চিন্তাটা প্রথম খেলে বিসিবির সাবেক সভাপতি ও বর্তমান পরিকল্পনামন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামালের মাথায়। বাংলাদেশের মানুষ বুভুক্ষুর মতো আইপিএল দেখে। যে দেশে টি-টোয়েন্টি ক্রিকেটের এত জনপ্রিয়তা, সে দেশেই কেন একটা ফ্র্যাঞ্চাইজি টুর্নামেন্ট হবে না! ক্রিকেটের বাজার কি বাংলাদেশে কম?
যে-ই ভাবনা, সে-ই কাজ। ২০১২ সালের ফেব্রুয়ারিতে মাঠে গড়াল প্রথম বিপিএল। আজ শুরু হচ্ছে এর চতুর্থ আসর। কিন্তু দুর্ভাগ্য, শুরু থেকেই নানা ঝড়-ঝঞ্ঝা আর প্রতিকূলতার মধ্য দিয়ে যেতে হচ্ছে এই টুর্নামেন্টটিকে। বাধা এসেছে দেশের বাইরে থেকেও। আইসিসির সাবেক এক প্রধান তাঁর দেশের ফ্র্যাঞ্চাইজি টুর্নামেন্টের বাজার কমে যাওয়ার শঙ্কায় বিপিএল বন্ধের চাপ দিয়েছিলেন। কিন্তু তাতে লাভ তো হয়ইনি, উল্টো কড়া জবাবই পেয়েছিলেন সাবেক বোর্ড সভাপতি মুস্তফা কামালের কাছ থেকে।
বিপিএলের যাত্রাপথ মসৃণ ছিল না ঘরেও। প্রথম বিপিএল সেমিফাইনাল পর্বে আসার পর বিতর্ক বেধে গেল বাইলজ নিয়ে। পরের বিপিএলে হলো স্পট ফিক্সিং কাণ্ড। যেটি হয়ে আছে বাংলাদেশের ক্রিকেট ইতিহাসের কালো এক অধ্যায়। ঢাকা গ্ল্যাডিয়েটরসের খেলোয়াড় মোহাম্মদ আশরাফুলের বিরুদ্ধে স্পট ফিক্সিংয়ের অভিযোগ প্রমাণিত হওয়ায় সব ধরনের ক্রিকেট থেকে বহিষ্কৃত হন তিনি। শাস্তি হয় মালিকপক্ষসহ আরও দু-একজন ক্রিকেটারেরও। এ ঘটনা বাংলাদেশের ক্রিকেটকে এতটাই নাড়িয়ে দিয়েছিল যে, পরের বছর বিপিএল আর হয়ইনি।
দুই বছর বিরতি দিয়ে টুর্নামেন্টের তৃতীয় আসর বসে গত বছরের শেষ দিকে। প্রথম তিন আসরের মধ্যে সবচেয়ে গোছানো ছিল সেটিই। এর মূলে ছিল আর্থিক দিক থেকে বাস্তবোচিত সিদ্ধান্ত নেওয়া। শুরুর দিকে খেলোয়াড় কেনার উন্মুক্ত নিলাম পদ্ধতিতে ক্রিকেটারদের অবাস্তব মূল্য ধরায় প্রায় কোনো ক্রিকেটারই নিলামে ওঠা দামের পুরো টাকা পাননি। অনিয়ম ছিল ফ্র্যাঞ্চাইজি ফিসহ অন্যান্য আর্থিক বিষয়েও। বিসিবির লোকজনেরই ইভেন্ট ম্যানেজমেন্ট কোম্পানির সঙ্গে জড়িয়ে যাওয়াকেই সেসব অস্বচ্ছতার বড় কারণ মনে করা হয়।
দুই বছর বিরতির পর গত বিপিএলে বিশৃঙ্খলা কিছুটা কমিয়ে আনে বিসিবি। নিলামপদ্ধতি থেকে সরে এসে ‘প্লেয়ারস বাই চয়েজের’ মাধ্যমে হয় খেলোয়াড় বণ্টন। এতে খেলোয়াড়দের মূল্য আগে থেকেই নির্ধারণ করে দেওয়া হয়, যার সুফল দেরিতে হলেও বেশির ভাগ ফ্র্যাঞ্চাইজিই খেলোয়াড়দের পারিশ্রমিক পরিশোধ করেছে। ব্যতিক্রম শুধু এবার নতুন মালিকের হাতে যাওয়া রংপুর রাইডার্স। এই দলের খেলোয়াড়দের দুর্ভাগ্য, এবারের বিপিএলের আগেও তাদের বিসিবির কাছে ধরনা দিতে হচ্ছে গতবারের টাকার জন্য। কাল দুপুরেও এক খেলোয়াড় হতাশা প্রকাশ করে বলছিলেন, ‘সবাই টাকা পেয়ে গেল, অথচ আমরাই পেলাম না। বিসিবিও কোনো ব্যবস্থা নিচ্ছে না। এর দায়িত্ব তাহলে কে নেবে?’
প্রথম থেকেই বিপিএলের অন্যতম নেতিবাচক দিক ফ্র্যাঞ্চাইজি মালিকদের গালভরা কথা। খেলোয়াড় নেওয়ার সময় টাকা তাঁদের কাছে কোনো সমস্যা নয়, দেওয়ার সময়ই সমস্যা। ফ্র্যাঞ্চাইজি মালিকদের প্রতিশ্রুতি ভঙ্গ করা শুরু থেকে বিপিএলের চরিত্রে মিশে আছে, যা এখনো ধরে রেখেছে রংপুর রাইডার্স।
এবারের বিপিএলে খেলা শুরুর আগ পর্যন্ত অন্তত কোনো সংকট তৈরি হয়নি। তবে বিভিন্ন ফ্র্যাঞ্চাইজির সঙ্গে বিসিবির কর্মকর্তাদের সম্পৃক্ততা স্বার্থের সংঘাত নিয়ে প্রশ্ন তুলছেই। পেশাগতভাবে ঢাকা ডায়নামাইটসের মালিকপক্ষের সঙ্গে সম্পৃক্ততা আছে স্বয়ং বিসিবি সভাপতি নাজমুল হাসানের। বিপিএল গভর্নিং কাউন্সিলের সদস্যসচিব ইসমাইল হায়দার মল্লিকের বেলায়ও তাই। নতুন আসা ফ্র্যাঞ্চাইজি খুলনা টাইটানসের মালিকপক্ষে আছেন আরেক বোর্ড পরিচালক কাজী ইনাম আহমেদ, বরিশাল বুলসের সঙ্গে আছেন আরেক বোর্ড পরিচালক এম এ আউয়াল চৌধুরী। জাতীয় নির্বাচকদেরও আবার ফ্র্যাঞ্চাইজিদের সঙ্গে কাজ করার সুযোগ দেওয়াটাও ‘চলো সবাই মিলে খাই’ মানসিকতারই প্রমাণ।
বিপিএল জাতীয় টুর্নামেন্ট অবশ্য এসব নিয়েই চলে। খেলাটা ক্রিকেট হলেও এখানে যে ক্রিকেটের বাইরেও অনেক কিছুই জড়িয়ে থাকে।