করোনাভাইরাসের সময় আম্পায়ারের কাছে বোলার-ফিল্ডাররা ক্যাপ দিতে পারবেন না, এমন একটা নিয়ম চালু করেছিল আইসিসি। সে সময় মুমিনুল হকের একটা ছবি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়েছিল বেশ। গত বছর পাল্লেকেলেতে মুমিনুলের মাথায় একসঙ্গে ছিল তিনটি হ্যাট। ওই টেস্টে মুমিনুল পেয়েছিলেন এখন পর্যন্ত তাঁর সর্বশেষ শতক, যেটি দেশের বাইরে তাঁর প্রথম শতকও ছিল।
একসঙ্গে তিনটি হ্যাটের ‘চাপ’ মুমিনুল নিতে পেরেছিলেন। তবে ক্রমাগত ব্যাটিং-ব্যর্থতার চাপটা যেন নিতে পারলেন না আর। ‘সবকিছু ঠিকঠাক’ থাকলে এ টেস্টে বাংলাদেশকে নেতৃত্ব দেওয়ার কথা ছিল মুমিনুলের। দেশের মাটিতে শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে সিরিজ চলার সময়ই যখন ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিপক্ষে সিরিজের দল ঘোষণা করল বিসিবি, অধিনায়ক ছিলেন মুমিনুলই। তবে এরপরই বদলে গেল সব। ফাস্ট-ফরোয়ার্ড করে সেন্ট লুসিয়ায় ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিপক্ষে সিরিজের দ্বিতীয় টেস্ট বাংলাদেশ দল থেকেই বাদ পড়ে গেছেন মুমিনুল।
এ বাদ পড়াটা যে খুব একটা বিস্ময়ের, সেটি বলা যাবে না মোটেও। মুমিনুলের ব্যাটিংয়ের ‘সবকিছু ঠিকঠাক’ দূরের কথা, সাম্প্রতিক সময়ে যে ‘কিছুই ঠিক নেই’ ধরনের অবস্থা! সর্বশেষ ১০ ইনিংসে দুই অঙ্ক ছুঁতে পারেননি, যার মধ্যে শূন্যতেই ফেরার ঘটনা আছে চারবার। মাউন্ট মঙ্গানুইয়ে নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে ৮৮ রানের ইনিংসে বছর শুরু করেছিলেন ওই সময়ের অধিনায়ক মুমিনুল। দল হিসেবে এ বছরে বাংলাদেশ এরপর পথ হারিয়েছে, নিজেকে খুঁজে ফিরছেন মুমিনুলও!
এমনিতে বাংলাদেশের ইতিহাসের সেরা যদি না-ও হন, অন্যতম সেরা টেস্ট ব্যাটসম্যান মুমিনুল। ২০১৩ সালে অভিষেকের পর থেকে সেন্ট লুসিয়া টেস্টের আগে মুমিনুল মিস করেছেন বাংলাদেশের মাত্র ৪টি টেস্ট—২০১৩ সালে জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে হারারে টেস্টের পর ২০১৭ সালে নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে ক্রাইস্টচার্চ, ওই বছরই শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে কলম্বোর পর দেশের মাটিতে অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে মিরপুরে।
২০১৭ সালটা মুমিনুলের জন্য ছিল ঘটনাবহুলই। শ্রীলঙ্কা সফরে গলে দুই ইনিংসে ৭ ও ৫ রানের পর কলম্বোয় বাদ দেওয়া হয়েছিল মুমিনুলকে। তখনকার প্রধান কোচ চন্ডিকা হাথুরুসিংহে বলেছিলেন, অফ স্পিনে সমস্যা আছে মুমিনুলের। ওই টেস্টের দুই ইনিংসেই দিলরুয়ান পেরেরার বলে আউট হয়েছিলেন মুমিনুল।
এরপর দেশের মাটিতে অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে সিরিজেও শুরুতে দলে রাখা হয়নি তাঁকে। সে সময় কেন মুমিনুল বাদ পড়লেন, সেটি ঠিক পরিষ্কার ছিল না। তবে এরপর নাটকীয়ভাবে দলে ফেরানো হয় মুমিনুলকে, সিরিজের প্রথম টেস্টে না খেললেও চট্টগ্রামে খেলেন দ্বিতীয় টেস্ট। পরের বছর বাংলাদেশ সফরে এসেছিল শ্রীলঙ্কা, যে দলের কোচ হয়ে এসেছিলেন হাথুরুসিংহে। চট্টগ্রামে তাদের বিপক্ষে জোড়া শতক করে একরকম জবাবই দিয়েছিলেন মুমিনুল!
