প্রথম আলোর মুখোমুখি ব্রেট লি

খেলা ছেড়েছেন, তবে মাঠে এখনো তাঁর দেখা মিলে নিয়মিত। ছবি: শামসুল হক
খেলা ছেড়েছেন, তবে মাঠে এখনো তাঁর দেখা মিলে নিয়মিত। ছবি: শামসুল হক
ব্রেট লিকে ঘিরে মানুষের বিপুল আগ্রহ দেখে মনে হবে, নিদাহাস ট্রফিতে লিই সবচেয়ে বড় তারকা! ক্রিকেটের বাইরেও অনেক পরিচয় আছে অস্ট্রেলিয়ার সাবেক এই গতি তারকার। ক্রিকেট ও ক্রিকেটের বাইরের জীবন নিয়ে প্রথম আলোকে বিস্তারিত বললেন ৪১ বছর বয়সী সাবেক অস্ট্রেলিয়ান ফাস্ট বোলার। কলম্বো থেকে জানাচ্ছেন রানা আব্বাস

• একজন সাবেক ফাস্ট বোলার, সংগীতশিল্পী, গীতিকার, অভিনেতা, ধারাভাষ্যকার...

ব্রেট লি : (মৃদু হেসে) কখন আমার নামটা বলবেন?

• কোন পরিচয়টা শুনতে আপনার বেশি ভালো লাগে?
লি : আমার কাছে ছেলেবেলায় ক্রিকেট খেলাটা ভীষণ উপভোগ্য ছিল। সংগীত হচ্ছে জিগসের একটি অংশের মতো, যেটা আমার ঘাটতি ছিল, পূরণ হয়েছে; আমাকে অনেক প্রশান্তি দিয়েছে। অভিনয় করার চেষ্টা করেছি। ভেবেছি এটি মজার হবে। নতুন একটি চ্যালেঞ্জও বটে। ধারাভাষ্য দিতে ভালোবাসি। তবে আমার কাছে পরিবারই সব। পরিবারকেই সবার আগে রাখি। পরিবারই সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। আমাদের পরিবারের বন্ধনটা খুব দৃঢ়। প্রতিদিন বাবা-মায়ের সঙ্গে কথা বলি আমরা। দুই ভাই আমার সবচেয়ে প্রিয় বন্ধু। হ্যাঁ, পরিবার আগে, বাকি সব পরে।

• আমরা বহুমুখী প্রতিভাবান ব্রেট লিকে দেখি। একই সময়ে এত কিছু সামলানো কতটা কঠিন?
লি : সব সময়ই বলে এসেছি, জীবনে একটি সঠিক ভারসাম্য দরকার। আমার অনেক বন্ধু, অনেক খেলোয়াড়ই অস্ট্রেলিয়ার হয়ে খেলেছে। তাদের সবার একটিই প্যাশন ছিল—ক্রিকেট। আর আমি ক্রিকেট খেলেছি এটা উপভোগ করি বলে। ক্রিকেট কখনোই আমার প্রথম ভালোবাসা ছিল না। হ্যাঁ, অবশ্যই ক্রিকেট খেলাটা অনেক ভালোবাসি। এতে দেশে দেশে ঘোরার সুযোগ হয়েছে, নতুন নতুন মানুষের সঙ্গে মেশার সুযোগ হয়েছে। বিশ্বের সেরা খেলোয়াড়দের বিপক্ষে খেলার সুযোগ হয়েছে। আমার কাছে এটা খুব মজার ছিল। আমার আরও অনেক দিকে আগ্রহ ছিল, যেটি আমাকে এখন সামনে এগিয়ে নিচ্ছে। শুধু ক্রিকেটেই সীমাবদ্ধ থাকতে চাইনি।

