্যান্ড পরের ৮ ওভারে ৩৮ রান তুলে নিয়েছে।
এরপরই ম্যাচে ফেরার একটা সুযোগ পেয়েছিল ভারত। বুমরার বলে স্লিপে ক্যাচ দিয়েছিলেন টেলর। কিন্তু ২৬ রানে থাকা টেলরের সহজ ক্যাচ ফেলে দিয়েছেন পূজারা। ম্যাচের ভাগ্যে যে নিউজিল্যান্ডের জয় ছাড়া আর কিছু লেখা নেই, সেটা তখনই টের পাওয়া গেছে। ৩৭ ওভারে তিন অঙ্ক ছোঁয় নিউজিল্যান্ড। খানিক পরই ম্যাচটা ১৫ ওভার, ৮ উইকেট ও ৩৫ রানের সমীকরণে দাঁড়ায়।
জয় থেকে ১২ রান দূরে, এ অবস্থায় একটা সুযোগ দিয়েছিলেন কেইন উইলিয়ামসন। কিন্তু শামির বলে হাস্যকরভাবে ক্যাচ ফেলেন যশপ্রীত বুমরা। পরের বলেই চার মেরে ফিফটি পেয়ে গেছেন উইলিয়ামসন। শুরুতে বেশ ধীরতালে খেলেও ফিফটি পেতে মাত্র ৮৬ বল দরকার হয়েছে নিউজিল্যান্ড অধিনায়কের। দুই ওভার পরই শামির বলে চার মেরে আনুষ্ঠানিকতা শেষ করলেন টেলর। উইলিয়ামসন ৫২ রানে অপরাজিত ছিলেন। ৯৬ রানের জুটির সঙ্গী টেলর ৩ রানের জন্য ফিফটি পাননি। কিন্তু আগের ৫৪টি পঞ্চাশোর্ধ্ব ইনিংস যা দেয়নি সেটাই তো পেলেন আজ। প্রথম টেস্ট চ্যাম্পিয়নশিপের মুকুট!