মেলবোর্ন ক্রিকেট গ্রাউন্ডে শেন ওয়ার্নের রাষ্ট্রীয় শ্রদ্ধাঞ্জলিতে তাঁর মেয়ে ব্রুক
মেলবোর্ন ক্রিকেট গ্রাউন্ডে শেন ওয়ার্নের রাষ্ট্রীয় শ্রদ্ধাঞ্জলিতে তাঁর মেয়ে ব্রুক

ফুল, শ্রদ্ধা আর ভালোবাসায় ওয়ার্ন–স্মরণ

বেলা বাড়ে, বাড়ে মানুষের ভিড়। কেউ কোলে করে নিয়ে এসেছেন তাঁর মেয়েকে। কারও হাত ধরে এসেছে তাঁর ছোট্ট ছেলে। কেউ আবার পথের কষ্ট সয়ে পুরো পরিবার নিয়েই হাজির মেলবোর্ন ক্রিকেট গ্রাউন্ডের (এমসিজি) ফটকে। শেন কিথ ওয়ার্নকে শেষশ্রদ্ধা জানাতে হবে না!

অস্ট্রেলিয়া তথা পুরো বিশ্বের ক্রিকেটপ্রেমীদের জন্যই আজকের দিনটি ছিল ওয়ার্নকে শেষশ্রদ্ধা জানানোর। গত ৪ মার্চ থাইল্যান্ডের একটি অবকাশযাপন কেন্দ্রে হার্ট অ্যাটাকে মারা গেছেন কিংবদন্তি ক্রিকেটার ওয়ার্ন। অস্ট্রেলিয়া সরকার আজ রাষ্ট্রীয়ভাবে তাঁর জন্য শ্রদ্ধাঞ্জলির আয়োজন করে মেলবোর্ন ক্রিকেট গ্রাউন্ডে। সেখানে তাঁকে শেষশ্রদ্ধা জানাতে এসেছিলেন প্রায় ৬৫ হাজার মানুষ। সাধারণ ক্রিকেটপ্রেমী, সাবেক ও বর্তমান ক্রিকেটার থেকে শুরু করে ওয়ার্নের শেষকৃত্যে এসেছেন অভিনয়, সংগীত, রাজনীতিসহ বিভিন্ন জগতের তারকারা।

শেন ওয়ার্নকে শ্রদ্ধা জানাতে মেলবোর্ন ক্রিকেট গ্রাউন্ডে যান অস্ট্রেলিয়ার প্রধানমন্ত্রী স্কট মরিসন

ওয়ার্নের শ্রদ্ধাঞ্জলিতে সাধারণ ভক্তরা প্রথমে থেমেছেন এমসিজির ফটকে প্রিয় তারকার মূর্তির সামনে। ফুলেল ভালোবাসায় সিক্ত করেছেন মহাপ্রয়াণে চলে যাওয়া প্রিয় তারকাকে। মেলবোর্নের অনুষ্ঠানে অবশ্য ছিল না ওয়ার্নের কফিন। ওয়ার্নের শবদেহ নিয়ে সেটা গত ২০ মার্চই চলে গেছে পৃথিবীর বুকে। সেদিন পারিবারিক শেষকৃত্য শেষে শেন ওয়ার্নকে শুইয়ে দেওয়া হয়েছে শেষ শয়ানে।

অস্ট্রেলিয়ার সময় সন্ধ্যা সাতটায় শুরু হয় ওয়ার্নের শ্রদ্ধাঞ্জলি অনুষ্ঠান। কিংবদন্তি লেগ স্পিনারকে স্মরণ করেন তাঁর সাবেক সতীর্থ ও প্রতিদ্বন্দ্বী খেলোয়াড়েরা। ওয়ার্নকে স্মরণ করতে গিয়ে কেউ তাঁকে বলেছেন ‘জিনিয়াস’, কেউ বলেছেন ‘কিং অব স্পিন’। শচীন টেন্ডুলকার, রাহুল দ্রাবিড়সহ অনেকেই ওয়ার্নকে স্মরণ করেন ভিডিও বার্তায়। এমসিজির বড় পর্দায় ভেসে ওঠে সেসব ভিডিও বার্তা। অ্যালান বোর্ডার, মার্ক টেলর, মার্ভ হিউজ, ব্রায়ান লারা ও নাসের হুসেইনরা ছিলেন মেলবোর্নেই। ওয়ার্নকে নিয়ে কথা বলতে গিয়ে আবেগাপ্লুত হয়ে পড়েন সবাই।

