বেচারা চার্ল ল্যাঙ্গেভেল্ট! পেস বোলিং কোচ হয়ে এসেছেন বাংলাদেশে। কিন্তু এসে প্রথম ম্যাচেই কী দেখলেন? তাঁর কোনো পাত্তা নেই। শুনতে বাজে শোনাচ্ছে? বা মনে হচ্ছে কোথাও কিছু ভুল হচ্ছে? তবে আরেকটু নিখুঁত করেই বলা যাক, তাঁর শিষ্যদের কোনো পাত্তাই নেই! তাঁরা পানি টানছেন মাঠের খেলোয়াড়দের জন্য। আর সে মাঠে প্যাঁচ কষতে ব্যস্ত স্পিনাররা। বাংলাদেশ দলে পেস বোলিংয়ের ‘সংস্কৃতি’টা ল্যাঙ্গেভেল্ট নিশ্চয়ই বুঝতে শুরু করেছেন অবশেষে!
দক্ষিণ আফ্রিকান এ কোচ এ দেশে নতুন এসেছেন। তাই সুরটা ধরতে কিছুটা সময় লেগেছে। কিন্তু বাংলাদেশের ক্রিকেটপ্রেমীদের কাছে বিষয়টি ডালভাত হয়ে গেছে। দেশের মাটিতে টেস্ট মানেই পেসাররা স্রেফ দর্শক। মেরেকেটে বড়জোর একজনকে রাখা হয় ‘অলংকার’ হিসেবে। চট্টগ্রাম টেস্টে সে অলংকারও বিসর্জন দিয়েছে টিম ম্যানেজমেন্ট। রসিকতায় মজে অনেকে বলতে পারেন, প্রতিপক্ষ আফগানিস্তান বলেই কি এই কৌশল?
বেশি দিন আগের কথা নয়, তিন বছর আগেই বাংলাদেশ সফরে এসেছিল ইংল্যান্ড। এর পরের বছর অস্ট্রেলিয়া। তাদের বিপক্ষেও ঘূর্ণি উইকেটে দলে অন্তত একজন পেসার খেলানোর সাহস দেখিয়েছিল টিম ম্যানেজমেন্ট। কিন্তু আফগানিস্তানের বিপক্ষে সে সাহসটুকুও দেখানো গেল না। পচা শামুকে যেন পা না কাটে, তা নিশ্চিত করতেই সম্ভবত বহুল চর্চিত ‘স্পিন-ওষুধ’-এর সর্বোচ্চ প্রয়োগ করা হয়েছে এ টেস্টে। বিশেষজ্ঞ ও ‘পার্ট টাইম’ মিলিয়ে দলে ছয়-ছয়জন স্পিনার!
সিমের ওপর বল ফেলার জন্য একজন আছেন বটে, কিন্তু তাঁকে পুরোপুরি পেসার বলা যায় না। মিডিয়াম পেসার। স্পিন জাল বিছিয়েও আসগর আফগান-রহমত শাহর জুটি ভাঙতে না পারায় সাকিব আল হাসান বাধ্য হয়ে সেই মিডিয়াম পেসার সৌম্য সরকারের হাতে বল তুলে দিয়েছেন দ্বিতীয় সেশনে। ল্যাঙ্গেভেল্টের মুখে তখন নিশ্চয়ই হাসি ফোটার কথা? দুধের স্বাদ অন্তত ঘোলে তো মিটল! আর স্পিন কোচ ড্যানিয়েল ভেট্টোরি এখনো যোগ দেননি বাংলাদেশ দলের সঙ্গে। কিন্তু আজ বাংলাদেশ দল বোলিং শুরু করার পরই ভিনদেশ থেকে তাঁর মুখে হাসি ফোটার কথা। শিষ্যরা যে তাঁর অবর্তমানেই বিশ্ব রেকর্ড গড়েছে!