আশা ভোসলের সঙ্গে গান গেয়েছেন ক্যারিয়ারের মধ্যগগনেই। ফাইল ছবি

• কখন ঠিক করলেন যে একজন ফাস্ট বোলার হবেন?
লি : নয় বছর বয়সে। মা-বাবাকে বলেছিলাম, পৃথিবীর সবচেয়ে গতিময় বোলার হব, অস্ট্রেলিয়ার ব্যাগি গ্রিন ক্যাপ পরব। নয় বছর বয়স থেকেই ঘণ্টায় ১৬০ কিলোমিটার গতিতে বল করতে চেয়েছি। ১৬০ কিলোমিটার গতিতে বোলিং করতে যত বাধা আসুক, সব পেরিয়ে যাওয়ার লক্ষ্যেই অনুশীলন করেছি।

• দুর্দান্ত ফাস্ট বোলার হতে কোন জিনিসটি বড় ভূমিকা রেখেছে আপনার ক্যারিয়ারে?
লি : আমি মনে করি, ভালো ফাস্ট বোলার হতে হলে আপনাকে ভালো অ্যাথলেট হতে হবে। ভালো স্প্রিন্টার হতে হবে। খুদে ক্রিকেটারদের আমি সব সময়ই একটা কথা বলি, চেষ্টা করো এবং জিমে ভারী যন্ত্রপাতি থেকে দূরে থাকো। ভারী জিনিসে আমি বিশ্বাসী নই। আপনি যদি এখন ব্যাটসম্যানদের দিকে তাকান, তারা আরও ভালো খেলছে, দিনে দিনে ভালো শট রপ্ত করছে। তারা ভালো কাঠের তৈরি ব্যাট নিয়ে খেলছে। বল জোরে মারছে। তারা তাদের টেকনিক কাজে লাগানোর চেষ্টা করছে। এখনকার দিনে বোলারদের সামনে অনেক বাধা, তাদের গতি কমে যাচ্ছে। আমি তো ধারাবাহিক ঘণ্টায় ১৪৫ কিলোমিটার গতিতে বোলিং করার বোলার খুব বেশি দেখি না। এটা হয়েছে তাদের অনুশীলনের কারণে। মনে হয় না তারা ঠিকভাবে অনুশীলন করে। আমি বলব ভারী জিনিস (ফিটনেস অনুশীলনে) কমিয়ে ফেলুন, হালকাই ভালো। রানিং, স্প্রিন্ট—এসব বাড়িয়ে দিন।

অন্য ভুবনের ব্রেট লি
• ক্রিকেটের বাইরে আপনি শোবিজেও বেশ সাড়া ফেলেছেন। বছর তিনেক আগে ‘আনইন্ডিয়ান’ চলচ্চিত্রে অভিনয় করলেন। সংগীতচর্চা আর অভিনয়—দুটির মধ্যে কোনটি বেশি চ্যালেঞ্জিং?
লি : সম্ভবত অভিনয় বেশি কঠিন। তবে এটা অনেক পছন্দ করি।
• বাংলা সংগীত সম্পর্কে ধারণা আছে?
লি : কিছু বাংলাদেশি গান শুনেছি। হয়তো সামনে সেখানে গেলে ভিন্ন কিছু সুর শিখব।
• আশা ভোসলের সঙ্গে আপনার অ্যালবাম বেরিয়েছে। হিন্দিতে গান তো গেয়েছেনই। বাংলা গান নিয়ে কাজ করার ইচ্ছে আছে?
লি : এই মুহূর্তে নেই। সামনে হতে পার।
• সাধারণত কাদের গান শুনতে ভালো লাগে?
লি : সব ধরনের গানই শুনতে ভালো লাগে। রক, ধ্রুপদি, বাণিজ্যিক রক, আর হ্যাঁ আশাজির সঙ্গে কাজ করে অনেক তৃপ্তি পেয়েছিলাম—হাম তুমারা হুঁ, তুমহারা...(গুনগুনিয়ে)। সি ইজ লাভিং! অসাধারণ ব্যক্তিত্ব।

• শৈশবে কে ছিলেন আপনার অনুপ্রেরণা?