শেন ওয়ার্নের শ্রদ্ধাঞ্জলিতে অ্যালান বোর্ডার

টেন্ডুলকার বলেছেন ওয়ার্নের মুখোমুখি হওয়াটা কত কঠিন ছিল তা নিয়ে। ভিডিও বার্তায় টেন্ডুলকার বলেছেন, ‘আপনাকে কীভাবে আউট করা যায়, সে সব সময়ই সেটা নিয়ে ভাবত। ক্যারিয়ারে অল্প কয়েকজন ভালো স্পিনারের বিপক্ষে খেলেছি, এদের সবার মধ্যে শেন ছিল আরও আলাদা।’ দ্রাবিড়ের কথা, ‘তার কাছে প্রতিটি বলই ছিল প্রতিদ্বন্দ্বিতা।’ খেলোয়াড়ি জীবনে ওয়ার্নের তুমুল প্রতিপক্ষ ইংল্যান্ডের সাবেক অধিনায়ক নাসের হুসেইন বলেছেন, ‘ক্রিকেটের সেরা খেলোয়াড় সে। অবিশ্বাস্য এক ক্রিকেটার ও মানুষ সে।’

অস্ট্রেলিয়ার সাবেক খেলোয়াড় মার্ক টেলর বলেছেন, ‘তার চরিত্রটা ছিল কাঁচা হীরার মতো। আর এটাই তাকে মানুষের কাছে জনপ্রিয় করে তুলেছিল। মানুষ ভিন্ন কিছু দেখতে চায় আর ওয়ার্নের মধ্যে তারা সেটা পেয়েছে।’ ওয়ার্নের আরেক সাবেক অধিনায়ক অ্যালান বোর্ডারের কথা, ‘আমি জানি না অক্সফোর্ডের অভিধানে জিনিয়াস শব্দটাকে কীভাবে ব্যাখ্যা করা হয়েছে। কিন্তু ওকে দেখে জিনিয়াসের সংজ্ঞাটা বুঝতে পেরেছি। সে আমাদের জন্য অনেক স্মৃতি আর অসাধারণ সব মুহূর্ত রেখে গেছে।’

ওয়ার্নের শ্রদ্ধাঞ্জলিতে তাঁর বাবা কিথ ওয়ার্ন

ওয়ার্ন শ্রদ্ধা জানিয়েছেন বিনোদনজগতের তারকারাও। অস্ট্রেলিয়ার সংগীতশিল্পী কাইল মিনোগ বলেছেন, ‘সে জীবনটাকে ভালোবাসত।’ এরপর এলটন জন ভিডিও লিংকের মাধ্যমে পরিবেশন করেন তাঁর বিখ্যাত গান ‘ডোন্ট লেট দ্য সান গো ডাউন অন মি’। ওয়ার্নের মতো একজন প্রাণবন্ত মানুষের শেষ বিদায়ে এর চেয়ে ভালো শ্রদ্ধা জানানো গান আর কীই-বা হতে পারে!

ওয়ার্নকে নিয়ে সাবেক সতীর্থ, প্রতিপক্ষ ও বন্ধুদের কথার ফাঁকে ফাঁকে দেখানো হচ্ছিল তাঁর ক্যারিয়ার ও জীবন নিয়ে প্রামাণ্যচিত্র। বড় পর্দায় কখনো ভেসে উঠেছে বল অব দ্য সেঞ্চুরি, কখনো ভেসে উঠেছে টেস্ট ক্রিকেটে তাঁর ৭০০তম উইকেট পাওয়ার দৃশ্য। মাঝেমধ্যে এসেছে মানুষ ওয়ার্ন কেমন ছিলেন, তা-ও। ওয়ার্নের দাতব্য কাজ নিয়েও ছোট্ট একটা পরিবেশনা ছিল বড় পর্দায়।

