বিসিবির বার্ষিক সাধারণ সভা একবার হয়েছিল চীন মৈত্রী সম্মেলন কেন্দ্রে। সভার মাঝখানে হইচই করতে করতে বের হয়ে এলেন মধ্যম সারির এক কর্মকর্তা। তাঁর হইচইয়ের মধ্যে ছিল মাত্রই বিশ্বজয় করে আসার ভাব।
উত্তেজনায় এসি হলরুম থেকে বেরিয়েই তিনি সিগারেট ধরিয়ে ফেললেন। সভার মধ্য থেকে হঠাৎ বেরিয়ে আসা বিসিবির সেই কাউন্সিলর তাঁর দিকে আমাদের, মানে সাংবাদিকদের চুম্বকের মতো টানলেন। কী হয়েছে, কী হয়েছে? জবাবে যা বলে তিনি উপস্থিত সবার বাহ্বা কুড়ালেন, সবার সামনে ‘বীর’ হলেন, তার সারমর্ম হলো, এইমাত্র তিনি ক্রিকেট বোর্ডের এক ডাকসাইটে কর্মকর্তাকে আচ্ছা করে কিছু কথা শুনিয়ে দিয়ে এসেছেন। খারাপকে খারাপ বলায় কোনো ছাড় দেননি।
স্যুটেড–বুটেড ওই কর্মকর্তা নাকি তাঁর সব কথা মুখ বুজে শুনে গেছেন। ‘টু’ শব্দটিও করতে পারেননি। করবেন কী! তাঁকে যেসব বলে এসে কাউন্সিলর সাহেব ভেতরের উত্তেজনাটা সিগারেটের ধোঁয়ার কুণ্ডলীতে বের করে দিচ্ছিলেন, সবই নাকি ছিল সত্যি।
বিসিবির বার্ষিক সাধারণ সভার ইতিহাসে এমন আরও অনেক ঘটনাই ঘটেছে, যেগুলো থেকে তখন মনে হতো বাংলাদেশের ক্রিকেট একটা ভারসাম্যপূর্ণ অবস্থায় আছে। শুধু বার্ষিক সভায়ই নয়, ক্রিকেটে যেকোনো অনিয়ম-অন্যায় হলে একটা সময় বাইরে থেকে সেসব নিয়ে বলার ও প্রতিবাদ করার লোক ছিল। ক্ষমতায় থাকা ব্যক্তিরা যা–ই করতেন, তাঁদের এই প্রতিবাদী পক্ষটার কথা মাথায় রাখতে হতো। বোর্ড কর্মকর্তারা জানতেন, তাঁদের কাজ পর্যবেক্ষণ করা হচ্ছে। বেশি উল্টাপাল্টা করলেই হইচই বেঁধে যাবে, নির্বাচনের হিসাব পাল্টে যাবে।
তবে এমনও নয় যে বাইরে থাকা লোকেরা সবাই সব সময় সত্যবাদী যুধিষ্ঠির ছিলেন। ওই কাউন্সিলরের কথাই ধরুন। পরে তিনিও লাভের গুড় খেয়েছেন। আসলে ক্ষমতার বাইরের এসব মানুষের অনেকেরও সমস্যা থাকে এবং সেসব তাঁরা ক্ষমতার বলয়ে প্রবেশ করলে আরও প্রকটভাবে প্রকাশিত হয়। বিরোধী দলে থেকে রাজপথ গরম করাদের ক্ষমতায় গিয়ে একই জিনিস করার মতো আর কি!
