তাঁর দল হেরেছে, তা-ও জয়ের মতো অবস্থা থেকে রুদ্ধশ্বাস পরিস্থিতিতে গিয়ে। ১ রানের জন্য বিপিএল শিরোপার খুব কাছে গিয়েও খালি হাতে ফেরার কষ্ট ফরচুন বরিশালের কোচ খালেদ মাহমুদের এমনিতেই হওয়ার কথা। কষ্টটা আরও বেড়ে যাচ্ছে, কারণ এ নিয়ে টানা চারবার বিপিএলে নিজের দলকে রানার্সআপই হতে দেখলেন তিনি। সংবাদ সম্মেলনে এ নিয়ে প্রশ্নে তো স্বীকারও করে নিলেন, ‘রানার্সআপের ধারাবাহিকতা বেশি হয়ে যাচ্ছে। আমি রানার্সআপ কোচ হয়ে যাচ্ছি!’
তবে হারের বিশ্লেষণে কাল বাংলাদেশের ক্রিকেটারদের একটা দুর্বলতার কথাও নতুন করে সামনে তুলে এনেছেন বাংলাদেশ জাতীয় দলের ‘টিম ডিরেক্টর’ মাহমুদ। কালকের ফাইনালে হারের পর তাঁর কথা, কালকের ফাইনাল এবং এবারের বিপিএল বুঝিয়ে দিয়েছে, খেলায় কখন, কীভাবে পরিস্থিতি বুঝে খেলতে হবে, সেই ‘গেম সেন্সে’ বাংলাদেশের ক্রিকেটারদের বড় ঘাটতি থেকেই যাচ্ছে!
মিরপুরে কাল ফাইনালে আগে ব্যাটিংয়ে নেমে দারুণ শুরু করা কুমিল্লা ভিক্টোরিয়ানসকে শেষ পর্যন্ত ১৫১ রানে আটকে দেয় বরিশাল। জবাবে নিজেরা দারুণ শুরু করেও শেষে পথ হারায়। এভাবে শেষ দিকে গড়বড় করে ফেলাই মানতে পারছেন না খালেদ মাহমুদ।
‘২ উইকেটে ১০০-র বেশি রান...ওখান থেকে তো ম্যাচ হারার কোনো কারণই আমি দেখি না। আমাদের ব্যাটিংটা আমরা ভালো দেখাতে পারিনি। শেষ দিকটা ভালো হয়নি। আমরা প্যানিক করেছি। আপনি যদি শেষের দিকে গিয়ে ৬ রানরেট তাড়া করতে না পারেন, তাহলে এটা তো খুবই জঘন্য ব্যাপার’ - বলেছেন মাহমুদ।
দলে অভিজ্ঞতার অভাবে এমনটা হয়েছে কি না, সে প্রশ্নেও উল্টো যেন বিরক্তই হলেন মাহমুদ। যদিও অনুভূতির প্রকাশে বিরক্ত (পিসড অফ) বলতে গিয়ে পরে হতাশ বলেই চালিয়েছেন, ‘অনভিজ্ঞ কীভাবে বলেন ওদের? সবাই তো আন্তর্জাতিক ক্রিকেটার। সোহান (নুরুল হাসান), শান্ত (নাজমুল হোসেন), তৌহিদ হৃদয়...ও হয়তো তরুণ, কিন্তু তারপরও সে-ও তো পেশাদার ক্রিকেট খেলছে অনেক দিন ধরে। ডোয়াইন ব্রাভো, মুজিব...সবাই-ই তো অভিজ্ঞ খেলোয়াড়। ওদের মাথায় কী চলছিল আমি জানি না। আমরা শেষ দুই ওভারে একটা বাউন্ডারিও মারতে পারিনি। আপনাকে খেলাটা শেষ করতে জানতে হবে। আমি সত্যি বলতে, অনেক বিরক্ত...হতাশ। আমি তেমন উন্নতি তো দেখছি না ছেলেদের। আমি জানি ওরা মানসম্পন্ন খেলোয়াড়, কিন্তু মাঠে সেটা প্রমাণ করতে না পারলে আর কী প্রমাণ করল!’