লি: আমার বড় ভাই শেন, বাবা আর অ্যালান ডোনাল্ড। দক্ষিণ আফ্রিকান ফাস্ট বোলারের বোলিং দেখতে ভীষণ ভালো লাগত।

• যখন বারবার চোটে পড়েছেন, গতি কমিয়ে দেওয়ার কোনো সিদ্ধান্ত কি ভাবনায় এসেছে?
লি : না, খেলা শেষ না করা পর্যন্ত এটা ধরে রাখাই আমার লক্ষ্য ছিল। ১৬ বছর বয়সে ঘণ্টায় ১৫০ কিলোমিটার গতিতে বোলিং করতাম। এটা ধরে রাখতে চেয়েছি আমার শেষ ম্যাচ পর্যন্ত। ২০ বছর ধরে ঘণ্টায় ১৫০ কিলোমিটার কিংবা তারও বেশি গতিতে বোলিং করতে চেয়েছি। আমার সৌভাগ্য সেটি পেরেছিও। এটা সম্ভব হয়েছে কঠোর পরিশ্রম ও আত্মনিবেদনের কারণে। আমি চাইলে সহজ উপায় বেছে নিতে পারতাম, ১৫ কদম দৌড়ে ঘণ্টায় ১৩৫ কিলোমিটার গতিতে বোলিং করতে পারতাম। তবে এটা আমাকে রোমাঞ্চিত করত না। আমি জোরে বোলিং করতেই ক্রিকেটে এসেছি। সেটি করতে অন্যদের চেয়ে বেশি পরিশ্রম করেছি।

• স্টিভ ওয়াহ একবার বলেছিলেন, সাধারণত বয়স ৩০ পেরোলেই ফাস্ট বোলারদের গতি কমে যায়, সর্বোচ্চ ৮০ ভাগ গতিতে বোলিং করতে পারে তারা। কিন্তু ব্রেট পুরো ক্যারিয়ারে শতভাগ গতিতে বোলিং করেছে, যা অবিশ্বাস্য! কীভাবে এটা সম্ভব হলো, আপনাকে যেহেতু অনেক চোটাঘাত সামলাতে হয়েছে।
লি : এটা আসলে আমার অনুশীলনের ওপর নির্ভর করেছে। সুপার ফিট থাকতে পেরে নিজের গর্বই হয়। মানসিকভাবে ভীষণ শক্ত থাকাটাও খুবই গুরুত্বপূর্ণ। অনেকে খেলাটার ধরন বা প্রেক্ষাপট এড়িয়ে যায়। অবশ্যই আপনার টেকনিক থাকতে হবে। তবে আপনাকে যেতে হবে নানা প্রেক্ষাপটের মধ্য দিয়ে। মানসিকভাবে আপনাকে শক্ত থাকতে হবে, খুবই গুরুত্বপূর্ণ এটা। এমনও দিন গেছে ব্যথায় কাতরেছি। নিশ্চয়ই জানেন, আমার পা ভেঙে গিয়েছিল, পায়ের আঙুল ভেঙে গিয়েছিল। ব্যথার মধ্যেও আমাকে এগিয়ে যেতে হয়েছে।

• শোয়েব আখতারের সঙ্গে গতির লড়াইটা কেমন উপভোগ করতেন?
লি : অনেক উপভোগ করতাম। শোয়েবের সঙ্গে একই ম্যাচে বোলিং করতে ভীষণ ভালো লাগত। সে যেভাবে তেড়েফুঁড়ে বোলিং করত, ভালো লাগত। খেলাটার জন্য সে অসাধারণ এক বোলার ছিল।

• যখন শোয়েব আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে আপনার আগে ঘণ্টায় ১০০ মাইল বোলিংয়ের রেকর্ড গড়ল, কেমন লেগেছিল?
লি : চেয়েছিলাম আমিও ১০০ মাইল ছাড়িয়ে যাব!

• (পাশ থেকে শ্রীলঙ্কার সাবেক ক্রিকেটার ও বর্তমানে ধারাভাষ্যকার রাসেল আরনল্ড) তোমার কি কখনো শোয়েবের সঙ্গে এক দলে উদ্বোধনী জুটি গড়ে বোলিং করার ইচ্ছে হয়েছে ব্রেট?
লি : এক দলে খেলার কিছু কথা হয়েছিল। কিন্তু খেলা হয়নি। এক দলে খেলাটা...না, আমাদের কখনো সুযোগটা আসেনি।