ফ্লাইট মিস, ইরাকি ট্যাক্সি ড্রাইভার ও হারবার লজ

ওয়েলিংটনের ইরাকি ট্যাক্সি চালক রবার্ট জিব্রায়েল শাইমন। ছবি: লেখক
ওয়েলিংটনের ইরাকি ট্যাক্সি চালক রবার্ট জিব্রায়েল শাইমন। ছবি: লেখক

বিকেল সাড়ে চারটায় ওয়েলিংটন এয়ারপোর্টে নামার কথা। নামলাম এসে ঠিক দুই ঘণ্টা পর। না, এয়ার নিউজিল্যান্ডের কোনো দোষ নেই। কিছুটা আমার দোষ, কিছুটা আমার কপালের আর কিছুটা লাউয়ের! 

লাউয়ের মতো এমন নিরীহ সবজি খুব একটা হয় না। চুপচাপ কী সুন্দর ঝুলে থাকে! সেটি আবার কী করল? বলছি। কেমব্রিজ আর কারাপিরো লেক নিয়ে লেখা কালকের ডায়েরিতে আপনাদের জাহিদুল ইসলামের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিয়েছিলাম। ওই যে হ্যামিল্টন প্রবাসী বাংলাদেশি ভদ্রলোক, যাঁর গাড়িতে করে কেমব্রিজ আর কারাপিরো লেক ঘুরে এসেছি। কাল ঘুরিয়ে-টুরিয়ে তাঁর বাড়িতে নিয়ে গেলেন। গিয়ে দেখি, রীতিমতো উৎসবের আমেজ। উৎসবের কেন্দ্রবিন্দুতে ওই লাউ। জাহিদুলের বাড়ির আঙিনায় তেরো বছরে এই প্রথম গাছে দুটি লাউ ধরেছে। মহাসমারোহে সেই লাউ দুটিকে গাছ থেকে বিচ্ছিন্ন করা হলো। ছবি-টবি তুলে এই স্মরণীয় মুহূর্তটিকে অমর করে রাখার বন্দোবস্তও । তখনই ঘোষণা দিয়ে দেওয়া হলো, পরদিন দুপুরে সেই লাউ চিংড়ি দিয়ে রান্না করা হবে এবং আমাকে অবশ্যই সেটি খেতে হবে।
যত না লাউ-চিংড়ির লোভে, তার চেয়ে বেশি বিদেশ-বিভুঁইয়ে এমন আন্তরিকতার মূল্য দিতে দুপুরে জাহিদুলের বাড়িতে আতিথ্য গ্রহণ করতেই হলো। হাতে সময় তো আছেই। বিকেল ৩টা ২৫ মিনিটে ওয়েলিংটনের ফ্লাইট। আধঘণ্টা আগে হ্যামিল্টন এয়ারপোর্টে পৌঁছলেই হবে। আর দুপুরে কোথাও না কোথাও তো খেতে হতোই। অখাদ্য-কুখাদ্য খাওয়ার চেয়ে মিসেস জাহিদুল ইসলামের সুস্বাদু বাঙালি খাবার খাওয়াই ভালো। আয়েশ করে তা খেতে গিয়ে প্রথম দেরিটা হলো। সেখান থেকে বেরিয়ে মানি চেঞ্জারে টাকা ভাঙাতে গিয়ে আরেকটু। তারপরও তো হাতে যথেষ্ট সময়, এয়ারপোর্টে সময়মতো পৌঁছে না যাওয়ার কোনো কারণই নেই।
