বুকে দুঃসহ কষ্ট নিয়ে বেঁচে আছেন যেসব ক্রিকেটার

ক্রিকেটাররা মাঠে আনন্দ-বেদনার উৎস হয়ে থাকেন ক্রিকেটপ্রেমীদের। তাঁদের দুর্দান্ত পারফরম্যান্স কখনো দর্শকদের আনন্দের স্রোতে ভাসায়, কখনো তাঁদের ব্যর্থতা ছুঁয়ে যায় সবাইকে। অনেক সময় এই ক্রিকেটাররা নির্দিষ্ট দেশ ও জাতির হাসি-কান্নার উপলক্ষ হয়ে ওঠেন। কিন্তু দিন শেষে তাঁরাও তো মানুষ। ক্রিকেট মাঠের সেই তারকারও আছে ব্যক্তিগত জীবনের আনন্দ, অসীম দুঃখবোধ। কোনো কোনো সময় জীবনে ঘটে যাওয়া কোনো ঘটনা তাঁদের তাড়িয়ে বেড়ায় আজীবন। যেকোনো সাফল্য-ব্যর্থতায় অবচেতন মনেই তাঁরা ফিরে যান সেই দুঃসহ কষ্ট ঘেরা সময়গুলোর কাছে। এই লেখায় অমন পাঁচজন ক্রিকেটারের জীবনের ট্র্যাজিক ঘটনা তুলে ধরা হয়েছে। যে ঘটনাগুলো নিরন্তর কষ্টের কারণ হয়ে থাকবে তাঁদের জন্য জীবনভর।

স্ত্রী হুমা ছিলেন ওয়াসিম আকরামের সুখ-দুঃখের সাথি। ফাইল ছবি
স্ত্রী হুমা ছিলেন ওয়াসিম আকরামের সুখ-দুঃখের সাথি। ফাইল ছবি

ওয়াসিম আকরাম
১৯৯৫ সালে মনোবিদ হুমা মুফতিকে বিয়ে করেন ওয়াসিম আকরাম। পাকিস্তানের এই কিংবদন্তি তারকা অবশ্য হুমার সঙ্গে পরিচিত হয়েছিলেন আগেই। ১৯৯১ থেকে ১৯৯৪ পর্যন্ত পাকিস্তান দলের মনোবিদ হিসেবে কাজ করেছিলেন হুমা। সে সময়ই পরিচয়, পরিচয় থেকে প্রেম। সেই প্রেমেরই সার্থক পরিণতি ’৯৫ সালে বিয়ের মধ্য দিয়ে। দারুণ সুখের সংসার ছিল এ দুজনের। অনেকেই বলেন হুমা ছিলেন আকরামের আঁকড়ে ধরা খুঁটি। ক্যারিয়ারের সব খারাপ সময়ে স্ত্রী হুমাই ছিলেন তাঁর সবচেয়ে বড় অবলম্বন। ১৯৯৬ সালে তাঁদের প্রথম সন্তান তাহমূর ও ২০০০ সালে দ্বিতীয় সন্তান আকবরের জন্ম হয়।

কিন্তু তাঁদের সুখের জীবনে অন্ধকার নেমে আসে হুমার মস্তিষ্কে টিউমার ধরা পড়লে। কিন্তু টিউমার অস্ত্রোপচারের সময় কিডনি ও অন্যান্য জটিলতায় আক্রান্ত হন তিনি। এয়ার অ্যাম্বুলেন্সে করে তাঁকে পাকিস্তান থেকে সিঙ্গাপুর নেওয়ার সময় ২০০৯ সালের অক্টোবরে তিনি মারা যান চেন্নাইয়ে।

ছেলেকে নিজের উপহার দেওয়া বাইকই কাল হলো আজহারের। ফাইল ছবি

মোহাম্মদ আজহারউদ্দিন
মোহাম্মদ আজহারউদ্দিন বয়ে নিয়ে বেড়াচ্ছেন অসহনীয় এক কষ্ট। ২০১১ সালে তিনি হারিয়েছেন তাঁর ছেলে মোহাম্মদ আয়াজউদ্দিনকে। ১৯ বছরের তরুণ আয়াজ মারা যান এক মোটরবাইক দুর্ঘটনায়। ছেলের এ মৃত্যুর জন্য আজহার আজীবন নিজেকে দায়ী করে যাবেন কিনা, কে জানে! তিনিই যে ছেলেকে জন্মদিনে উপহার দিয়েছিলেন সেই অভিশপ্ত মোটরবাইকটি।

আয়াজ ক্রিকেট দারুণ খেলত। কলেজ পর্যায়ে দুর্দান্ত ক্রিকেটার হিসেবেই সে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেছিল। কিন্তু বাইক চালানোর প্রচণ্ড শখ ছিল তাঁর। বাবার কাছে আবদার করে সেটি পেয়েও যায়। কিন্তু ২০১১ সালের সেপ্টেম্বরে হায়দরাবাদ এক্সপ্রেসওয়েতে দুর্ঘটনায় পড়ে মারাত্মক আহত হয় আয়াজ। পাঁচ দিন পর মারা যায় সে।