তবে আপনি যেমনই হোন, ক্ষমতার বাইরে থাকার একটা সুবিধা আছে। নিজে পারি না পারি, ক্ষমতাসীনদের ভুল-ত্রুটি নিয়ে প্রশ্ন তো তোলা যায়। সমালোচনা করা যায়। তাতে লাভবান হয় তৃতীয় পক্ষ, মানে যাঁরা নীরব দর্শক, তাঁরা। তাঁদের সামনে তখন পরিস্থিতির বাস্তব চিত্রটা ফুটে ওঠে। ক্রিকেট সংগঠকদের মতভেদের ফাঁক গলেও একটা সময় বেরিয়ে আসত দেশের ক্রিকেটের আসল সত্যটা। ‘ডিভাইড অ্যান্ড রুল’ তখন শাসকদের নয়, সাধারণের কাজে লাগত। যদিও ‘ডিভাইডেশন’টা হতো ক্ষমতায় থাকা এবং ক্ষমতায় যেতে চাওয়া ব্যক্তিদের স্বার্থের দ্বন্দ্বে। সাধারণের তাতে কোনো ভূমিকা থাকত না।
বাংলাদেশের ক্রিকেট সংগঠকদের মধ্যে মতভেদ এখনো আছে। কিন্তু সেই মতভেদ এ দেশের ত্রিকেটের কোনো কাজে আসছে না। কারণ, বিভেদের ফাঁক গলে এখন আর কিছুই বের হচ্ছে না। ক্ষমতাসীন ব্যক্তিদের আচরণে দ্বিমত পোষণকারী লোকেরা তাঁদের মতটা মনের মধ্যেই পুষে রাখছেন, বাইরে আনছেন না। কেউ ভয়ে, কেউ লাভের গুড় খেয়ে সত্যি বলা ভুলে গিয়ে এবং কেউ–বা ভবিষ্যতে কিছু পাওয়ার আশায় ‘উটপাখি’ হয়ে যাওয়ায়।
আমি তো বলি, বাংলাদেশের ক্রিকেটের সবচেয়ে বড় দুর্ভাগ্য, এখানে ‘বিবেক’ হওয়ার মতো কোনো চরিত্র নেই। ক্রিকেটের ক্রান্তিকালে স্বর উঁচু করার লোক নেই। সব দেশে এসব ‘বিবেক’ চরিত্র সাধারণত ক্রিকেটের ভেতর থেকেই আসে। সংগঠক নয়তো সাবেক ক্রিকেটার। সংবাদমাধ্যম তো বটেই। দেশের ক্রিকেটে কিছু উল্টাপাল্টা হতে দেখলেই তাঁরা সরব হয়ে ওঠেন, প্রতিবাদী হন। বলতে থাকেন, এটা ঠিক হচ্ছে না, ওটা অন্যায়...। আমাদের ক্রিকেটেও একসময় এ ধরনের চরিত্র ছিল, কিন্তু সেসব চরিত্র এখন হারিয়ে গেছে।
এটাকে ক্রিকেট প্রশাসনের একটা কৌশলগত ‘সাফল্য’ও ধরে নিতে পারেন। সচেতনে হোক বা অবচেতনেই হোক, তারা ক্রিকেটের ‘বিবেক’ হয়ে ওঠার মতো বড় একটা অংশের মুখ বন্ধ রাখতে পারছেন।
অন্যদের কথা বাদ দিন, এ দেশের সাবেক অধিনায়কদের তালিকা করলেই দেখবেন, তাঁদের অধিকাংশ বর্তমান বোর্ডের সঙ্গে কোনো না কোনোভাবে সম্পৃক্ত। তিন সাবেক অধিনায়ক তো বোর্ড পরিচালকই। তাঁরা স্বাভাবিকভাবেই বোর্ডের প্রতিপক্ষ হবেন না। সাবেক দুই অধিনায়ক আছেন নির্বাচক হিসেবে, একজন শীর্ষ ম্যাচ রেফারির পদে। বোর্ডের চাকুরে হয়ে বোর্ডের বিপক্ষে যাওয়ার সাহস তাদের স্বাভাবিকভাবেই থাকবে না। বাকি যাঁরা আছেন, তাঁরা আগে সরব থাকলেও যেকোনো সমীকরণের কারণেই হোক, এখন নীরব।
কিছু সাবেক অধিনায়ক তো এখনো খেলছেন। অধিনায়কদের বাইরে অন্য অনেক সাবেক খেলোয়াড়ও নানাভাবে ক্রিকেট বোর্ডের পরিচয়ে পরিচিত। কেউ কোচ, কেউ কর্মকর্তা, কেউ অন্য কিছু। তাহলে আর কথা বলার থাকলেন কে! দুই-একজন যাঁরা থাকলেন, তাঁরা ভাবেন রথী-মহারথীরাই যখন চুপ, আমরা কোন দুঃখে কথা বলে ভবিষ্যৎ নষ্ট করতে যাব! সুযোগ তো আমাদেরও আসতে পারে!
সংগঠককুলও হার মেনে নিয়েছে। আগে দুই-চারজন যা–ও পরিস্থিতিভেদে সরব হতেন, এখন নানা রাজনৈতিক সমীকরণ তাঁদের ক্রিকেট নিয়ে কথা বলতে নিরুৎসাহিত করে। যেটি বলেন, সেটি সাংবাদিকদের কানে কানে, ‘অফ দ্য রেকর্ড’। ব্যাপারটা যেন এমন, যা করার সংবাদমাধ্যমই করুক।
নইলে রাজধানীর একটি পাঁচ তারকা হোটেলে চার বছর পর কাল বিসিবির যে বার্ষিক সভাটি হয়ে গেল, সেটি এত নিরুত্তাপ হওয়ার কথা ছিল না। এই চার বছরে বাংলাদেশের ক্রিকেটে এমন কিছুই কি ঘটেনি যার প্রসঙ্গ ধরে সাধারণ পরিষদে গঠনমূলক তর্ক-বিতর্ক হতে পারত? হয়নি কারণ, বাংলাদেশের ক্রিকেটে এখন একটাই ভাষা, তার নাম ‘ভালোবাসা’। মনের ভেতর যা–ই থাকুক, ওপরে ওপরে সবাই সবাইকে ভালোবাসেন। ভালোবাসার প্রতিদানও পান। বাসায় উপহারের ল্যাপটপ চলে যায়। পকেট ভারী হয়। আর ভালোবাসার মানুষকে তো কটু কথা বলতেও নেই!