শেষ চার ওভারে কোচের দিক থেকে তাহলে কী নির্দেশনা গিয়েছিল মাঠে, সে নিয়ে প্রশ্নেই বাংলাদেশের খেলোয়াড়দের চিন্তাভাবনায় পরিপক্বতার অভাবের কথা প্রথমে কিছুটা বললেন মাহমুদ, ‘কোচ বাইরে থেকে হাজারো কথা বলেন, আপনাকেও তো বুঝতে হবে পরিস্থিতিটা কী। কোন বোলারকে মারতে হবে, সেটা বুঝতে হবে। আমাদের ওই সময় হিসাব ছিল যে মঈন আলী এক ওভার বল করেনি, শহিদুলকে এক ওভার করতেই হবে, মোস্তাফিজ আর নারাইনের একটি করে ওভার বাকি ছিল। মঈন আলী না করাতে শহিদুল দুই ওভার করেছে। আমার কথা ছিল যে যেহেতু মোস্তাফিজ আর নারাইন উইকেট নেওয়ার মতো বোলার, ওদের ওভারগুলোতে ৬ করে বা ৭ করে নেওয়ার চেষ্টা করতে হবে। সে ক্ষেত্রে বাকি দুই ওভারে ১২ বলে ১৫ রানের মতো দরকার হতো। এখন এই হিসাব তো আমি বলে দেওয়ার মতো কিছু নয়! আমি বলে এসেছি ঠিকই, কিন্তু এই পর্যায়ে এসে তো এটা খেলোয়াড়কেই বোঝা উচিত।’
এরপর গেইলকে নিয়ে প্রশ্নের উত্তরেও আবার এল বাংলাদেশের স্থানীয় ক্রিকেটারদের কথা। গেইলকে কেনাটা বরিশালের জন্য বুমেরাং হয়েছে কি না, সে প্রশ্নে গেইলকে ঠিক ব্যর্থ বলেননি মাহমুদ। গতকাল ফাইনালেও গেইলের ৩১ বলে ৩৩ রানের ইনিংস আরও লম্বা না হওয়ার হতাশা থাকলেও সেটিকে তেমন গা করেননি।
কিন্তু উত্তরের শেষে আবার টেনে আনলেন বাংলাদেশের ক্রিকেটারদের দক্ষতার প্রসঙ্গ, ‘আমাদের ছেলেদের এটাই শিখতে হবে, কোন বোলারকে আপনি মারবেন, কাকে মারবেন না। আমরা সব সময় বলি বাংলাদেশের ক্রিকেটারদের গেম সেন্সের কথা। আজকের ম্যাচ দেখলেই বোঝা যাবে আমাদের গেম সেন্সের কতটা অভাব আছে।’
বাংলাদেশের খেলোয়াড়েরা শিখলেও সেটির গতি অনেক কম মনে হচ্ছে খালেদ মাহমুদের। বলে বলে ঝাঁপানো, একটা রান বা বাউন্ডারি বাঁচানো, ওয়াইড কম দেওয়ার মতো ছোট ছোট কাজও যে টি-টোয়েন্টিতে শেষ পর্যন্ত জয়-হারের ব্যবধান গড়ে দিতে পারে, সে আপ্তবাক্য তো উদাহরণ হয়ে কাল ফাইনালেও দাঁড়িয়ে গেল। শেষ পর্যন্ত ১ রানের ব্যবধানেই হলো বিপিএলের শিরোপার নিষ্পত্তি।
সেটিকে উদাহরণ টেনে মাহমুদ বলেন, ‘এই দিকগুলো আমাদের ছেলেদের শিখতে হবে এবং খুব তাড়াতাড়ি। ওরা অনেক খেলেছে, অনেকগুলো বিপিএল হলো, ওরা শিখছে, কিন্তু শেখাটার গতি বাড়াতে হবে। আপনি যদি চোখ বন্ধ করেন, এ রকম অনেক ভুল আপনার কল্পনায় আসবে।’
তিনি জাতীয় দলের গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্বে, ঘরোয়া ক্রিকেটেও নিয়মিত কাজ করে যাচ্ছেন ক্রিকেটারদের নিয়ে। সে কারণেই কিনা স্থানীয় খেলোয়াড়দের পারফরম্যান্স নিয়েই যত মাথাব্যথা খালেদ মাহমুদের। সেটি স্বীকারও করে নিয়েছেন, ‘দেখেন, বিদেশি ক্রিকেটাররা কী করল, গেইল কী করল, ব্রাভো কী করল, এটা গুরুত্বপূর্ণ নয়। গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে আমাদের ক্রিকেটাররা কী করল। ম্যাচ উইনার কজন বের হলো।’
এবার বিপিএলেও যে স্থানীয় খেলোয়াড় তেমন উঠে আসতে পারেননি, সেটির ব্যাখ্যায় উদাহরণ হিসেবে টেনে এনেছেন বরিশালকেই, ‘আপনি যদি বরিশালে দেখেন (স্থানীয় খেলোয়াড়দের মধ্যে), ওই অর্থে সাকিব ছাড়া কিন্তু কেউ জ্বলে উঠতে পারেনি। সাকিব তো জাতীয় দলেই আছে। আমরা চাচ্ছিলাম জুনিয়র কেউ উঠে আসুক। মুনিম কিছুটা করেছে, আজ (কাল) সৈকত করেছে...এটাই আমার কাছে ভালো লাগার যে তরুণেরা রান করছে। শফিকুল-রানা শেষ কোয়ালিফায়ারে শুরুতে দারুণ বোলিং করেছে। এটা আমাকে খুশি করে, কিন্তু আমি চাই এ রকম পারফরম্যান্স আরও ধারাবাহিকভাবে হোক। সাকিবের মতো ধারাবাহিক হোক, তামিমের মতো ধারাবাহিক ব্যাটিং করুক। অভিজ্ঞতার কথা বলেন, হয়তো বলবেন বয়স তো আছে, কিন্তু বয়সের সঙ্গে শিখতেও তো হবে তাড়াতাড়ি। না হলে কয়েক বছর পর আমাদের হয়তো ভালো খেলোয়াড় খুঁজে পাওয়া দায় হয়ে যাবে।’