পাকিস্তানের বিপক্ষে সিরিজে শেষ টি-টোয়েন্টি ম্যাচের দিন বিসিবির অফিশিয়াল ফেসবুক পেজে একটি পোস্ট দেখে থমকে গিয়েছিলেন ক্রিকেটপ্রেমীরা। পোস্টটি করা হয়েছিল অভিষিক্ত পেসার শহীদুল ইসলামের উইকেটপ্রাপ্তি নিয়ে। সেখানে শহীদুলের মুখটা বোঝা গেলেও একটা ‘কিন্তু’ থেকে গিয়েছিল। বুদ্ধিমান ক্রিকেটপ্রেমীদের সেই ‘কিন্তু’–রহস্যের সমাধান করে ফেলতে বিন্দুমাত্র সময়ও লাগেনি। আরে, শহীদুলের গায়ে তো বাংলাদেশের ২০১৯ বিশ্বকাপের জার্সি! আরও সচেতন ক্রিকেটপ্রেমীরা সে জার্সির রহস্যও দ্রুত খুঁজে বের করলেন। ২০১৯ বিশ্বকাপে সাকিব আল হাসানের একটি ছবির মাথা কেটে সেখানে বসিয়ে দেওয়া হয়েছে শহীদুলের মুখ!
বিসিবির এই পোস্টের পর রীতিমতো হইচই পড়ে যায়। অনেকেই পুরো বিষয়ের সঙ্গে বাংলাদেশের ক্রিকেট যেভাবে চলছে—তার সঙ্গে যোগসূত্র খুঁজে পেয়েছেন। সমালোচনার ঝড় বইছে সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যমে। বিভিন্ন ট্রল পেজ খুঁজে পেয়েছে দেশের ক্রিকেট নিয়ে ঠাট্টা করার বিষয়।
বাংলাদেশের ক্রিকেট এ মুহূর্তে সমালোচনার কেন্দ্রে। টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপের পারফরম্যান্স যেন বাংলাদেশ ক্রিকেটের অনেক বিষয় চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছে। বিসিবির বিভিন্ন কার্যক্রমও ক্রিকেটপ্রেমীদের প্রশ্নের মুখে পড়েছে। চারদিকে যখন ক্রিকেটে পরিচালনা ও কার্যক্রমে নানা সংস্কারের দাবি উঠছে, ঠিক তখনই বিসিবির অফিশিয়াল ফেসবুক পেজে পেসার শহীদুলের এই গলাকাটা ছবি যেন আক্ষরিক অর্থেই বাংলাদেশের ক্রিকেট কার্যক্রমের প্রতীকী চিত্র। সামাজিক মাধ্যমে ট্রল, হাসি, তামাশার মধ্যে অমোঘ সত্যটা বড় নগ্নভাবেই বেরিয়ে এসেছে—দেশের ক্রিকেট, সেটি মাঠেই বলুন, কর্মকর্তাদের টেবিলেই বলুন, কিংবা মেধাবীদের লালন-পালনেই বলুন, কোনো জায়গায় ঠিকভাবে চলছে না।
যুগটা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের। ফেসবুক, ইনস্টাগ্রাম, টুইটার—মানুষের দৈনন্দিন জীবনযাপনের অংশ। ডিজিটাল প্ল্যাটফর্মে সক্রিয় উপস্থিতি না থাকলে গণমানুষের কাছাকাছি পৌঁছানো যায় না, এ সত্য সবাই বুঝে গেছে। গণমাধ্যমগুলো এখন সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমনির্ভর, ডিজিটাল প্ল্যাটফর্মকে সঙ্গী করেছেন ব্যক্তি বিশেষও। খেলাধুলার ক্ষেত্রে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের প্রয়োজনীয়তা আরও ব্যাপক। ব্যবসা-বাণিজ্যে তো বটেই; ফেসবুক, টুইটার, ইনস্টাগ্রামেই সাধারণ মানুষকে সম্পৃক্ত করা হয়, বিপণনের বড় অংশটা হয় এসব মাধ্যমেই। খেলার দুনিয়ায় ক্রীড়া সংস্থাগুলো তো বটেই, বিভিন্ন ক্লাবও এখন তাদের ভক্ত-সমর্থকদের সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে সম্পৃক্ত করেন, সংগঠিত করেন। খেলোয়াড়েরা তাঁদের দৈনন্দিন কার্যক্রম, বিভিন্ন ভাবনা নিজেদের ফেসবুক, টুইটারে তুলে ধরছেন। পৃথিবীর বড় বড় ক্লাব এসবের মাধ্যমেই নিজেদের ভক্ত, সমর্থকদের সঙ্গে সম্পর্ক রাখছে।