সব কটু কথা বলার দায় তাই সংবাদমাধ্যমের। কিন্তু সংবাদমাধ্যম কোনো বিষয়ে তখনই জোরালোভাবে সরব হতে পারে, দিনের পর দিন লেগে থাকতে পারে, যখন ক্রিকেটাঙ্গনের লোকেরা সমস্যাটা তুলে ধরেন। সংবাদমাধ্যম নিজেরাই বারবার একই কথা বলতে থাকলে সেটি গুরুত্ব হারায়। সেটিকে নানান দিকে প্রবাহিত করা যায়। নেতিবাচক সাংবাদিকতার দায় নিতে হয়। তাতে একসময় সংবাদমাধ্যমও উদ্যম হারিয়ে ফেলে। সময়ের সঙ্গে তাল মেলাতে অন্য কিছু নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়ে।
কিন্তু তারা যদি ক্রিকেটের ভেতরের লোকেদের মুখ দিয়ে সমস্যার কথাগুলো তুলে আনতে পারতেন, সেটি তখন ‘লাউড স্পিকারে’র মতো জোরালোভাবে শোনাত। বিশ্বজুড়ে সাংবাদিকতায় বিশেষজ্ঞ মতামত এ কারণেই গুরুত্বপূর্ণ।
বাংলাদেশের ক্রিকেট যেন সেই জোরটাই হারিয়ে ফেলেছে! এখানে বিশেষজ্ঞ মতামত পাওয়া যায় শুধু খেলা নিয়ে, খেলার সঙ্গে মিশে থাকা ‘ধুলা’ নিয়ে নয়। তামিম কেন ভুল শট খেলে আউট হলেন, সাকিব কেন মাঠে অসদাচরণ করলেন, ফেসবুক থেকে টিভি পর্দায় এসব নিয়ে বলার লোকের অভাব নেই। কারণ যুগে যুগে ‘বর্তমান ক্রিকেটাররাই’ এ দেশে সবচেয়ে বেশি অসহায়। তাঁদের পাল্টা জবাব দেওয়ার সুযোগ নেই। দিলেন তো তিনি হয়ে গেলেন ক্রিকেটের ‘ব্যাড বয়’।
মুশফিক-মাহমুদউল্লাহরা কেন বিরুদ্ধ পরিস্থিতিতে লড়াই করে ম্যাচ জেতাতে পারেন না, তা নিয়ে সাবেক ক্রিকেটার, সংগঠকেরা সমালোচনামুখর হন। কিন্তু মাঠের বাইরে তাদেরও যখন সময় আসে বিরুদ্ধ পরিস্থিতিতে দেশের ক্রিকেটের স্বার্থে কথা বলার, তারা কি তা বলছেন?
খেলা নিয়ে সমালোচনা করা যাবে না, তা নয়। তবে ‘ধুলা’ নিয়েও তো বলতে হবে। অবশ্য সেটা যে কেউ আর বলছেন না, তার কারণ হতে পারে, এ দেশের ক্রিকেটে হয়তো কোনো সমস্যাই নেই। ঘরোয়া ক্রিকেট নিয়ে বিতর্ক নেই, পক্ষপাত নেই, আর্থিক অনিয়ম নেই, ক্রিকেট ব্যবস্থাপনা সুসংহত, সবকিছুতে সঠিক প্রক্রিয়া চলমান। প্রতিবাদ বা সমালোচনা করার কোনো জায়গাই নেই।
সে জন্য সবাই চুপ এবং সবাই চাচ্ছেন, এই সাফল্যমণ্ডিত সময়ে কোনো না কোনোভাবে নিজের নামটা বাংলাদেশের ক্রিকেটে ভাসিয়ে রাখতে। সম্ভাব্য ক্রিকেট বিবেকদের মৌনব্রত অবলম্বনের সেটিই কারণ হলে এ দেশের ক্রিকেট–সংশ্লিষ্ট সবাইকে প্রাণঢালা অভিনন্দন।
ও হ্যাঁ, তাহলে এই লেখা কেন? পরিস্থিতি সেরকমই হলে ধরে নিন, এটা বাংলাদেশের ক্রিকেট নিয়ে কোনো লেখা নয়। এটা মঙ্গল গ্রহের ক্রিকেট নিয়ে লেখা।