দলে কোনো পেসার না থাকায় এ ধরনের কিছু একটা যে ঘটতে পারে, তা আন্দাজ করেছিলেন অনেকেই। আফগানিস্তানের ইনিংসে এক প্রান্ত থেকে বোলিংয়ের শুরু করেছিলেন তাইজুল ইসলাম। আর অন্য প্রান্ত থেকে সাকিব আসায় হয়ে যায় বিশ্ব রেকর্ড। টেস্ট ক্রিকেটে ১৪২ বছরের ইতিহাসে এমন কিছু এর আগে কখনো দেখা যায়নি। এর আগে কখনোই কোনো দলের টিম ম্যানেজমেন্ট এবং অধিনায়ক টেস্টে দুই প্রান্ত থেকেই বাঁ-হাতি স্পিনার দিয়ে বোলিং শুরু করানোর কৌশল খাটাননি। বাংলাদেশ তা আজ করে দেখিয়ে অনন্য নজিরই গড়ল। দেশের মাটিতে সর্বশেষ টেস্টেও কোনো পেসার খেলায়নি বাংলাদেশ। কিন্তু সেবার সাকিবের সঙ্গে অন্য প্রান্তে মিরাজ ছিলেন।
বোলিংয়ের শুরুতে অনন্য নজির এর আগেও গড়েছেন বাংলাদেশের স্পিনাররা। দুই বছর আগে বাংলাদেশ দলের নিউজিল্যান্ড সফরের কথা মনে আছে? বেসিন রিজার্ভে টেস্টে প্রথম ইনিংসে বোলিংয়ের শুরু করেছিলেন মিরাজ। নিউজিল্যান্ডের মাটিতে মিরাজের আগে কোনো স্পিনারই নতুন বলে বোলিং শুরু করেননি। এদিক বিচারে সেটি ছিল রেকর্ড। আর সেই টেস্টে দলে তাসকিন ও শুভাশীষ থাকতেও নতুন বল তুলে দেওয়া হয়েছিল মিরাজের হাতে। নিউজিল্যান্ডের পেসবান্ধব কন্ডিশনে পেসাররাই যদি পাত্তা না পান, তাহলে দেশের স্পিনপ্রেমী উইকেটে তাঁদের কেন বিবেচনা করা হবে?
দেশের মাটিতে স্পিনারদের সফল হওয়ার নজিরও পুরোনো হয়নি। গত বছরই ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিপক্ষে দুই ম্যাচের টেস্ট সিরিজে প্রতিপক্ষের সব উইকেট নেওয়ার রেকর্ড গড়েছিলেন দেশের স্পিনাররা। তাই পেসারদের জন্য আক্ষেপ না করে বাস্তবতা মেনে নেওয়াই ভালো—যস্মিন দেশে যদাচার! আর সে আচার পালন করতে গিয়ে এমন দু-একটা রেকর্ড হলে সে তো ভালো কথা। আর একটি রেকর্ড তো অল্পের জন্য হাতছাড়া হয়ে গেল।
কোনো টেস্ট ম্যাচের প্রথম ইনিংসে পেসার ছাড়াই পাঁচ স্পিনারকে দিয়ে বোলিং শুরু করিয়েছে বাংলাদেশ দল। টেস্ট ইতিহাসে এমন নজির এর আগে একবারই দেখা গেছে। ১৯৬৪ সালে ইংল্যান্ডের বিপক্ষে টেস্টে এ পথটা প্রথম দেখিয়েছিল ভারত। সে ম্যাচে অবশ্য পরে মিডিয়াম পেসারদের কাজে লাগিয়েছিল তারা। এ ম্যাচেও দ্বিতীয় সেশনে সৌম্যর হাতে বল তুলে দিয়েছেন সাকিব। তবে উইকেট যা পাওয়ার এ পর্যন্ত সব-ই স্পিনারদের। তাই পেসারদের জন্য আক্ষেপ করা অরণ্যে রোদন ছাড়া আর কি!