>২০১৫ সালকে বাংলাদেশের সেরা সাফল্যের বছর ধরা হয়। সেবার ঘরের মাঠে একের পর এক সিরিজ জিতেছে বাংলাদেশ। জিম্বাবুয়ে, পাকিস্তান, ভারত, দক্ষিণ আফ্রিকা...একটুর জন্য বেঁচে গেছে ইংল্যান্ড। সে সোনালি সাফল্যে মোড়ানো বছর আবার নিশ্চয়ই আসবে। সেই আসার আশা দিয়ে রাখল ২০১৮
মেহেদী মিরাজ তখন তাঁর মতো করেই বলছেন। কী অদ্ভুত সারল্য! বাংলাদেশ যে লেগে ৬ ফিল্ডার রেখে ভুল করেছে, সেটাও অকপটে স্বীকার করে নিলেন সংবাদ সম্মেলনে ম্যাচ সেরা হয়ে আসা মিরাজ। তারপর যখন বললেন, ভুল তো মানুষেরই হয়; বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় তারকাদ্যুতির বৃত্তে ঢুকে পড়া মিরাজকেও তখন দূর আকাশের তারা মনে হয় না। মনে হয়, মাটির কাছাকাছি থাকা একজন। মিরাজের পাশের আসনেই মাশরাফি। ক্যাপটি হালকা নামিয়ে নিয়ে, আলোর ঝলকানি থেকে চোখজোড়াকে বাঁচিয়ে যেন সিয়েস্তা নিচ্ছেন। বছর তো শেষ হলো, এবার একটু জিরিয়ে নিই! মাশরাফিকেও তখন আর কেবল অধিনায়ক মনে হচ্ছে না, মনে হচ্ছে পরিবারের কর্তা।
বাংলাদেশের খেলা এ বছর আরও তিনটি আছে। তবে ওয়ানডে অধিনায়কের খেলা শেষ। বাংলাদেশের এ বছরের ওয়ানডে সূচি যে ফুরিয়ে গেল। এশিয়া কাপে আরও একবার শেষ ওভারের হতাশা আছে। আছে বছরের শুরুতেই তৃতীয় সিরিজ জেতার সুযোগটা নষ্ট করে ফেলার অপ্রাপ্তি। বাংলাদেশ যে এখনো দ্বিপক্ষীয় সিরিজের বাইরে কোনো টুর্নামেন্ট জেতেনি! প্রাপ্তির যোগ থেকে অপ্রাপ্তির বিয়োগ বাদ দিয়েও ফলাফলে গোল্ডেন না হোক, এ প্লাস তো দেওয়াই যায়!
২০১৫ সালের পর আবারও এ বছর ১৩টি ওয়ানডে জিতল বাংলাদেশ। ২০০৬ সালে ১৮টি আর ২০০৯ সালে ১৪টি ওয়ানডে জিতলেও ২০১৫কে বাংলাদেশের সেরা সাফল্যের বছর ধরা হয়। সেবার ঘরের মাঠে একের পর এক সিরিজ জিতেছে বাংলাদেশ। জিম্বাবুয়ে, পাকিস্তান, ভারত, দক্ষিণ আফ্রিকা...একটুর জন্য বেঁচে গেছে ইংল্যান্ড। সে সোনালি সাফল্যে মোড়ানো বছর আবার নিশ্চয়ই আসবে। সেই আসার আশা দিয়ে রাখল ২০১৮।
এ বছর বাংলাদেশের ১৩ জয় এসেছে ২০ ম্যাচে। এ বছর যে ১৮টি দল ওয়ানডে খেলেছে; এর মধ্যে জয় বিবেচনায় বাংলাদেশ তৃতীয় সেরা। ২০ ম্যাচে ১৪ জয় নিয়ে একটু ওপরে ভারত। ২৪ ম্যাচে ১৭ জয় নিয়ে সবার ওপরে ইংল্যান্ড। ২০ ম্যাচে ১২ জয় নিয়ে বাংলাদেশের পেছনে আফগানিস্তান। এটি প্রতীকীও। বাংলাদেশকে বেশ ভালোভাবে পিছু তাড়া করছে ক্রিকেটের নতুন শক্তি হয়ে উঠে আসা আফগানরা। তাই জিরোবার সুযোগ নেই। মাশরাফিও জানেন, এ ক্ষণিকের বিশ্রাম মাত্র!