এবারই আসছে কপালের প্রসঙ্গ। হ্যামিল্টন শহর থেকে গাড়িতে মাত্র মিনিট বিশেক দূরে এয়ারপোর্ট। কিন্তু এয়ারপোর্টে ঢোকার সোজা রাস্তাটা কোনো কারণে বন্ধ। ট্রাফিক পুলিশের মতো একজন সেখানে দাঁড়িয়ে হাত দিয়ে বিকল্প পথের সন্ধান দিয়ে দিচ্ছে। সেই বিকল্প পথ মানে প্রায় ৩০-৪০ কিলোমিটার ঘুরে আসা এবং অফিস ছুটি হয়েছে বলে রাস্তায় অনেক গাড়ি। জাহিদুল কাজে যাবেন বলে সঞ্জয় সাহা নামে যে তরুণ আমাকে এয়ারপোর্টে পৌঁছে দিচ্ছেন, তিনি রাস্তা একটু ফাঁকা পেলেই জরিমানার ঝুঁকি নিয়ে স্পিড লিমিট ভাঙতে লাগলেন। তাতেও কাজ হলো না। পড়িমরি করে এয়ার নিউজিল্যান্ডের কাউন্টারের সামনে যখন দাঁড়ালাম, ঘড়িতে তখন ঠিক ৩টা ২৫। কাউন্টারের তরুণী আমার টিকিট দেখে ফোন তুললেন এবং প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই সেটি নামিয়ে রেখে জানালেন, প্লেন রানওয়েতে দৌড় শুরু করে দিয়েছে। এটাই অবশ্যম্ভাবী বলে মানসিক প্রস্তুতি থাকায় মাথায় আকাশ ভেঙে পড়ল না। যা ভেঙে পড়ল, তা হলো ২০০ ডলারের দণ্ডি।
আমার টিকিটটা কম্পিউটারে চেক করে এয়ার নিউজিল্যান্ডের ওই তরুণী আনন্দিত মুখে জানালেন, এই টিকিট ‘নন রিফারেন্ডেবল’ ‘নন চেঞ্জেবল’...‘নন’ দিয়ে শুরু আরও কী কী যেন! আমার সব শোনার ধৈর্য হলো না। আমি শুনছি কি শুনছি না, এটিকে বিন্দুমাত্র গ্রাহ্য না করে ওই তরুণী যন্ত্রের মতো তাঁর পুরো বক্তব্য শেষ করলেন এবং পাশের কাউন্টারে একটা টেলিফোন সেট দেখিয়ে বললেন, ‘তোমাকে নতুন টিকিট কাটতে হবে। ওই ফোনটা তুললেই এয়ার নিউজিল্যান্ড টিকিট রিজার্ভেশনে লাইন পেয়ে যাবে। অনেক অপশন আছে।’
আসলেই আছে। ৪০ মিনিট পরই ওয়েলিংটনের আরেকটা ফ্লাইট। দুই ঘণ্টা পর আরেকটা...এরপর নিয়মিত বিরতি দিয়ে আরও বেশ কয়েকটা। ৪০ মিনিট পরের ফ্লাইটটার আকাশচুম্বী দাম। তারপরও সেটিই কাটতে চেয়েছিলাম। তখন আবার আরেক বিড়ম্বনা। ক্রেডিট কার্ড নাকি কাজ করছে না। ঢাকায় পরিচিত ব্যাংক কর্মকর্তাকে ফোন করে সেটির সুরাহা হলো। কিন্তু ততক্ষণে ৪০ মিনিট পরের ফ্লাইটটাও আকাশে। এসব করতে করতে মনে হচ্ছিল, আমাদের বাংলাদেশই আসলে ভালো, প্লেন-ট্রেন-বাস কোনো কিছু সময়মতো ছেড়ে না যাওয়াই যেখানে নিয়ম। বিপদে-আপদে একটু বাড়তি সময় পাওয়া যায়।

