চার বছর পর টেস্টে পাঁচ উইকেট পেলেন সাকিব
চার বছর পর টেস্টে পাঁচ উইকেট পেলেন সাকিব

‘এখন তো পাঁচ নম্বর বোলার ধরা হয় আমাকে’

চার বছর পর...চার বছর পর...। বারবার কথাটা শুনতে শুনতে একটা সময় যেন একটু বিরক্তই হয়ে গেলেন সাকিব আল হাসান। চার বছর পর তাঁর টেস্টে পাঁচ উইকেট পাওয়া নিয়ে সংবাদ সম্মেলনে কয়েকবারই তো প্রশ্ন হয়েছে, শেষের দিকে আবার প্রসঙ্গটা উঠতেই সাকিবের পাল্টা প্রশ্ন, ‘চার বছরে ম্যাচ খেলেছি কয়টা? বোলার হিসেবেই তো খেলিনি। এখন তো পাঁচ নম্বর বোলার ধরা হয় আমাকে, সে ক্ষেত্রে বোলিংয়ে দায়িত্বই কম।’

সাকিবের প্রশ্নটা যৌক্তিক বটে। চার বছরে সাকিব কয়টি টেস্ট খেলেছেন, সে উত্তর তো সম্ভবত অনেকেরই জানা। এ সময়ে বাংলাদেশ খেলেছে ২৪টি টেস্ট, সাকিব খেলেছেন তার মাত্র ৭টিতে। তাতে সাকিবের ক্যারিয়ারের কতটা ক্ষতি হলো, সাকিব টেস্টে আরও ভালো কিছু করে ইতিহাসে-রেকর্ড বইয়ে নামটা আরও উজ্জ্বল করার সুযোগ হাতছাড়া করেছেন কি না, সে ভিন্ন বিতর্ক। তবে বাংলাদেশ কী হারিয়েছে, সেটি আরেকবার আজ বোঝা গেল। সাকিব যে পাঁচ উইকেট নিয়েছেন!

শুধু পাঁচ উইকেটই কেন, চট্টগ্রামে প্রথম টেস্টে হঠাৎই এক বলের জন্য সাকিবের ‘চায়নাম্যান’ বনে যাওয়া, কাল ‘শেন ওয়ার্ন’ বনে গিয়ে করুনারত্নেকে ‘অ্যান্ড্রু স্ট্রাউস’ বানিয়ে আউট করা...অনেক দিন পর ফিরে পাওয়া যাচ্ছে ‘বোলার সাকিবকে।’

অথচ এই সিরিজের আগে সেভাবে খেলতেই পারেননি সাকিব! করোনার কারণে চট্টগ্রামে প্রথম টেস্টে তো তাঁর খেলাই অনিশ্চিত ছিল। কিন্তু সাকিব বলছেন, কোনো প্রস্তুতি ছাড়াই নেমে এমন বোলিংয়ের পেছনে কোনো আলাদা কাজ করেননি। কোনো পরিকল্পনা করে এভাবে বোলিং করেননি বলেও জানালেন। টেস্ট ক্রিকেট বলেই এমন বোলিং নিয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষার সুবিধার কথাও বললেন। সবিস্তার জানিয়েছেন ম্যাচ ফিটনেস আর শারীরিক ফিটনেসে পার্থক্যের কথাও।

তাঁর শুধু একটাই আক্ষেপ, এই টেস্টে তাঁর পাশে অন্য প্রান্তে আরেকজন বোলারকে এভাবে বোলিং করতে দেখলে বাংলাদেশের জন্য আরেকটু ভালো হতো।

গত ডিসেম্বরের পর এই সিরিজ দিয়েই টেস্টে ফেরা সাকিবের

ডিসেম্বরে পাকিস্তানের বিপক্ষে টেস্টের পর আর দীর্ঘ সংস্করণে খেলেননি। লাল বলে বোলিং করা হয়নি তাঁর। এরপর এই যে টেস্টে নেমেছেন, ১২ দিনে দুই টেস্টে ১০ দিন খেলছেন...তা-ও কোনো প্রস্তুতি ছাড়া। এমন পরিস্থিতিতে কিনা ইনিংসে পাঁচ উইকেট পেলেন, তাতে ৫ উইকেট নেওয়ায় টেস্ট ইতিহাসের শীর্ষ দশ স্পিনারের তালিকায়ও ঢুকে গেলেন সাকিব। কিন্তু এত দিন টেস্টের বাইরে থেকে, কোনো প্রস্তুতি ছাড়াই কীভাবে এমন বোলিং সম্ভব হলো?

