চট্টগ্রাম চ্যালেঞ্জার্সের সঙ্গে মেহেদী হাসান মিরাজের ‘ভুল–বোঝাবুঝি’ আভাস দেয় অনেক কিছুরই
চট্টগ্রাম চ্যালেঞ্জার্সের সঙ্গে মেহেদী হাসান মিরাজের ‘ভুল–বোঝাবুঝি’ আভাস দেয় অনেক কিছুরই

আড়চোখে

বিপিএলের আরেক নাম কি তবে ‘সন্দেহ’

মেহেদী হাসান মিরাজ যেদিন সকালে বললেন চট্টগ্রাম চ্যালেঞ্জার্সের হয়ে তিনি আর বিপিএল খেলবেন না এবং বিকেলেই মত বদলে জানালেন সব ছিল ‘ভুল-বোঝাবুঝি’, সেদিনের কথা।

চলমান বিতর্কে বিসিবির চিন্তাভাবনা জানতে ফোন করেছিলাম বিপিএল-সংশ্লিষ্ট এক বোর্ড কর্মকর্তাকে। সৌজন্য বিনিময়ের পর তাঁর সঙ্গে কথোপকথনের চুম্বক অংশটা ছিল এ রকম—

বোর্ড কর্মকর্তা: আচ্ছা, বলেন তো, বিপিএল বন্ধ করে দিলে কি খুব সমস্যা হবে? সবাই আমাদের বদনাম করবে!

—কেন, বিপিএল বন্ধের কথা আসছে কেন?

বোর্ড কর্মকর্তা: দেখেন না কত সমস্যা! প্লেয়ারদের নিয়ে সমস্যা, ফ্র্যাঞ্চাইজি নিয়ে সমস্যা। একটা ফ্র্যাঞ্চাইজিও ভালো পাওয়া যায় না। ফ্র্যাঞ্চাইজি নেওয়ার সময় সবার শুধু বড় বড় কথা। এই করব, ওই করব। তৃতীয় বিভাগের দলকে স্পনসর করব। মাঠ করব। দেশের ক্রিকেটের উন্নতি করব। এরপর আর কারও খবর থাকে না। প্লেয়াররাও নানা ঝামেলা করে। বিরক্ত হয়ে যাচ্ছি।

বিপিএলে মাঠ ও মাঠের বাইরে উত্তেজনার কমতি থাকে না

—মাথাব্যথা বলে মাথা কেটে ফেলে দেবেন? ব্যথা দূর করলেই তো হয়...

বোর্ড কর্মকর্তা: পারছি না তো! কেউ কমিটমেন্ট রাখে না। তারপরও তো আরও হাজারটা সমস্যা আছে।

—আর কী সমস্যা?

বোর্ড কর্মকর্তা: বোঝেন না, এ ধরনের টুর্নামেন্টে কত কী হয়। কয় দিকে চোখ রাখব, বলেন? পাহারা দিয়ে কি ক্রিকেট খেলা হয়!

—ফিক্সিংয়ের কথা বলছেন! এবারও হচ্ছে নাকি?

বোর্ড কর্মকর্তা: সে রকম কোনো কংক্রিট তথ্য এখনো নেই। কিন্তু কিছু ফ্র্যাঞ্চাইজির তো ঝামেলা আছে শুনছি। আমরা চাই বিপিএলটাকে এসব থেকে মুক্ত রাখতে। নইলে আইসিসি এমনিতেই টুর্নামেন্ট বন্ধ করে দিতে বলবে। এখন এসব ঘটতে থাকলে তো আপনারাও লিখবেন। এভাবে আরও বেশি জানাজানি হবে।

তাঁর কথাগুলো শুনে মনে পড়ছিল আগের রাতের আরেকটি কথোপকথনের কথা। গভীর রাত। মিরাজ বনাম ফ্র্যাঞ্চাইজির দ্বন্দ্বের প্রথম দিনের খবর তখন প্রেসে ছাপা হচ্ছে। বিপিএলে খেলছেন এমন এক তারকা ক্রিকেটারের কাছে কৌতূহলবশত মেসেঞ্জারে জানতে চাইলাম—

—কী হচ্ছে কিছু বুঝতে পারছেন?

ক্রিকেটার: কোন ব্যাপারে, ভাই?

বিপিএলে মাঠে এমন হৃদ্যতাও দেখা যায়

—এই যে মিরাজকে অধিনায়কত্ব থেকে এভাবে বাদ দিয়ে দিল! ও নাকি খেলবে না। চলে আসবে ঢাকায়…

ক্রিকেটার: সত্যি-মিথ্যা জানি না। তবে আমিও তা-ই শুনছি। আমি মনে করি ওর চলে যাওয়াই উচিত। তাহলে ঘটনার প্রতিবাদে একটা স্টেটমেন্ট দেওয়া হবে। অধিনায়ককে সরিয়ে তো এর আগেও বিপিএলে উল্টাপাল্টা কাজ হয়েছে।

—মিরাজের ব্যাপারটা এ রকম হলো কেন, আপনার কী ধারণা?

ক্রিকেটার: সরাসরি তো কিছু জানি না। তবে কিছু লোকের ব্যাপারে ভালো কিছু শুনিনি। মানে যা শুনি, তা সন্দেহজনক। ম্যাচে উল্টাপাল্টা করতে পারে। হয়তো সে জন্যই…।

—লোকগুলো কারা?