ওয়েলিংটন বিমানবন্দরে ‘দ্য হবিট’ ট্রিলজির দুই ইগলের একটি। ছবি: লেখক

যা হোক, ফ্লাইট মিস করা আমার জীবনে এটাই প্রথম নয়। এ নিয়ে অনেক গল্প আছে। সেসব আজ আর না-ই বলি। হ্যামিল্টন থেকে এবার ওয়েলিংটনে নামি। সেই নামাটা নিয়ে খুব উৎকণ্ঠায় ছিলাম। এবারের ট্যুরে আগের তিনটি ডোমেস্টিক ফ্লাইটে মোটামুটি বড়, বলা ভালো, একটু কম ছোট প্লেনই পেয়েছি। আর যে ওয়েলিংটনে প্লেন ল্যান্ডিং নিয়ে ভয়াবহ সব গল্প চালু আছে, সেখানেই নাকি যাচ্ছি খেলনা এক প্লেনে চড়ে! পাইলট ল্যান্ডিং করতে যাচ্ছেন বলে ঘোষণা দেওয়ার পর তাই সিটের দুপাশের হাতল আঁকড়ে ধরলাম। নামার আগে নির্ঘাত পিং পং বলের মতো লাফাবে এই ছোট্ট প্লেন, একবার এপাশে কাত হবে, আরেকবার ওপাশে। কী আশ্চর্য, এসবের কিছুই হলো না। একেবারে স্মুথ ল্যান্ডিং যাকে বলে! রহস্যটা বুঝলাম প্লেন থেকে নামার পর। বিশ্বের সবচেয়ে ‘উইন্ডি সিটি’ হিসাবে খ্যাতি এই ওয়েলিংটনের। রাস্তায় হাঁটতে গেলেও যেটি দুপাশে দোল খাওয়ায়। অথচ আজ বাতাস নেই বললেই চলে। ২০০ ডলার গচ্চা দেওয়ার জ্বালায় মলম লাগাতে মনে মনে বললাম, ‘আমার মিস্‌ করা ফ্লাইটটা নামার সময় নিশ্চয়ই এমন ছিল না। সেটি নিশ্চয়ই আরেকটা ভয়ংকর ল্যান্ডিংয়ের উদাহরণ হয়ে আছে।’
ওয়েলিংটন সর্বশেষ এসেছি প্রায় আট বছর আগে। এয়ারপোর্টে বিশাল এই ইগল দুটি ছিল তখন ছিল না। ২০১৩ সালে মহা সাড়ম্বরে এই দুটির আবির্ভাবের কথা পড়েছিলাম। কিছুদিন পর ভূমিকম্পে এর একটির ছিঁড়ে পড়ার কথাও। একেকটার ওজন এক টন করে। ভাগ্যিস, এয়ারপোর্ট তখন ফাঁকা ছিল। এই ইগলের রহস্য লুকিয়ে ‘দ্য হবিট’ ট্রিলজিতে। এই সিনেমার পরিচালক পিটার জ্যাকসনের বাড়ি এই ওয়েলিংটনে। এ কারণেই ‘হবিট’ সিরিজের মতো তাঁর পরিচালিত ‘লর্ড অব দ্য রিংস’ ট্রিলজি নিয়েও এই শহরের খুব গর্ব। এয়ারপোর্টের ইগল দুটি সেই সিনেমার চরিত্র। একটির পিঠে আবার কেন্দ্রীয় চরিত্র গেনডালফও আছেন। মোবাইলের ক্যামেরায় দুটি ইগলকে এক ফ্রেমে ধরার চেষ্টা করে ব্যর্থ হওয়ার পর একসময় ক্ষান্ত দিলাম। এবার হোটেলের দিকে রওনা হওয়া উচিত। মাঠের কাছেই একটা হোটেলে ওঠার কথা টেস্ট শুরুর আগের দিন। আজ আর কাল সেখানে রুম পাইনি। ওয়েলিংটন শহরের প্রাণকেন্দ্রে আগে একাধিকবার থেকেছি। এবার অন্য একটা অভিজ্ঞতা নিতে এই দুদিনের জন্য বুকিং দিয়েছি শহরের শেষ প্রান্তে হারবারের পাশে এক লজে। সেটি অনেক দূরেই হওয়ার কথা।
এ ব্যাপারে আরও নিশ্চিত হয়ে গেলাম ট্যাক্সিতে ওঠে। ষোলো বছর ধরে ওয়েলিংটনে ট্যাক্সি চালানোর অভিজ্ঞতাসম্পন্ন ড্রাইভার আমার হোটেলের ঠিকানা দেখে বললেন, ‘ওই অঞ্চলে আমি আগে কখনো যাইনি।’ এই সেরেছে! না জানি কোথায় গিয়ে উঠব! বেশির ভাগ দেশেই ট্যাক্সির ড্যাশবোর্ডে ঝোলানো একটা কার্ডে ট্যাক্সি চালকের নাম লেখা থাকে। এটিতে লেখা ‘সামি’। একটু অবাকই হলাম। ট্যাক্সি চালককে দেখে তো মনে হচ্ছে, কিউই-ই হবেন। কিন্তু নামটা তো মিলছে না। ‘আপনার নামটা তো বাংলাদেশে খুব কমন’—বলতেই হাসি দিয়ে বললেন, ‘আমি শুনেছি, ইসলামিক কান্ট্রিগুলোতে এই নাম খুব প্রচলিত। আচ্ছা, এই নামের অর্থ কী, জানেন? আমি জানতে চাই।’