এবারের বাস্তবতা অবশ্য একেবারেই ভিন্ন। ২০১৯ সালে সাকিব আল হাসানের নিষেধাজ্ঞার পর হুট করে পাওয়া অধিনায়কত্ব তাঁর ওপর চাপ ফেলছে, এমন কারণ দেখিয়ে নিজে থেকেই এ সফরের আগে সরে দাঁড়ান। অ্যান্টিগায় অধিনায়কত্বের ভারমুক্ত মুমিনুলের নতুন শুরু হবে, সে আশাও পূর্ণ হয়নি।
অফ স্পিন বা শর্ট বলে সমস্যা—অতীতে মুমিনুলকে নিয়ে এমন কথা উঠলেও এবার তাঁর সমস্যা ঠিক একমুখী নয়। গত বছর শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে ওই শতকের পর জিম্বাবুয়ে সফরেও একটা ফিফটি ছিল। মাঝে দেশের মাটিতে পাকিস্তানের বিপক্ষে সিরিজটা সুবিধার না গেলেও নিউজিল্যান্ড সফরে মাউন্ট মঙ্গানুইয়ের ওই গুরুত্বপূর্ণ ইনিংসে নিজেকে ফিরে পাওয়ার ইঙ্গিত দিয়েছিলেন। তবে এরপরই নিজেকে যেন হারিয়ে ফেললেন টেস্টে ১১টি শতক করা মুমিনুল।
অ্যান্টিগায় প্রথম ইনিংসে জেইডেন সিলসের অফ স্টাম্পের বাইরের বল তাড়া করতে গিয়ে স্লিপে ক্যাচ দেন কোনো রান না করেই, দ্বিতীয় ইনিংসে কাইল মায়ার্সের বলে এলবিডব্লু হন সময়মতো ব্যাট নিয়ে যেতে না পেরে। মুমিনুলের বিরতি প্রয়োজন কি না, এমন প্রশ্নের জবাবে ওই টেস্টের পর সাকিব বলেছিলেন, মুমিনুল চাইলে সেটি ‘হতে পারে’।
শেষ পর্যন্ত হলো সেটিই। তবে এরপর মুমিনুলের সামনে কী, সে প্রশ্নটা আসছে এখন তাই। এমনিতে জাতীয় দলের হয়ে সীমিত ওভারে মুমিনুল খেলেন না, বলতে গেলে বাংলাদেশের প্রথম ‘বিশেষজ্ঞ টেস্ট ব্যাটসম্যান’ও তিনি। ফলে অন্যদের তুলনায় ঘরোয়া প্রথম শ্রেণিতে খেলার সুযোগ বেশিই পান তিনি, সর্বশেষ জাতীয় লিগেও খেলেছিলেন গত বছর। তবে ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিপক্ষে এ সিরিজের পর বাংলাদেশ আবার টেস্ট খেলবে বছরের শেষে, ভারতের বিপক্ষে।
সামনে তাই একটা অনিশ্চিত সময়ই অপেক্ষা করছে বাংলাদেশ ক্রিকেটের অন্যতম সেরা ব্যাটসম্যানের জন্য। অবশ্য মুমিনুলের বদলে এ টেস্টে যিনি দলে এলেন, সেই এনামুল হক প্রেরণা হতে পারেন। অন্তত ঘরোয়া ক্রিকেটে যেকোনো সংস্করণে রান পেলেই জাতীয় দলের দরজা আবার খুলবে তাঁর জন্য, সে ভরসা তিনি পেতেই পারেন।
আপাতত মুমিনুলের সামনে অনিশ্চিত, হয়তো এক নিঃসঙ্গ লড়াই-ই অপেক্ষা করছে। তবে সে লড়াই পেরিয়ে, সবকিছু ঝেড়ে ফেলে নতুন এক মুমিনুল ফিরবেন, আপাতত এমন আশা করা ছাড়া উপায় নেই আর।