>বিশ্বকাপে বাংলাদেশের ব্যাটিং এবং বোলিংয়ের চেহারা একেবারেই আলাদা। ব্যাটিংয়ে যতটা উজ্জ্বল সাকিব-মুশফিকেরা, বোলিংয়ে যেন ততটাই বিবর্ণ মাশরাফি বাহিনী। পরিসংখ্যানও সেই বিষয়টির দিকেই ইঙ্গিত করছে, বিশ্বকাপের অন্যতম বাজে বোলিং আক্রমণ বাংলাদেশের।
‘নখদন্তহীন’, এই একটি শব্দ দিয়েই বিশ্বকাপে বাংলাদেশের বোলিং আক্রমণকে বিশ্লেষণ করা যায়। বিশ্বকাপে বাংলাদেশের বোলিং দেখে প্রতিপক্ষদের মনে যেমন এক চিলতে ভয়ের উপস্থিতি ঘটেনি, তেমনি সমর্থকেরাও এই বোলিং নিয়ে বিশ্বকাপজুড়েই ভালো কিছুর আশায় বাঁধ দিয়ে রেখেছেন।
গতি নেই, বাঁক নেই, ফিটনেস নেই; বাংলাদেশের বোলিংয়ে শুধু ‘নেই, নেই’য়ের গুঞ্জন। সাকিব-মুশফিকদের ব্যাট বিশ্বকাপে চওড়া হয়েছে নিয়মিত, কিন্তু তাতেও খুব একটা কাজ হয়নি না। বোলারদের বদান্যতায় রানের পাহাড় নিয়মিত গড়ে তুলেছে প্রতিপক্ষ। পেস বান্ধব ইংলিশ কন্ডিশনে যেখানে গতি আর স্লোয়ারে আতঙ্ক জাগিয়েছেন অন্যান্য দলের বোলাররা, সেখানে সাইফউদ্দিনরা রান দিতেই ব্যস্ত। অবশ্য সঙ্গে মাখন হাতের ফিল্ডিংয়ের ভূমিকাও উল্লেখযোগ্য।
গতিময় পেসার তৈরিতে বাংলাদেশ বিখ্যাত নয়, পুরো ক্রিকেট ইতিহাসে হাতে-গোনা কয়েকজন বোলার পেয়েছে বাংলাদেশ যারা ১৪০ কিলোমিটার বা তার বেশি গতিতে বোলিং করতে পারে। বিশ্বকাপে যারা খেলেছেন তাদের মাঝে একমাত্র রুবেল হোসেনেরই ১৪০ এর ওপর বোলিং করতে পারার ক্ষমতা ছিল, সেটাও করে দেখাতে পারেননি এই পেসার। মাশরাফি-সাইফউদ্দিনদের গতি ব্যাটিং সহায়ক উইকেটে নিখাদ উপহার। ইংল্যান্ডের উইকেটে মিচেল স্টার্ক, জফরা আর্চার, লকি ফার্গুসনরা গতি ও সুইং দিয়ে ব্যাটসম্যানদের ঘাম ছোটাচ্ছেন। মোহাম্মদ আমির বাড়তি বাউন্স ও বৈচিত্র্যে বিভ্রান্ত করছেন। সে তুলনায় বৈচিত্র্যহীন বোলিং নিয়ে বাংলাদেশকে বড্ড অসহায় দেখাচ্ছে।
পরিসংখ্যানের দিকে তাকালে বাংলাদেশের বোলিংয়ের কঙ্কালসার চেহারাটা যেন আরও স্পষ্ট হয়ে ওঠে। ভারত ম্যাচের আগে বিশ্বকাপে বাংলাদেশের বোলাররা ৪২টি উইকেট তুলে নিতে পেরেছে। গতকাল পর্যন্ত বাংলাদেশের পেছনে শুধু শ্রীলঙ্কাই ছিল। গতকাল মোস্তাফিজ ও সাকিবের সুবাদে আফগানিস্তান ও ওয়েস্ট ইন্ডিজকেও পেছনে ফেলেছে বাংলাদেশ। কিন্তু এ তিনটি দলের ব্যাটসম্যানরা বেশ কিছু ম্যাচেই বোলারদের লড়াই করার পুঁজি দিতে পারেননি। বাংলাদেশের ব্যাটসম্যানদের প্রতি সে অভিযোগের আঙুল তোলার উপায় নেই।