ক্রিকেটার: ভাই, প্রমাণ ছাড়া তো কারও নাম বলা ঠিক হবে না। তবে অনেকেই বলে তারা সন্দেহজনক। আগে যারা খেলছে, তারাও বলেছে, ওদের অভিজ্ঞতা ভালো না।

—তো এতই যখন সন্দেহ, ক্রিকেটাররা বোর্ড বা আকসুকে জানায় না কেন?

ক্রিকেটার: প্রমাণ নাই তো। সব সন্দেহ।

—একটা ফ্র্যাঞ্চাইজিই, না আরও কেউ আছে সন্দেহের তালিকায়?

ক্রিকেটার: আরেকটা দলের কিছু খেলোয়াড়ের কথা শুনেছি। ওরা নাকি একজোট হয়ে এসব করে।

—জাতীয় দলের খেলোয়াড়?

ক্রিকেটার: জাতীয় দলের আশপাশের বলতে পারেন। সুযোগ পায়, আবার পায় না, এমন। কিন্তু ভাই, আমাকে নাম জিজ্ঞেস করবেন না। আমি প্রমাণ ছাড়া কারও নাম বলতে পারব না। আপনি পারলে খোঁজ নিয়ে বের করেন।

চট্টগ্রাম চ্যালেঞ্জার্সের সঙ্গে ‘ভুল–বোঝাবুঝি’ অবসানের সংবাদ সম্মেলনে মেহেদী হাসান মিরাজ ও ফ্র্যাঞ্চাইজি কর্মকর্তা

—এ রকম কুইজ দিয়ে দিলে হবে? একটু তো ক্লু লাগে…

ক্রিকেটার: এর বেশি বলা ঠিক হবে না। তবে আমার অবাক লাগে। ওরা যদি সত্যি সত্যি এসবে জড়িয়ে পড়ে, তাহলে দেশের ক্রিকেটের ভবিষ্যৎ অন্ধকার। আর ওদের কি নিজের ক্যারিয়ারের জন্যও মায়া হয় না! এই বয়সে এসব করে ধরা পড়লে পুরো ক্যারিয়ার শেষ।

—আমাকে বলার দরকার নেই। তবে দেশের ক্রিকেটের স্বার্থে আপনাদের তো উচিত সন্দেহের কথা বোর্ডকে জানানো…

ক্রিকেটার: জানালে আমিই উল্টো খারাপ হয়ে যাব। কী দরকার…। বোর্ডের তো এসব ধরার লোক আছে। তারা ধরুক।

এসব ধরার লোক—ওহ্, তাই তো! এবার তো ছয় ফ্র্যাঞ্চাইজির সঙ্গেই ছয়জন আলাদা ইন্টিগ্রিটি অফিসার দিয়েছে বিসিবি। তাঁরা যাঁর যাঁর দলের ওপর সজাগ দৃষ্টি রাখছেন। যেই না সন্দেহজনক কিছু চোখে পড়বে, সঙ্গে সঙ্গে জানিয়ে দেবেন বিসিবির দুর্নীতি দমন প্রধানকে।

কিন্তু সমস্যা হলো, এই ইন্টিগ্রিটি অফিসাররা বিসিবির লোক হলেও তাঁদের টিম হোটেলে রাখা, খাওয়ানো, যাতায়াত—সব খরচই দিচ্ছে যাঁর যাঁর ফ্র্যাঞ্চাইজি। খরচ বাঁচাতেই নাকি ৯০০ কোটি টাকা এফডিআরের মালিক বিসিবির এমন অভিনব বুদ্ধি। তাতে ‘চোরে’-‘চৌকিদারে’ মাসতুতো ভাই হয়ে গেলেও কারও বয়েই গেছে। সবাই বড়জোর সন্দেহই করবে, প্রমাণ তো আর কিছু নেই!

বিপিএল ঘিরে আশায় থাকেন ক্রিকেটাররা

মিরাজের প্রসঙ্গ দিয়েই শেষ করা যাক। দুই দিন ধরে অনেক নাটকের পর মিরাজ আর চট্টগ্রাম চ্যালেঞ্জার্স কর্তৃপক্ষ যৌথ ঘোষণা দিয়েছে—সবই নাকি ছিল ‘ভুল-বোঝাবুঝি’। তবে মিরাজ তো সংবাদমাধ্যমে বলেছিলেন, অমুক ‘কালপ্রিট’! ওই লোক দলের সঙ্গে থাকলে তিনি আর খেলবেনই না! মিরাজ এ-ও বলেছিলেন, তাঁকে অধিনায়ক রাখলে ‘অন্য কিছু’ করা কঠিন বলেই নাকি নেতৃত্ব থেকে সরানো হয়েছে। এসবও কি সন্দেহের বশেই বলেছিলেন তিনি!

বিপিএলের মধ্যে যাঁদের বসবাস, টুর্নামেন্টটাকে ঘিরে তাঁদের মনেই দেখা যাচ্ছে সন্দেহটা বেশি। অবশ্য সন্দেহের পারদে ওঠানামা না থাকলে সেটা আবার বিপিএল নাকি!