বাংলাদেশের খেলাধুলা অবশ্য এসবের ধার খুব একটা ধারে না। দেশের খুব কম ক্রীড়া ফেডারেশন ও ক্লাবই সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে নিয়মিত। আর তা-ও যা আছে, সেটি ভুলভাল আর অপ্রয়োজনীয় পোস্টে সীমাবদ্ধ। এর সঙ্গে নতুন করে যুক্ত হলো ‘গলাকাটা ছবি’।
বাংলাদেশের সবচেয়ে পয়সাওয়ালা ক্রীড়া সংস্থা হচ্ছে ক্রিকেট বোর্ড। বিসিবির ব্যাংক হিসাবে হাজার কোটি টাকা জমা থাকে—এমন বড়াই ক্রিকেট সংগঠকেরা প্রায়ই করেন। প্রায়ই হিসাব বের হয়, বিসিবি দুনিয়ার এত নম্বর ‘ধনী’ ক্রিকেট বোর্ড, অমুক দিক দিয়ে এই, ওই, সেই। কিন্তু বাকি কার্যক্রম বাদ দিলেও বিসিবির সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের বিভিন্ন প্ল্যাটফর্মে ঢুঁ মারলে যে দৈন্য প্রকাশ পায়, সেটির সঙ্গে তাদের ব্যাংক হিসাব মেলানো যায় না।
সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম এখন খবরের বড় উৎস। সংবাদকর্মীরা সারা দুনিয়াতেই এখন ডিজিটাল প্ল্যাটফর্ম থেকে খবর সংগ্রহ করেন। কিন্তু বাংলাদেশের হাতে গোনা দু-একটি ক্রীড়া ফেডারেশনের যে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের পেজ আছে, তাতে পর্যাপ্ত তথ্য তো দূরে থাক, মোটামুটি তথ্যও খুঁজে পেতে গলদঘর্ম হতে হয়। ক্রিকেটে বিভিন্ন টেস্ট খেলুড়ে দেশ তো বটেই, আইসিসির সহযোগী সদস্যদেশগুলোর ফেসবুক, টুইটার পেজের সঙ্গে বিসিবির পেজগুলোর তুলনা করলে হতাশ হতে হয়। লাখ লাখ ফলোয়ার নিয়েও যে বিসিবির ফেসবুক আর টুইটার এত নির্জীব হতে পারে, সেটি না দেখলে বিশ্বাস করা কষ্ট। বিদেশে বাংলাদেশ দল খেলতে গেলে বিসিবির টুইটার, ফেসবুক যেন গভীর ঘুমে তলিয়ে যায়। সেখানে না থাকে ক্রিকেট দলের কার্যক্রমের ভালো ছবি, না ভিডিও। অথচ পাশের দেশ ভারত কিংবা পাকিস্তান ক্রিকেট বোর্ডেরও ফেসবুক কিংবা টুইটার পেজ অনেক বেশি সমৃদ্ধ। চলমান সফরেও জৈব সুরক্ষাবলয়ে থাকা পাকিস্তান দলের কার্যক্রমের সব চিত্রই সংবাদকর্মীরা তাঁদের টুইটার পেজ থেকে সংগ্রহ করেছেন। প্রতিটি অনুশীলন সেশনের ছবি তো সেখানে ছিলই, খেলোয়াড়দের গণমাধ্যম–সংযোগটাও এবার হয়েছে টুইটারের মাধ্যমেই।
মাঠের খেলায় তো পার্থক্য চোখের সামনেই দেখা যায়, আধুনিক যুগের প্রয়োজনীয় অনুষঙ্গগুলোতেও অন্য দেশগুলোর সঙ্গে পার্থক্য চোখে ধরা পড়ছে। ক্রিকেটপ্রেমীরা তাই বিসিবির ফেসবুক পেজে শহীদুলের মাথাকাটা ছবির সঙ্গে দেশের ক্রিকেটের বর্তমান অবস্থার মিল খুঁজে নিচ্ছেন।
দেশের ক্রিকেটের অনেক কিছুর সঙ্গেই এ অবস্থার দ্রুত পরিবর্তন দরকার। সমালোচনাগুলো ইতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গিতে নিয়ে প্রয়োজনীয় সেই পরিবর্তন, সংস্কারগুলো বিসিবি করবে কি না, সেটিই এখন দেখার বিষয়।