কাল সংবাদ সম্মেলনে মিরাজের সারল্যমাখা বকনি শেষে মাশরাফি নিজেই সামনের চ্যালেঞ্জটার কথা মনে করিয়ে দিলেন, ‘দল টানা জিতলে যেটা হয় যে আত্মবিশ্বাস ভালো থাকে। পাশাপাশি অগ্রগতিও পরিষ্কার। এরপর নিউজিল্যান্ড সিরিজ আছে। আমাদের জন্য সিরিজটি খুব গুরুত্বপূর্ণ। গতবার আমরা ওদের ওখানে গিয়ে হেরে এসেছি। আমার কাছে মনে হয়, এবার আমাদের দল আরও ভারসাম্যপূর্ণ। আমার বিশ্বাস, আগেরবারের চেয়ে এবার ভালো খেলব। বিশ্বকাপের জন্যও কিছুটা হলে আদর্শ হবে। যদিও কন্ডিশন কিছুটা ভিন্ন। তবুও ভালো হবে।’
বিশ্বকাপের আগে বাংলাদেশ আর দুটি সিরিজ পাবে। সব মিলিয়ে ৭টির মতো ওয়ানডে। চূড়ান্ত প্রস্তুতির ধাপ এরপরই। পঞ্চপাণ্ডবের শেষ বিশ্বকাপ। ২০২৩ বিশ্বকাপে এই পাঁচের কজন থাকবেন, বলা কঠিন। ইংলিশ কন্ডিশনে ‘বড় কিছু’র আশা করতে ভয়। আবার বিশ্বকাপের মহড়া টুর্নামেন্ট হয়ে এসেছিল গত বছরের যে চ্যাম্পিয়নস ট্রফি; সেখানে আশার ঝিলিকও ছিল। তবে বিশ্বকাপের বছরে পা রাখার আগে বাংলাদেশ শেষটা ভালোমতোই টেনে দিতে পারল। টানা তিন সিরিজ জয়ে বছর শেষ করার মোমেন্টাম নিয়েই ২০১৯ শুরু করবে বাংলাদেশ।
ব্যক্তিগত সাফল্যের ইটেই দলীয় অর্জন গাঁথা হয়। এ বছরের সর্বোচ্চ রান সংগ্রাহকের তালিকায় সেরা দশে আছেন মুশফিকুর রহিম। ১৯ ইনিংসে ৭৭০ রান। তবে ব্যাটিং গড়ে কোহলি আর রস টেলরের পরেই থাকা তামিম ইকবাল (৮৫.৫০) আফসোস করতে পারেন, দলের ২০ ম্যাচের ৮টিতেই বসে থাকতে না হলে রানটা (৬৮৪) তাঁর অনেক বেশি হতো। ১২ ইনিংসের ৮টিতেই কমপক্ষে ৫০ পেরোনো তামিম এ বছর ছিলেন অবিশ্বাস্য ধারাবাহিক। চোটের কারণে দীর্ঘ অনুপস্থিতির মরচেও ব্যাটে পড়তে দেননি। ফিরেই এই সিরিজে দুটি ফিফটি করেছেন। সব মিলিয়ে বছরে ৬ ফিফটি আর দুটি সেঞ্চুরি তাঁর।
বোলিংয়ে এ বছরের যৌথভাবে সেরা ৬ নম্বর বোলার মোস্তাফিজুর রহমান। ১৮ ম্যাচে ২৯ উইকেট। ২০ ম্যাচে ২৬ উইকেট নিয়ে তাঁর পরই আছেন মাশরাফি নিজে। মাশরাফির বোলিং যাঁদের চোখে পড়ে না, এটিও সেই নিন্দুকদের জন্য একটি বার্তা। উইকেট সংখ্যায় এটি মাশরাফির ক্যারিয়ারেরই তৃতীয় সেরা বছর। পাঁচের নিচের ইকোনমি রেটটাও বলছে, ধীরে ধীরে স্ট্রাইক বোলারের ভূমিকা থেকে সরে আসা মাশরাফি রান আটকানোর কাজে বেশি জোর দিয়েও দুই ক্ষেত্রেই সফল। বছরের সব কটি ম্যাচ খেলা দুই বাংলাদেশির একজন (অন্যজন মাহমুদউল্লাহ), এই তথ্যও বলছে, বয়স, চোটের ইতিহাস, ছোটখাটো ইনজুরিকেও মাশরাফি কাঁচকলা দেখিয়ে চলছেন জোর কদমে।
১৫ ওয়ানডেতে ২৩ উইকেট নিয়ে এরপর আছেন গত ম্যাচে বাদ পড়া রুবেল। আগামী বিশ্বকাপে তিন পেস–নির্ভর আক্রমণ সাজাতে এই পরিসংখ্যান বাংলাদেশকে আরও বেশি সাহস জোগাবে। ৪৯৭ রান করার পাশাপাশি ২১ উইকেট নেওয়া সাকিব যথারীতি দলের প্রাণভোমরা। অফস্পিনে ১৮ উইকেট নেওয়া মিরাজ বোলিং আক্রমণে বাড়তি বৈচিত্র্য যোগ তো করছেনই, পাশাপাশি লোয়ার ব্যাটিং অর্ডারেও যে ভূমিকা রাখবেন, এ বছর ৪২ রানের একটি ইনিংস আর সব মিলিয়ে ১২৬ রান তুলে সেই ইঙ্গিত দিয়ে রেখেছেন।
সব মিলেই তাই এ প্লাস। এবার সেটিকে গোল্ডেনের রাংতায় মোড়ানোর জন্য ২০১৯-এ পা দেওয়ার অপেক্ষা।