উত্তরে নির্লিপ্ত সাকিব, ‘জানি না। বলা মুশকিল। আসলে বোলিং এমন একটা জিনিস, যেটা নিয়ে আমার কখনো আত্মবিশ্বাসের অভাব হয়নি। হ্যাঁ, এত বড় ক্যারিয়ারে দু-একবার হয়তো হয়েছে যে আমি বোলিং নিয়ে অত বেশি আত্মবিশ্বাসী ছিলাম না, তবে এ রকম খুবই কম হয়েছে যে আমি জীবনে কখনো বোলিং নিয়ে উদ্বিগ্ন ছিলাম। সেই আত্মবিশ্বাসটা ছিল। আর এখানে (ঢাকা প্রিমিয়ার লিগে) চারটা ম্যাচ যে খেলেছি, সেখানে প্রতিটা ম্যাচেই প্রায় সব ওভার বোলিং করেছি। সেটা আমার জন্য অনুশীলন হিসেবে যথেষ্ট ছিল।’

তবু তাঁর ফিটনেস নিয়ে তো প্রশ্ন ছিল! সিরিজ শুরুর আগে করোনা ধরা পড়ায় সাকিবের খেলা নিয়ে সংশয় আরও বেড়েছে। সেখান থেকে ম্যাচে নেমে যাওয়ার সিদ্ধান্তটা সাকিবেরই, কিন্তু সেটির পেছনে যুক্তি কী ছিল? সাকিবের ব্যাখ্যা, ‘একজন খেলোয়াড় এত দিন খেলার পর ১৫ দিনের ক্যাম্প বা ১০ দিনের কন্ডিশনিং তাঁকে খেলার জন্য প্রস্তুত করে দেয় না, এ রকম সময়ে তিন থেকে পাঁচটা সেশনই যথেষ্ট। হ্যাঁ, এই টেস্টের আগে খুবই কম সময় পেয়েছি। তবে সাধারণত আমি যদি খেলার ভেতরে থাকি, তাহলে আমার জন্য তিন সেশন খেলাই যথেষ্ট, খেলার ভেতরে না থাকলে পাঁচ সেশন। এত দিন খেলার পর আসলে অনুশীলনে ঝাঁপিয়ে পড়াটা খুব একটা জরুরি নয়, জরুরি হচ্ছে এটা দেখা যে আমি কতটুকু কাজ করছি এবং সেটা একটা উদ্দেশ্য সামনে রেখে করছি কি না।’

পাঁচ উইকেটের পাশাপাশি সাকিবের বোলিংয়ে কিছু বদলও নজর কেড়েছে

বিশ্লেষণ যা-ই হোক, ঝুঁকি তো ছিল। সেটি জানিয়ে সাকিব শেষে বললেন, ‘জানতাম টেস্টের প্রথম দুই দিন, বিশেষ করে চট্টগ্রাম টেস্টে...আমার জন্য অনেক বেশি কষ্টকর হবে। এর পর থেকে হয়তো সহজ হয়েছে। সুযোগ নিয়েছি বলতে পারেন, তবে সেটা হিসাব কষে সুযোগ নেওয়া আরকি!’

সুযোগ নেওয়ার ফল তো হাতেনাতেই পাচ্ছেন। বাংলাদেশও দেখছে নতুন ঢংয়ের সাকিবকে। প্রথম টেস্টে হঠাৎ চায়নাম্যান বনে গেলেন, এক বলের জন্য তাঁর বাঁহাতি স্পিনই হয়ে গেল ডানহাতি বোলারের জন্য অফ স্পিন! বলে ফ্লাইট দিচ্ছেন আগের মতো। কাল করুণারত্নেকে ওভাবে ঘূর্ণিতে বোকা বানিয়ে আউট করলেন...।

যদিও সেসব নিয়ে প্রশ্নে বারবারই সাকিব বলে গেলেন, কোনো পরিকল্পনা করে সেটা করেননি। চট্টগ্রামে চায়নাম্যান বোলিং নিয়ে তাঁর মনে হচ্ছে, ‘এটা নিয়ে ও রকম কাজ করা হয়নি। তবে বলটা করার পর মনে হয়েছে যে ওয়ানডে আর টি-টোয়েন্টিতেও এটা কাজে আসতে পারে, তাই এটা নিয়ে অনুশীলনে আরও কাজ করা উচিত।’