একটা সময়ে পরিবারের সদস্যদের তাঁকে নিয়ে বলার পালা আসে। বাবা কিথ ওয়ার্ন ছেলেকে নিয়ে বলতে গিয়ে আবেগে ভেসে যান, ‘আমাদের পরিবার প্রিয় ছেলেকে হারিয়েছে। জেসন হারিয়েছে তার প্রিয় ভাইকে। ব্রুক, জ্যাকসন ও সামার হারিয়েছে অসাধারণ এক বাবাকে। শেন জীবনটাকে ভালোবাসত, ভালোবাসত ক্রিকেট। ও নিজেই বলত, “আমি ধূমপান করতাম, আমি মদপান করতাম আর অল্প অল্প ক্রিকেট খেলছি।” শান্তিতে ঘুমাও বাবা।’

ওয়ার্নের শ্রদ্ধাঞ্জলিতে কথা বলছেন তাঁর ছেলে জ্যাকসন

কিথ ওয়ার্নের কথার পর বড় পর্দায় ভেসে ওঠে রবি উইলিয়ামসের মুখ। বিখ্যাত অ্যাঞ্জেলস গানটি রেকর্ড করে পাঠিয়েছেন ব্রিটিশ সংগীতকার। রেকর্ড করা গান ছিল ক্রিস মার্টিন ও এড শিরানেরও। এক ফাঁকে কথা বলেন জেসন ওয়ার্নও। প্রিয় বড় ভাইকে নিয়ে কথা বলতে গিয়ে আবেগাপ্লুত হয়ে পড়েন তিনি। ওয়ার্নকে শেষশ্রদ্ধা জানান তাঁর বাগদত্তা লিজ হার্লিও।

সবার শেষে মঞ্চে আসেন ওয়ার্নের তিন সন্তান সামার, ব্রুক ও জ্যাকসন। মেলবোর্ন ক্রিকেট গ্রাউন্ডে শেন ওয়ার্ন স্ট্যান্ড উন্মোচন করেন তাঁরা। স্ট্যান্ড উন্মোচনের পর বাবাকে নিয়ে কথা বলেন তিন ভাইবোন। ছোট মেয়ে সামার বলেছেন, ‘বাবা, তুমি তোমার নাতি–নাতনিদের দেখতে পাবে না। কিন্তু আমি আমার বাচ্চাদের বলব, তুমি কত অসাধারণ বাবা ছিলে।’ বড় মেয়ে ব্রুকের কথা, ‘বাবার জন্য আমি সব সময়ই সেরাটা চেয়েছি। বাবাও আমার জন্য সেটাই চেয়েছে। আমার বাবা সেরা বাবা হতে চেয়েছেন। বাবা, তুমি আমাদের যেভাবে জীবন চলতে বলতে, আমরা সেভাবেই চলব। সব সময়ই তোমাকে ভালোবাসি বাবা।’

মেলবোর্ন ক্রিকেট গ্রাউন্ডের গ্যালারিতে শেন ওয়ার্ন স্ট্যান্ড

ছেলে জ্যাকসনের কথায় উঠে এসেছে বাবা ওয়ার্ন তাঁকে কীভাবে জীবন চলতে শিখিয়েছেন, ‘আমি যেদিন জীবনের প্রথম ক্রিকেট ম্যাচ খেলি, তুমি আমাকে বলেছিলে, “মাঠে নামো এবং উপভোগ করো। কারণ, তুমি আনন্দে থাকলে ভালো জিনিস এমনিতেই আসবে।” ওই ম্যাচে আমি সেভাবেই খেলেছি। আমি হ্যাটট্রিক করেছিলাম। সেই স্মৃতি আমি কখনো ভুলব না।’

ওয়ার্নও জীবনটা এভাবেই কাটিয়েছেন—আনন্দে। আর আনন্দে কাটাতে কাটাতেই ক্যারিয়ারে কত কীই-না জিতেছেন তিনি। সবচেয়ে বড় যে জিনিস ওয়ার্ন জিতেছেন, তা সতীর্থ, প্রতিপক্ষ, বন্ধু, পরিবার আর ভক্তদের ভালোবাসা। সেই ভালোবাসার স্রোত আজও তো দেখা গেল মেলবোর্ন ক্রিকেট গ্রাউন্ডে, শেন কিথ ওয়ার্নের রাষ্ট্রীয় শ্রদ্ধাঞ্জলিতেও।