নিজেকে ক্রিকেট থেকে অনেক দূরে সরিয়ে নিয়েছেন সাঈদ আনোয়ার। ফাইল ছবি

সাঈদ আনোয়ার
নব্বইয়ের দশকের অন্যতম সেরা ব্যাটিং তারকা সাঈদ আনোয়ার। সীমিত ওভারের ক্রিকেটে ডাবল সেঞ্চুরিটার খুব কাছে চলে গিয়েছিলেন ১৯৯৭ সালে, ভারতের বিপক্ষে করেছিলেন ১৯৪ রান, যা বহুদিন পর্যন্ত ওয়ানডের শীর্ষ স্কোর হয়ে ছিল। বাঁ হাতি এই ব্যাটসম্যানের ব্যাটিংয়ে মুগ্ধ হননি, এমন ক্রিকেটপ্রেমী খুঁজে পাওয়া মুশকিল। কিন্তু সাঈদ আনোয়ারের জীবনেই অন্ধকার নেমে আসে ২০০১ সালে। সে বছর আনোয়ারের সাড়ে তিন বছর বয়সী মেয়ে বিসমাহ মারা যায় দীর্ঘ রোগভোগের পর। আদরের কন্যার মৃত্যু আনোয়ারকে দারুণভাবে প্রভাবিত করে। ধর্মীয় অনুশাসনের দিকে কড়াকড়িভাবে ঝুঁকে পড়েন। তাবলিগ জামাতের সঙ্গে ঘুরে বেড়ান এখন। ক্রিকেট তাঁর জীবনের দূর অতীতেরই এক বিষয়।

বাবার মৃতদেহ দেখাটা জীবনের বড় দুঃখবোধ জনি বেয়ারস্টোর। ফাইল ছবি

জনি বেয়ারস্টো
জনি বেয়ারস্টোর বাবা ডেভিড বেয়ারস্টোও খেলেছেন ইংল্যান্ডের হয়ে। ছেলে জনি ছোট থেকে ক্রিকেটে আসক্ত বাবাকে দেখেই। ছেলেও এক সময় বাবার পদাঙ্ক অনুসরণ করল, কিন্তু তত দিনে বাবা নেই। স্বাভাবিক মৃত্যু হলেও একটা সান্ত্বনা ছিল, কিন্তু ডেভিড যে করেছিলেন আত্মহত্যা!

জনি বেয়ারস্টোর বয়স যখন নয়, তখন ক্যানসারে আক্রান্ত হন তাঁর মা। বেশ খরচের ছিল সেই চিকিৎসা। বাবা ডেভিড আপ্রাণ চেষ্টা করে গেলেও কিছুতেই কুলিয়ে উঠতে পারছিলেন না। হতাশ ও বিপন্ন হয়ে একদিন তিনি আত্মহত্যা করলেন। সবচেয়ে কষ্টের ব্যাপার হচ্ছে, সিলিংয়ে ঝুলতে থাকা বাবার মৃত দেহ আবিষ্কার করেছিল ছোট্ট জনিই।

মা কিন্তু এরপর ঠিকই ক্যানসারের সঙ্গে লড়ে গেছেন। মানুষ করেছেন জনিকে। বানিয়েছেন ক্রিকেটার। এক সময় ইংল্যান্ডের হয়ে খেললেন তিনি, জিতলেন বিশ্বকাপ। কিন্তু বাবা ডেভিড সঙ্গে থাকলেন না।

মেয়েকে ক্যানসারে হারিয়েছেন আসিফ আলী। ফাইল ছবি

আসিফ আলী
ওয়াসিম আকরাম, মোহাম্মদ আজহারউদ্দিন কিংবা জনি বেয়ারস্টোর তুলনায় খ্যাতিতে বহু ক্রোশ পেছনে পাকিস্তানি ব্যাটসম্যান আসিফ আলী। কিন্তু জীবনের বেদনা তাঁর আকরাম, আজহারদের চেয়ে কোনো অংশে কম নয়। আসিফ যে ক্যানসারে হারিয়েছেন তাঁর আদরের ছোট্ট মেয়ে ফাতিমাকে।

২০১৮ সালে দেশের হয়ে অভিষিক্ত আসিফ খেলেছেন ১৬টি ওয়ানডে। একটা সময় পাকিস্তান দলে প্রায় নিয়মিতই হয়ে উঠেছিলেন। কিন্তু ভাগ্য সহায় হয়নি। ২০১৯ বিশ্বকাপের আগে ইংল্যান্ডের বিপক্ষে ওয়ানডে সিরিজে আসিফ দুটি ফিফটি করেছিলেন। দুই বছরের ফাতিমা তখন ক্যানসারের সঙ্গে লড়ছে। মেয়ের মৃত্যুর পর বিশ্বকাপ দলেও সুযোগ পেয়েছিলেন। ছোট্ট কন্যার মৃত্যুর শোক সামলেই।