পরিকল্পনা না থাকলেও টেস্টে যে এভাবে আলাদা কিছু করার সময় পাওয়া যায়, ভাবার সুযোগ থাকে, সেটির কথাই বারবার বললেন সাকিব, ‘যদি দেখেন, সর্বশেষ তিন ইনিংসে প্রায় ১০০ ওভার বোলিং করেছি। এত ওভার বোলিং করলে স্বাভাবিকভাবে অনেক পরীক্ষা-নিরীক্ষা, অনেক পরিকল্পনা, অ্যাকশনে একটু বদল এনে দেখা...অনেক কিছুর সুযোগ থাকে। অনেকক্ষণ বোলিং করলে যেকোনো বোলারেরই ছন্দটা ভালো হতে থাকে, যদি সে রকম কোনো চাপের পরিস্থিতি না থাকে আরকি। সাধারণত ওয়ানডে আর টি-টোয়েন্টিতে তো এখন সারাক্ষণই চাপের পরিস্থিতি থাকে, উইকেট থেকেও সাহায্য পাওয়া যায় না। টেস্ট ম্যাচে নিজের বোলিংয়ে ছন্দ ফিরিয়ে আনার সুযোগ থাকে। সেদিক থেকে দেখলে প্রথম টেস্টের পর দ্বিতীয় টেস্টে এসে সেটাতে সুবিধা হয়েছে।’

পঞ্চম দিনে মুশফিক-লিটনের জুটির ওপরই বাংলাদেশের ভাগ্য অনেকটা নির্ভর করছে বলে মনে হচ্ছে সাকিবের

সুবিধাটা তুলে নিয়ে তাঁর পাঁচ উইকেট প্রাপ্তি হলেও আজ চতুর্থ দিনের শেষভাগে আরেকবার বাংলাদেশের টপ অর্ডার ধসে পড়েছে। ব্যক্তিগতভাবে খুশি সাকিবের তাই দল নিয়ে আক্ষেপ, ‘পাঁচ উইকেট পেলে তো অবশ্যই ভালো লাগবে। তবে হয়তো আরেকজন যদি ভালো বোলিং করত, আরেকজন বিশেষজ্ঞ বোলার যদি থাকত, তাহলে আরেকটু ভালো হতো।’

তা চার বছর পর পাঁচ উইকেটের দেখা পেয়েছেন, গত পাঁচ বছরে টেস্ট শতকের দেখা না পাওয়া সাকিবের সেই আক্ষেপটাও ঘুচবে কাল? বোলার সাকিবের পর ব্যাটসম্যান সাকিবের দেখাও মিলবে? সেঞ্চুরির প্রশ্নে সাকিবের আপত্তি, ‘আসলে সেঞ্চুরির চেয়েও আমি যদি তিন ঘণ্টা ব্যাট করতে পারি...এখন যারা আছে ওরা যদি লাঞ্চ পর্যন্ত ব্যাটিং করে, এরপর আমি যদি তিন ঘণ্টা ব্যাট করতে পারি, সেঞ্চুরির চেয়েও সেটা দলের জন্য বেশি কাজে আসবে।’

তবে পঞ্চম দিনে কাল বাংলাদেশের পরিকল্পনা কী হওয়া উচিত, সেটিতে নিজের এবং বাকি পাঁচ ব্যাটসম্যানের ভালো ব্যাটিংয়ের কথাই বারবার বলেছেন সাকিব। পরিকল্পনাটা কাগজে-কলমে সহজই, ‘আমিও চাই (ভালো ব্যাটিং করতে)। চার উইকেট পড়ে যাওয়ায় আমরা বাকি যে ছয় ব্যাটসম্যান আছি, সবাইকেই ভালো করতে হবে। পঞ্চম দিনে বিশেষ করে প্রথম ঘণ্টায় ওরা সবটুকু দিয়ে আক্রমণ করবে। ওদের জায়গায় থাকলে আমরাও তা-ই করতাম। ওই চাপটা সামলে নিতে হবে। প্রথম ঘণ্টায় যদি উইকেট না পড়ে, মধ্যাহ্নবিরতি পর্যন্ত যদি উইকেট না হারাই, তখন আমরা একটা অবস্থান তৈরি করতে পারব।’

না হলে তো টেস্ট বাঁচানোই কঠিন হয়ে যাবে!