বোলিংয়ে প্রতিপক্ষকে দুহাত ভরে রান দেওয়ার দৌড়েও বাংলাদেশ বিশ্বকাপে সবার চেয়ে এগিয়ে। এবারের বিশ্বকাপে ওভার প্রতি গড়ে ৬ এর ওপরে রান দিয়েছে দুটি দল। তাঁর একটি ওয়েস্ট ইন্ডিজ আর অপরটি বাংলাদেশ। তবে প্রতি ওভারে প্রতিপক্ষের ঝুলিতে ৬.১৮ রান যুক্ত করে বাংলাদেশ ওভার প্রতি সবচেয়ে বেশি রান দেওয়ার দৌড়ে ওয়েস্ট ইন্ডিজকেও (৬.০৫) পেছনে ফেলেছে। বোলিং গড় তথা প্রত্যেকটি উইকেট পেতে কত রান খরচ করতে হয়েছে, সেই পরিসংখ্যানেও বাংলাদেশ সবার তলানিতে ছিল। উইকেট তুলে নিতে কমপক্ষে ৪৩.৩০ রান খরচ করছিলেন বাংলাদেশের বোলাররা। গতকাল ভারতের বিপক্ষে পাওয়া ৮ উইকেটে (বোলারদের পাওয়া) সেটা ৪২.৫৪তে নেমে এসেছে। এ ক্ষেত্রেও বাংলাদেশের চেয়ে পিছিয়ে আছে কারা? আফগানিস্তান (৪২.৯৭) ও শ্রীলঙ্কা (৪৩.২৫)।
পেস বান্ধব কন্ডিশনে ইংল্যান্ড, অস্ট্রেলিয়া, নিউজিল্যান্ডের পেসাররা বল হাতে বিশ্বকাপ শাসন করবে সেটা জানাই ছিল। কিন্তু উপমহাদেশের ভারত এবং পাকিস্তানের পেসাররাও জ্বলে উঠছেন নিয়মিত। বিশ্বকাপ থেকে বিদায় নেওয়া শ্রীলঙ্কার হয়ে ‘বুড়ো’ মালিঙ্গাও কিন্তু ব্যাটসম্যানদের বুকে কাঁপন ধরিয়েছেন বিশ্বকাপ ২০১৯ জুড়ে। ভারতের মোহাম্মাদ শামি, যশপ্রীত বুমরাদের বুদ্ধিদীপ্ত বোলিংয়ে খাবি খাচ্ছে প্রতিপক্ষরা, তেমনি আমির-ওয়াহাব-শাহিনদের দিয়ে গড়া পেস ত্রয়ীতে ভর করে এগিয়ে যাচ্ছে পাকিস্তান।
বাংলাদেশের পেস আক্রমণ দক্ষিণ এশীয় প্রতিবেশীদের সঙ্গেই পেরে উঠছে না। প্রিয় প্রতিপক্ষ ভারতকে পেয়ে উইকেটে সাকিবকে(১১) টপকে গেছেন মোস্তাফিজ (১৫)। কিন্তু ইকোনমি রেট (৬.৫৭) বলে দিচ্ছে বিশ্বকাপে আগের ম্যাচগুলোয় মোস্তাফিজের পারফরম্যান্স কেমন ছিল। ১০ উইকেট পাওয়া সাইফউদ্দিনের ইকোনমি তো আরও হতাশাজনক, ৬.৯৩। দলের মতো পেস আক্রমণের নেতৃত্বও দেওয়ার কথা ছিল মাশরাফির। কিন্তু ৭ ম্যাচে মাত্র ৪৯ ওভার বল করা কিংবা ৩১৫ গড়ে ১ উইকেট পাওয়া অথবা ৬.৪২ ইকোনমিতে রান দেওয়া বলছে, মাশরাফি তাঁর কাজে ব্যর্থ হয়েছেন।
স্পিনারদের মাঝেও এক সাকিব ছাড়া বাকিরা মোটামুটি মানের বোলিং করেছেন। ৫.৩৪ ইকোনমিতে ১১ উইকেট তুলে নিয়ে সাকিবই সবচেয়ে উজ্জ্বল। ৬ ম্যাচে ৫ উইকেট পাওয়া মিরাজের ইকোনমিও ছয়ের নিচে (৫.৪৫)। ৩ উইকেট পাওয়া মোসাদ্দেকেরও তাই (৫.৮৭)। রান আটকে রাখার দিক দিয়ে স্পিনাররা কিছুটা অবদান রাখতে পারলেও মিডল ওভারে উইকেট তুলে নিয়ে প্রতিপক্ষকে বিপদে ফেলতে পারেননি সাকিব ছাড়া অন্য কেউ।
এমন বোলিং নিয়ে বিশ্বকাপের সেমিফাইনাল খেলার আশা করাটা হয়তো বাড়াবাড়িই!