হারবার লজের জানালা দিয়ে দেখা দৃশ্যপট। ছবি: লেখক

নিজের নাম আর সেটির অর্থ জানতে চাইছেন আমার কাছে! একটু না, অনেকখানিই বিস্মিত হলাম। তার চেয়ে বেশি বিস্মিত তাঁর জীবনকাহিনি শুনে। এখানে এসে পাসপোর্ট করার সময় কীভাবে যেন নামটা ‘সামি’ হয়ে গেছে। আসল নাম রবার্ট জিব্রায়েল শাইমন। যা থেকে বুঝে নেওয়ার কথা, তিনি খ্রিষ্টান। এখানে এসে পাসপোর্ট করার কথা শুনেই বুঝে ফেললাম, অন্য কোনো দেশ থেকে নিউজিল্যান্ডে এসেছেন। সেই দেশ ইরাক। ১৯৯৬ সালে দেশ ছাড়ার পর এই ২১ বছর ওয়েলিংটনেই আছেন। প্রথম দর্শনেই যে প্রেম হয়ে গেছে এই শহরের সঙ্গে। ২১ বছরের শেষ ষোলো বছর ট্যাক্সি চালাচ্ছেন, এর আগে তাহলে কী করতেন? অনেক কিছুই করেছেন। রেস্টুরেন্টে কাজ করেছেন, পেট্রল পাম্পে, ইলেকট্রিশিয়ানের কাজও করেছেন বেশ কিছুদিন। অথচ তিনি কি না ইলেকট্রিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে স্নাতক! ইরাকে ভালো চাকরি করতেন। ভাই-বোন সবাই উচ্চশিক্ষিত। ইঞ্জিনিয়ার আরেক ভাই লস অ্যাঞ্জেলসে সেই পেশাতেই আছেন। আরেকজন সিডনির ইউটিএস বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক। বোনও সেখানেই স্কুলে শিক্ষকতা করেন। ৩০ ও ২৮ বছরের দুই মেয়েও সিডনিতে থাকেন। একজন কিন্ডার গার্ডেনে পড়ান, আরেকজন স্কুলে। আমি ক্রিকেটের জন্য এখানে এসেছি জানার পর বললেন, ‘আমার ছোট মেয়েটা ক্রিকেটের পাগল। সারা দিন শুধু টিভিতে ক্রিকেট দেখে। ওর নাম অর্নেলা।’ তিনি নিজে ক্রিকেট একদমই পছন্দ করেন না। তাঁর পছন্দ ফুটবল। প্রিয় দল ব্রাজিল ও ম্যানচেস্টার ইউনাইটেড। মেয়েদের তাঁর দলে ভেড়াতে পেরেছেন, তবে বউ চেলসির অন্ধ সমর্থক। ইউনাইটেডের এখনকার খেলা দেখে খুব খুশি। হোসে মরিনহোর ওপর রাগটা আরও বেড়েছে তাতে। সেই ক্ষোভ এমনই যে, মনে হলো, হাতের কাছে পেলে নির্ঘাত মরিনহোর মুখে একটা ঘুষি বসিয়ে দেবেন।
ইরাক-কুয়েত-সাদ্দাম হোসেনকে নিয়ে গল্প করতে ভালোই লাগছে। কিন্তু একটু অস্থিরও। শহর ছাড়িয়ে পাহাড়ি রাস্তা ধরে চলছি তো চলছিই। দুদিনের জন্য আমার ঠিকানা হারবার লজের দেখা তো আর পাই না। অবশেষে সেটির দেখা মিলল। এই ৩০-৪০ মিনিটের যাত্রায় সাবেক ইঞ্জিনিয়ার ও বর্তমানে ট্যাক্সি চালক ইরাকির সঙ্গে সাবেক ইঞ্জিনিয়ার ও বর্তমানে সাংবাদিক বাংলাদেশির এমনই খাতির হয়ে গেছে যে, বিদায়পর্বটা রীতিমতো আবেগময় হলো।
হারবার লজের রুমে ঢুকে জানালা দিয়ে বাইরে তাকাতেই মুছে গেল ভ্রমণক্লান্তি। চারদিক সুনসান, দূরে পাহাড়ের গায়ে গায়ে সাদা রঙের সব বাড়ি। আরেক পাশে হারবারের শান্ত জলরাশি। রুমে ঢুকেছি গোধূলিবেলায়। বেশি কিছু দেখা হয়নি। কাল চারপাশে একটু ঘুরে-টুরে তারপর না হয় এই লজের গল্প বলি।